22/10/2025
গোবর্দ্ধন পূজা ও অন্নকূট মহোৎসব-২০২৫
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
আজ ২২ অক্টোবর বুধবার অন্নকূট মহোৎসব-২০২৫। শ্রীল জীব গোস্বামী তাঁর 'গোপাল চম্পু' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন - শরতের ঠিক মাঝামাঝি আসে কার্তিক মাস। সেই সময় এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ব্রজবাসীরা। সেই সময় তাঁরা ইন্দ্র পূজা করেন। ব্রজবাসীরা সবাই তাই অত্যন্ত ব্যস্ত। কৃষ্ণের বয়স তখন সাত বছর। তাঁর পিতা এবং অন্যান্য লোকেদের নানান কাজে ব্যস্ত দেখে কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি করছো পিতা? তখন নন্দ মহারাজ বললেন যে, আমরা ইন্দ্রপূজা করছি।
কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন ইন্দ্রপূজা কেন করছো? নন্দ মহারাজ বললেন যে, দেখো, আমরা তো বৈশ্য, গোপজাতি। কৃষি এবং গো-পালন হচ্ছে আমাদের জীবিকা। গো-পালনের জন্য আমাদের ঘাসের দরকার, চাষবাসের জন্য আমাদের বৃষ্টি দরকার। আর ইন্দ্র হচ্ছেন বৃষ্টির দেবতা। তাই আমরা ইন্দ্রের পূজা করি যাতে ইন্দ্র আমাদের প্রতি প্রসন্ন হয়ে বৃষ্টি দান করেন।
কৃষ্ণ বললেন, বাবা, সমুদ্রের মাঝখানে তো কেউ ইন্দ্র পূজা করে না, তাহলে সেখানে কেন বৃষ্টি হয়? নন্দ মহারাজ একটু চিন্তা করে দেখলেন যে তাইতো, আমরা ভাবছি ইন্দ্রকে পূজা করার ফলে বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু অনেক জায়গায়তো ইন্দ্রপূজা হয় না, সেখানেও তো বৃষ্টি হয়। যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানেও বৃষ্টি হয়। তখন নন্দ মহারাজ বললেন, দেখো এটা আমাদের চিরাচরিত প্রথা। সেই প্রথা অনুসারে আমরা ইন্দ্রপূজা করি।
কৃষ্ণ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এই প্রথাটি শাস্ত্রীয়, না লোকাচার। নন্দ মহারাজ একটু ফাঁপরে পড়ে গেলেন, তিনি ভাবতে লাগলেন কোন শাস্ত্রে আছে। তাই তিনি বললেন এটা লৌকিক আচার। কৃষ্ণ বললেন, দেখো বাবা, শুধু শুধু লৌকিক আচার করে আমাদের কি লাভ! আমাদের জীবিকা যে গো-পালন, গাভী বর্ধনের জন্য আমরা গোবর্ধনের কাছে ঋণী, ইন্দ্রের কাছে নয়। চলো আমরা গোবর্ধনের পূজা করি। যদিও কৃষ্ণ সাত বছরের ছেলে, তবুও কৃষ্ণ যা-ই বলে নন্দ মহারাজ এবং অন্যান্য সকলে তা মেনে নেন। তাই নন্দ মহারাজ এবং অন্যরা সকলে মিলে ইন্দ্রপূজার যে আয়োজন করেছিলেন, তা নিয়ে গোবর্ধন পূজা করতে চললেন।
সমস্ত আয়োজন গুলোকে জড়ো করা হলো, সেটা একটা পাহাড়ের রূপ ধারণ করলো। সেই পাহাড়টি ছিলো অন্নের পাহাড়। অন্নকূট, অন্নের পাহাড়। তাতে প্রথমে দেওয়া হলো রুটি, লুচি, তার উপরে দেওয়া হল অন্ন। বিভিন্ন রকমের অন্ন যেমন সাদা অন্ন, লাল অন্ন, নীল অন্ন, হলুদ অন্ন, সবুজ অন্ন ইত্যাদি। যত রকমের সবজী হয়েছিল সেগুলো দিয়ে সাজানো হলো।তারপর সেই পাহাড়ের ওপর দিয়ে ঘি -এর ঝর্ণা বইতে লাগলো। এইভাবে সমস্ত অন্নকুট বা অন্নের পাহাড়টি গোবর্ধনকে নিবেদন করা হলো। তখন সবাই দেখলো, একদিকে এক ছোট কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, আর অন্যদিকে গোবর্ধনের জায়গায় এক বিশাল কৃষ্ণ অবস্থান করছেন, যে অন্নগুলো হাত দিয়ে তুলছে, সেই জায়গাটা আবার পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে এক কৃষ্ণ খাচ্ছে, আরেক কৃষ্ণ দেখছে। এরকমও উল্লেখ আছে যে, কখনও কখনও ঐ গোবর্ধন কৃষ্ণ বলছেন আরও নিয়ে এসো, আমার আরও লাগবে। তখন সকল গোপেরা আরও অনেক কিছু খাবার নিয়ে এসে কৃষ্ণকে দিচ্ছে। এইভাবে খাওয়া শেষ হলে গোবর্ধনের ঝর্ণা থেকে জল খেয়ে কৃষ্ণ ঢেকুর তুললেন। এইভাবে তাঁর খাওয়া সমাপ্ত হলো। এভাবেই গোবর্দ্ধন পূজা ও অন্নকূট মহোৎসবের সূচনা হলো।
''অন্নকুট শব্দের অর্থ অন্নের পর্বত''
""""""""""""""""""""""""""""""""""""
'দ্বাপরের শেষের দিকে গিরিরাজ গোবর্ধন পূজা উপলক্ষে বৃন্দাবনের ব্রজবাসীরা যে অন্নকুট মহোৎসবের আয়োজন করেছিলেন, তাতে কৃষ্ণ স্বয়ং গিরিগোবর্ধন রুপ ধারন করে পর্বত- প্রমান ভোগ্যবস্তু খেয়েছিলেন। আর এই কলিয়ুগে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর পুর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুদ্ধভক্ত মাধবেন্দ্র পুরীপাদ কর্তৃক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই উৎসবে স্বয়ং গোপাল পাহাড় সমান ভোগ্যসামগ্রীগুলি গ্রহন করেছিল। বর্তমানে এই গোপাল বিগ্রহ নাথোদ্বারে শ্রীনাথজী নামে বল্লভ-সম্প্রদায় দ্বারা স্বাড়ম্বরে পুজিত হচ্ছে। একবার শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরীপাদ তীর্থ ভ্রমন করতে করতে বৃন্দাবনে উপনীত হন। তিনি গিরি গোবর্ধন পরিক্রমা করে যমুনায় স্নান সেরে গোবিন্দকুন্ডের তীরে একটি বৃক্ষ্মুমুলে বসে প্রেমানন্দে হরিনাম জপ করছিলেন। সে সময় এক গোপবালক এক ভান্ড দুধ অযাচক মাধবেন্দ্র পুরীকে দিয়ে বললেন,''এই দুধ টুকু তুমি পান কর। এখানে সবাই মেগে খায়, তুমি মেগে খাচ্ছ না কেন ?'' পুরীপাদ ছোট গোপবালকের রুপে মুগ্ধ হলেন এবং বললেন, তুমি কি করে জানলে আমি না খেয়ে আছি ? গোপবালক উত্তর দিল,''স্ত্রীলোকেরা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তোমাকে দেখে গেছে তারাই আমাকে এই দুধ দিয়ে পাঠালেন। তুমি দুধ টুকু খাও আমি পরে এসে ভান্ডটি নিয়ে যাব''। গোপবালক চলে গেলে দুধ খেয়ে ভান্ডটি ধুয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু ও এল না এবং পুরীপাদ ঘুমিয়ে গেলেন। পুরীপাদ স্বপ্নে দেখলেন গোপবালক তাকে বলছেন,''আমি বহুবছর ধরে এই কুঞ্জের ভিতর পড়ে আছি। তুমি গ্রামের লোকজন নিয়ে এই কুঞ্জ থেকে উদ্ধার কর এবং গিরিগোবর্ধনে যত্ন করে মন্দির স্থাপন করে শীতল জল দিয়ে পরিমার্জন কর। আমি শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র ব্রজ্যনাভের স্থাপিত বিগ্রহ আমার নাম গোপাল''। পুরীপাদ বুঝতে পারলেন স্বয়ং ভগবান তাকে দুধ দিলেন কিন্তু তিনি চিনতে না পারে দুঃখ করে প্রেমাবশে ভুমিতে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষন প্রেমক্রন্দন করে গোপালের আদেশ পালন করতে পাশের গ্রামের লোকজন নিয়ে কুঞ্জ খনন করে গোপালকে করলেন। গোপালের ভারী বিগ্রহটি গিরিগোবর্ধনে একটা পাথরের সিংহাসন তৈরী করে গোপালকে পুরীপাদ স্বয়ং অভিষেক করলেন। পুনরায় তৈল দিয়ে শ্রীঅঙ্গকে চক্চকে করা হল, নতুন বস্ত্র পরিধান করিয়ে চন্দন, তুলসী ও ফুলের মালা পরানো হল।
বৃন্দাবনে প্রলয়ঙ্কর (ইন্দ্রের ক্রোধ) বারিবর্ষণ-কৃষ্ণ লীলা কথা
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
ইন্দ্র যখন বুঝতে পারলেন যে, তার উদ্দেশ্যে বৃন্দাবনের গোপেরা যে যজ্ঞের আয়োজন করেছিল শ্রীকৃষ্ণ তা বন্ধ করে দিয়েছেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং তার সেই রাগ ব্রজবাসীদের উপর বর্ষিত হল। যদিও দেবরাজ ইন্দ্র জানতেন যে, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাদের রক্ষা করছেন। বিভিন্ন মেঘের পরিচালক ইন্দ্র তখন সাম্বর্তক মেঘকে আহ্বান করলেন। জড় সৃষ্টি যখন ধ্বংস করার প্রয়োজন হয়, তখন এই মেঘকে ডাকা হয়। ইন্দ্র সেই প্রলয়ঙ্কর সাম্বর্তক মেঘকে আদেশ দিলেন বৃন্দাবনের উপর প্রবলভাবে বারিবর্ষণ করে সেই অঞ্চলকে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত করতে। আসুরিক ভাবাপন্ন হয়ে ইন্দ্র মনে করেছিলেন যে, তিনিই হচ্ছেন সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর। অসুরেরা যখন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তারা পরম নিয়ন্তা পরমেশ্বর ভগবানকে অস্বীকার করে।
ইন্দ্র যদিও অসুর ছিলেন না কিন্তু তাঁর উচ্চ পদের গৌরবে গর্বান্বিত হয়ে তিনি পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, তিনি শ্রীকৃষ্ণের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। ইন্দ্র বললেন, "দেখ, বৃন্দাবনের অধিবাসীরা কি রকম উদ্ধত হয়ে উঠেছে! তারা সাধারণ বনবাসী, কিন্তু একটা সাধারণ বালক কৃষ্ণকে আশ্রয় করে আমার যজ্ঞ বর্জন করে দেবতাদের অবমাননা করতে সাহস করছে।
ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ ঘােষণা করেছেন যে, যারা দেবতাদের পূজা করে, তারা বিশেষ বুদ্ধিমান নয়। তিনি আরও বলেছেন যে, সব রকমের পূজা-অর্চনা এবং তথাকথিত ধর্ম অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে কেবল তার শরণাগত হতে। এইভাবে ইন্দ্রের ক্রোধ উৎপাদন করে এবং অবশেষে তাকে শাসন করে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যারা কৃষ্ণভাবনা সহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের অন্য কোন দেব-দেবীর পূজা করার কোন প্রয়োজন নেই, তাতে যদি সেই সমস্ত দেব-দেবীরা ক্রুদ্ধ হন, তবুও নয়। শ্রীকৃষ্ণ তার ভক্তদের সর্বতোভাবে রক্ষা করেন এবং তাই ভক্তের কর্তব্য হচ্ছে, সম্পূর্ণভাবে তাঁর কৃপার উপর নির্ভর করা। ইন্দ্র বৃন্দাবনবাসীদের আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন, দেবতাদের আধিপত্যের অবমাননা করার ফলে বৃন্দাবনবাসীরা জীবনে নানা রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করবে।
দেবতাদের যজ্ঞে অবহেলা করার ফলে তারা বিপদসঙ্কুল এই ভবসমুদ্র পার হতে পারবে না। ইন্দ্র আরও বললেন, বৃন্দাবনের গোপেরা কৃষ্ণ নামক একটি বাচাল বালকের উপদেশে আমার আধিপত্যকে অবহেলা করেছে। এই কৃষ্ণ একটি শিশু, এবং সেই শিশুর উপর নির্ভর করে তারা আমার ক্রোধ উৎপাদন করেছে।” এইভাবে তিনি সাম্বর্তক মেঘকে আদেশ দিলেন বৃন্দাবনের সমস্ত সম্পদ ধ্বংস করতে। ইন্দ্র বললেন, “বৃন্দাবনবাসীরা তাদের জড় ঐশ্বর্যের গর্বে এবং তাদের ক্ষুদ্র বন্ধু কৃষ্ণের উপস্থিতির ফলে অত্যন্ত গর্বান্বিত হয়ে উঠেছে।
এই কৃষ্ণ একটি বাচাল শিশুমাত্র এবং এই সম্পূর্ণ জড় সৃষ্টি সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই নেই, যদিও সে একটা বাচাল ছেলের মতো মনে করে যে, সে সব কিছু জেনে বসে আছে। যেহেতু তারা কৃষ্ণের উপর এই রকম গুরুত্ব আরোপ করেছে, তাই তাদের দণ্ডভোগ করতে হবে। আর তাই আমি সাম্বর্তক মেঘকে আদেশ দিয়েছি সেখানে গিয়ে সেই স্থানকে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত করতে।
তাদের গাভীসহ তারা যেন বিনাশ প্রাপ্ত হয়। এখানে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, গ্রামে এবং শহরের বাইরে মানুষদের সমৃদ্ধি নির্ভর করে গাভীর উপর। গো-ধন যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন মানুষ সর্বতোভাবে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। ইন্দ্র যখন সাম্বর্তক এবং তার সহচর মেঘদের বৃন্দাবনে গিয়ে বর্ষণ করতে আদেশ দিলেন, তখন সেই মেঘেরা অত্যন্ত ভীত হল।
তাই ইন্দ্র তাদের অভয় দিয়ে বললেন, “তােমরা যাও এবং তোমাদের সঙ্গে ঐরাবতে চড়ে ঝক্সাসহ আমিও যাচ্ছি, এবং বৃন্দাবনবাসীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি আমার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করব।" এইভাবে দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ভয়ঙ্কর সমস্ত মেঘেরা বৃন্দাবনের উপর এসে উপস্থিত হল এবং তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রবলভাবে বর্ষণ করতে লাগল।
তখন নিরন্তর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল এবং বজ্রপাত হচ্ছিল, আর বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে হাওয়া বইছিল। তীক্ষ্ণ বাণের মতো সেই বৃষ্টির ধারা ঝরে পড়ছিল। নিরন্তর স্তম্ভের মতো স্থুল জলধারা বর্ষণ হওয়ার ফলে বৃন্দাবনের সমস্ত ভূমি জলরাশিতে প্লাবিত হয়ে গেল এবং তখন আর বোঝা গেল না কোথায় ভূমি উঁচু আর কোথায় নীচু।
সেই পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, বিশেষ করে পশুদের জন্য। বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে বায়ু বইছিল এবং ভীষণ শীতে বৃন্দাবনের প্রতিটি প্রাণী থরথর করে কাঁপতে লাগল। তাদের আর কোন আশ্রয় ছিল না, তাই তারা গোবিন্দের কাছে গিয়ে তার শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করল। গাভীরা এই প্রচণ্ড বর্ষণে অত্যন্ত উৎপীড়িত হয়ে তাদের দেহের দ্বারা মস্তক এবং বৎসদের আচ্ছাদিত করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করল।
সেই সময় বৃন্দাবনের সমস্ত অধিবাসীরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন, হে কৃষ্ণ, তুমি সর্বশক্তিমান এবং তুমি ভক্তবৎসল, কৃপা করে এখন তুমি আমাদের রক্ষা কর। ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের দ্বারা আমরা অত্যন্ত উত্ত্যক্ত হয়েছি।”
এই প্রার্থনা শুনে শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, ইন্দ্র তাঁর যজ্ঞের সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে এই অসময়ে ঝড়-ঝঞ্গাসহ শিলা এবং বৃষ্টি বর্ষণ করছেন। শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন যে, এটা ক্রুদ্ধ ইন্দ্রের বলপ্রকাশ। তিনি তাই ঠিক করলেন, এই দেবতা নিজেকে সর্বশক্তিমান বলে মনে করে তার শক্তি প্রদর্শন করছে কিন্তু এখন আমি এর জবাব দেব এবং আমি ওকে শিক্ষা দেব যে, এই ব্রহ্মাণ্ডের পরিচালনার কাজে সে সর্বেসর্বা নয়। আমি হচ্ছি কলের পরম নিয়ন্তা এবং তার পদমর্যাদার গর্ব ও তার শক্তির দর্প এবার আমি চূর্ণ করব।
দেবতারা আমার ভক্ত, তাই তাদের পক্ষে আমার পরম পদ ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পদমর্যাদার গর্বে সে এতই গর্বিত হয়ে উঠেছে যে, তার দুর্মতি হয়েছে। আমি এখন তাকে এই মিথ্যা অহঙ্কার থেকে মুক্ত করব। বৃন্দাবনের শুদ্ধ ভক্তরা এখন সর্বতোভাবে আমার কৃপার ওপর নির্ভর করে আছে এবং আমিও সম্পূর্ণভাবে তাদের আমার আশ্রয়ে গ্রহণ করেছি। এখন আমি তাদের রক্ষা করব। আমার যোগমায়ার প্রভাবে আমি তাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করব।"
মনে মনে এইভাবে চিন্তা করে শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ এক হাতে গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরলেন—ঠিক যেভাবে একটি শিশু মাটি থেকে একটা ব্যাঙের ছাতা তোলে। এইভাবে তিনি গিরি গোবর্ধন ধারণ লীলা প্রদর্শন করলেন।
তারপর তার ভক্তদের সম্বোধন করে তিনি বললেন, “হে মাতঃ, হে পিতঃ, হে ব্রজজন, তোমরা তোমাদের গো-ধনের সঙ্গে নিশ্চিন্তে এই গোবর্ধন পর্বতের নীচে এসে দাঁড়াও যা আমি এখন একটা ছাতার মতো তুলে ধরেছি। তোমরা এই মনে করে ভয় পেও না যে, আমার হাত থেকে এই পর্বত পড়ে যাবে।
প্রবল বর্ষণে এবং ঝঞ্জায় তোমরা খুবই ক্লিষ্ট হয়ে পড়েছ, তাই আমি এই পর্বত তুলে ধরেছি যা একটা বিট দুতার মতো তোমাদের এই বর্ষণ থেকে রক্ষা করবে। তোমাদের পরিত্রাণের জন্য আমি এই উপায় বিধান করেছি। তোমরা এখন তােমাদের পশুসহ এই বিরাট ছাতার নীচে এসে সুখে আশ্রয় গ্রহণ কর।”
শ্রীকৃষ্ণ তাদের এইভাবে আশ্বাস দিলে সমস্ত ব্রজবাসীরা তাদের পশু, শকটসমূহ, ভূত্য আদি সঙ্গে নিয়ে একুধের আদেশ অনুসারে সেই বিরাট পর্বতের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তাদের পশুসহ ব্ৰজবাসীরা এক সপ্তাহকাল সেখানে অবস্থান করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং নিজের সমস্ত সুখ পরিত্যাগ করে সেই এক সপ্তাহ ধরে একটা ছাতার মতো গােবর্ধন পর্বত ধারণ করে রইলেন।
তাঁর বাম হাতের কড়ে আঙ্গুলের উপর শ্রীকৃষ্ণকে সেই বিরাট পর্বত ধারণ করতে দেখে ব্রজবাসীরা অবাক হয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণের এই অলৌকিক শক্তি দেখে দেবরাজ ইন্দ্র বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সংকল্লচ্যুত হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ মেঘদের ডেকে তাদের নিবারিত করলেন। আকাশ যখন সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত হল, তখন আবার সূর্যোদয় হল এবং প্রচণ্ড বায়ু ও বৃষ্টি নিবৃত্ত হল।
সেই সময় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, এখন যাঁর আরেক নাম হল গিরিধারী, বললেন, “হে গোপগণ তোমরা, এখন তোমাদের স্ত্রী-পুত্র, গাভী এবং ধনসম্পদ সহ ফিরে যেতে পার। এখন আর কোন ভয় নেই। বায়ু ও বৃষ্টি এখন নিবৃত্ত হয়েছে এবং নদীর প্লাবন প্রশমিত হয়েছে।
তখন সমস্ত গোপেরা তাঁদের উপকরণসমূহ শকটে পূর্ণ করে তাদের গাভী এবং অন্যান্য পশুদের নিয়ে ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁরা সকলে বেরিয়ে এলে শ্রীকৃষ্ণ সকলের সামনে অনায়াসে গোবর্ধন পর্বতকে আগের মতো স্বস্থানে স্থাপন করলেন। তখন প্রেমের আবেগে পরিপূর্ণ চিত্তে বৃন্দাবাসীরা কৃষের কাছে এসে তাকে আলিঙ্গন করলেন।
শ্রীকৃষ্ণের প্রতি স্বভাবত স্নেহশীলা গোপীরা তাদের অশ্রুমিশ্রিত দধি তাকে দিলেন এবং তাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। মা যশোদা, মা রোহিলী, নন্দ মহারাজ এবং মহাবলীয়ান বলরামও তখন স্নেহবিহুল হয়ে একে একে শ্রীকৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করলেন।
তখন স্বর্গের দেবতা, সিদ্ধ, গন্ধর্ব এবং চারণেরা তুষ্ট হয়ে স্তুতি এবং পুষ্পবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন স্বর্গের দেবতারা শঙ্খ, দুন্দুভি, ডম্বরু প্রভৃতি বাজনা বাজাচ্ছিলেন এবং গন্ধর্বপতিরা গান করছিলেন। তারপর পরমেশ্বর ভগবান তার সখা এবং পশু-পরিবৃত হয়ে তার গৃহে ফিরে গেলেন। গোপিকারা হৃদয়স্পর্শী শ্রীকৃষ্ণের সেই বিস্ময়জনক কার্যের বিষয়ে হৃষ্টচিত্তে গান করতে লাগলেন।
পরবর্তীতে শ্রীল মাধবেন্দ্র পুরী গোপাল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করার পর আবারো অন্নকূট মহোৎসব চালু করেন।
শ্রীশ্রী গিরিরাজ গোবর্ধন পূজার ইতিহাস ও মাহাত্ম্য:
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
গোবর্ধন পূজা ও পরিক্রমার মাধ্যমে ভগবৎধাম প্রাপ্তি হয়। এছাড়াও এদিন গোপূজা কর্তব্য। গোবর্ধন ও গোপূজাকে গোবর্ধন যজ্ঞ বলে। এটি শ্রীকৃষ্ণকে অপরিসীম সন্তুষ্ট করে এবং এর ফলে ধন, ঐশ্বর্য, গাভী এবং সমৃদ্ধি বর্ধিত হয়। গোবর্ধন হচ্ছেন ভগবানের অন্যতম সেবক। প্রকৃত অর্থে স্বয়ং ভগবান নিজেই গোবর্ধনরূপে আবির্ভূত হয়েছেন তাই তাঁর সেবার মাধ্যমে কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয়।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় লীলাভূমি ব্রজমণ্ডলের অন্যতম স্থান গিরিরাজ শ্রী গোবর্ধন। ভগবান তাঁর প্রিয় সখাদের সাথে এই গোবর্ধন পর্বতে ক্রীড়া করেছেন, গোচারণ করেছেন এবং শ্রীমতি রাধারাণীর সাথে লীলাবিলাস করেছেন এই গোবর্ধন পর্বতের উপরেই। শ্রীবৃন্দাবন লীলামৃতের একাদশ উল্লাসে উক্ত হয়েছে-
বৃন্দাবন মধ্যে শ্রেষ্ঠ গিরি-গোবর্ধন।
হরিদাস-বর্য যাঁরে কহে গোপীগণ ॥
হরিপাদপদ্মের স্পর্শপ্রাপ্ত গোবর্ধন পর্বত ‘হরিদাস-বর্য’ নামে খ্যাত। যার অর্থ হচ্ছে শ্রীহরির সেবকগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্যধাম শ্রীগোলোক-বৃন্দাবনে শতশৃঙ্গ নামে এক মহিমান্বিত পর্বত বিদ্যমান। এ শতশৃঙ্গ পর্বতই শ্রীমতী রাধারাণীর ইচ্ছায় ভৌম বৃন্দাবনে গোবর্ধন পর্বতরূপে আবির্ভূত হন। কার্তিক-দামোদর মাসের শুক্ল দ্বিতীয়াতে গিরিরাজ গোবর্ধনের পূজা স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রণয়ন করেন।
রামায়ণে উল্লিখিত হয়েছে, যখন ভগবান রামচন্দ্র সেতুবন্ধ থেকে লংকা পর্যন্ত সমুদ্রের উপর পাথরের সেতু নির্মাণ করছিলেন, তখন হনুমান বহু দূর দূরান্ত থেকে পাথর নিয়ে আসছিলেন। তখন ভারতের পশ্চিমে অবস্থিত শাল্মলী দ্বীপে দ্রোণ পর্বতের পুত্ররূপে আবির্ভূত আট কিলোমিটার দীর্ঘ গোবর্ধন পর্বতকে সেতু নির্মাণের জন্য নিয়ে আসতে চান। কিন্তু পথিমধ্যে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে জানতে পেরে তিনি গোবর্ধনকে রেখে এলেন। তখন শ্রীগোবর্ধন নিজেকে ভগবৎসেবার অযোগ্য ভেবে খুব ব্যথিত হন। তখন ভগবান শ্রীরাম তাঁর নিকটে আবির্ভূত হন এবং বলেন, “প্রিয় গোবর্ধন! তুমি দুঃখিত হয়ো না। যখন দ্বাপরে আমি আমার সকল ঐশ্বর্য নিয়ে স্বয়ংরূপে অবতীর্ণ হব, তখন তোমার মনোরম পৃষ্ঠে আমার সখা এবং গোপিকাদের সাথে বিহার করব।”
পরবর্তীতে পুলস্ত্য মুনি কাশীতে তপস্যা করার স্থান হিসেবে গোবর্ধনকে নিয়ে যেতে মনঃস্থ করেন। শর্ত ছিল তিনি কোথাও তাকে নামিয়ে রাখবেন না। কিন্তু বৃন্দাবনের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় গিরিরাজ তাঁর নিত্য আবাসকে চিনতে পেরে ভার বৃদ্ধি করেন, তখন মুনি শর্ত ভুলে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তাঁকে নামিয়ে রাখেন। কিন্তু পরে যখন তিনি তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলেন, তখন আর তাঁকে তুলতে পারলেন না।
তখন গিরিরাজের কাশী যাওয়ার অনিচ্ছা বুঝতে পেরে তিনি তাঁকে প্রতিদিন তিল পরিমাণ ক্ষয় হওয়ার অভিশাপ দেন। তাই কালক্রমে এই সুউচ্চ পর্বত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। বিভিন্ন শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, কলিযুগে একসময় গঙ্গাদি পবিত্র নদী ও গিরিরাজ গোবর্ধন অন্তর্ধান করবেন এবং তখন কলির ভয়াবহ প্রকোপ শুরু হবে। তাই যারা এর পূর্বে গঙ্গা এবং গোবর্ধনের দর্শন ও সেবা করবার সুযোগ পাচ্ছেন তারা মহাভাগ্যবান।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পরিকরগণের সাথে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন। তিনি বৃন্দাবনে নানা লীলাবিলাস করেন। একদিন তিনি দেখলেন, তাঁর পিতা নন্দমহারাজসহ অন্যান্য ব্রজবাসী গোপেরা নানা দ্রব্য দিয়ে ইন্দ্রদেবের উদ্দেশ্যে পূজার আয়োজন করেছেন। তিনি তাঁর পিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হে পিতা! এটি কী শাস্ত্রীয় পূজা নাকি লৌকিক?” নন্দ মহারাজ জানালেন, যদিও শাস্ত্রে এই বিধান নেই, কিন্তু যেহেতু ইন্দ্র তাদের বৃষ্টি প্রদান করেন এবং বৃষ্টির ফলেই গোচারণ ভূমিতে ঘাস উৎপাদিত হয়, যা তাদের গোপালনের জন্য অপরিহার্য, তাই তারা বহুকাল যাবৎ এই পূজা করছেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, এই বৃষ্টি ইন্দ্রের জন্য নয়, বরং আপনাদের কৃতকর্মের ফলেই প্রাপ্ত হচ্ছেন। আর উপযুক্ত স্থানে বৃষ্টিপ্রদান ইন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব। এমন নয় যে পূজা করলেই তিনি বৃষ্টি দেবেন, আর না করলে দিবেন না। বরং কেউ যদি প্রকৃতই আমাদের উপকার করেন, তবে তা করছেন গিরিরাজ শ্রীগোবর্ধন। এই গোবর্ধনে উৎপন্ন গুল্মাদিই আমাদের গাভীদের প্রিয় আহার্য এবং আমাদের গোধন বৃদ্ধির উপায়। তাই আমাদের উচিত আমাদের প্রিয় পবিত্র গোধন, ব্রাহ্মণ এবং গিরি-গোবর্ধনের পূজা করা। আমরা এসকল দ্রব্য দিয়ে গিরিরাজের পূজা করতে পারি এবং গাভীদের তৃণাদি ভোজন করাতে পারি এবং ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা প্রদান করতে পারি। তারপর তিনি ঘোষণা করলেন-
অন্যেভ্যশ্চাশ্বচণ্ডালপতিতেভ্যো যথার্হতঃ।
যবসং চ গবাং দত্বা গিরয়ে দীয়তাং বলিঃ ॥
স্বলংকৃতা ভুক্তবন্তং স্বনুলিপ্তাঃ সুবাসসঃ।
প্রদিক্ষণং চ কুরুত গোবিপ্রান্ন পর্বতান্ ॥
গাভীদের গোখাদ্য এবং গিরিরাজকে ভোগনিবেদন করা হোক, সমাজে যারা অবহেলিত, চণ্ডাল, পতিত এমনকি কুকুরকেও যথাযোগ্য ভোজন করানো হোক। তারপর সকলে তৃপ্তির সঙ্গে সেই প্রসাদ গ্রহণ করে সুসজ্জিত হয়ে গাভী, ব্রাহ্মণ, অগ্নি এবং গোবর্ধন পর্বতকে প্রদক্ষিণ করবে। আর এভাবে তা গিরিরাজের প্রীতি বর্ধন করবে। (শ্রীমদ্ভাগবত ১০.২৪.২৮-২৯)