03/08/2025
"মহাপ্রভু সকলের প্রতি যত্নপরায়ণ ছিলেন" মহাপ্রভু কোনকিছু বিচার না করে কৃপা বিতরণ করেছিলেন। তিনি স্নেহ-যত্ন করতেন, সবাইকে প্রসাদ ও কৃপা বিতরণ করতেন। যারা সন্ন্যাসী ও অতিথিদের হয়রান করে নিজেদেরকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী বলে দাবি করে তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে তারা প্রকৃতপক্ষে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী নয়।
শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজ
চৈতন্যলীলা ক্লাস, আগস্ট ০৩, ২০১৬, শ্রীধাম মায়াপুর, ভারত
শ্রীল জয়পতাকা স্বামী গুরুমহারাজের উক্তিটি থেকে বোঝা যায় যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা ছিল শর্তহীন। তিনি কাউকে বিচার না করে সকলের প্রতি সমানভাবে কৃপা বিতরণ করেছেন। এর থেকে তিনি মহাপ্রভুর অনুসারীদের জন্য একটি স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন: প্রকৃত অনুসারীরা মহাপ্রভুর মতো যত্নশীল ও করুণাময় হবে, এবং সন্ন্যাসী ও অতিথিদের হয়রানি করবে না।
শর্তহীন কৃপা:
মহাপ্রভু সকলের প্রতি যত্নশীল ছিলেন এবং কোনো বিচার ছাড়াই কৃপা বিতরণ করতেন। এই বিষয়টি একটি উপমার মাধ্যমে বোঝা যায়: সূর্যের আলো যেমন ধনী-গরিব, ভালো-মন্দ নির্বিশেষে সবার উপর সমানভাবে পড়ে, ঠিক তেমনি মহাপ্রভুর কৃপা কোনো ভেদাভেদ না করে সকল জীবকে আলোকিত করে। তাঁর কাছে উচ্চবর্ণ বা নিম্নবর্ণ, ধার্মিক বা পাপি—সকলেই সমান ছিল। তিনি জগাই-মাধাইয়ের মতো মহাপাপীকেও প্রেমভক্তি দান করেছিলেন, যা তাঁর শর্তহীন করুণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
স্নেহ এবং যত্ন:
মহাপ্রভু সকলকে স্নেহ করতেন এবং যত্ন নিতেন। এর উপমা হলো একটি মাতৃমূর্তি। একজন মা যেমন তার সন্তানের ভালো-মন্দ দিক বিচার না করে কেবল ভালোবাসার টানে তার যত্ন নেন, মহাপ্রভুও ঠিক তেমনি তাঁর ভক্তদের এবং সকল জীবের প্রতি পরম স্নেহে ভরা ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক ছিলেন না, বরং এক পরম পিতা বা মায়ের মতো সকলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
প্রকৃত বৈষ্ণবের পরিচয়:
গুরুমহারাজ স্পষ্ট করে বলেছেন যে যারা সন্ন্যাসী বা অতিথিদের হয়রানি করে, তারা কখনোই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রকৃত অনুসারী হতে পারে না। এই বিষয়টি একটি উপমার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়: একজন ডাক্তার যদি রোগীকে ওষুধ না দিয়ে আরও কষ্ট দেয়, তবে সে যেমন প্রকৃত ডাক্তার নয়, তেমনি একজন ব্যক্তি যদি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনুসারী হওয়ার দাবি করে অথচ সন্ন্যাসী ও অতিথিদের প্রতি দয়া দেখায় না, তবে সে প্রকৃতপক্ষে তাঁর শিক্ষা অনুসরণ করছে না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা হলো অহিংসা, বিনয়, এবং সর্বজীবের প্রতি করুণা। একজন প্রকৃত বৈষ্ণব তাই কখনো কারো প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করতে পারে না।
শাস্ত্রীয় প্রমাণ এবং উপমা সহ আলোচনাঃ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা: শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতার (৯/২৯) শ্লোকে বলেছেন,
"সমোহহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোঽস্তি ন প্রিয়ঃ।
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্।।"
এর অর্থ হলো, আমি সকল জীবের প্রতি সমভাবাপন্ন, আমার কেউ বিদ্বেষের পাত্র নয় বা প্রিয়ও নয়। কিন্তু যারা ভক্তি সহকারে আমার উপাসনা করে, তারা আমাতে থাকে এবং আমিও তাদের মধ্যে থাকি।
এই শ্লোকটি মহাপ্রভুর শর্তহীন কৃপার ধারণাকে সমর্থন করে। মহাপ্রভু কৃষ্ণেরই করুণা-অবতার, তাই তাঁর আচরণ কৃষ্ণেরই সমান। তিনি সব জীবের প্রতি সমান দৃষ্টি রাখলেও, যারা তাঁর প্রতি ভক্তি দেখায়, তাদের প্রতি তিনি বিশেষ কৃপা বর্ষণ করেন। এটি একটি উপমার মাধ্যমে বোঝা যায়: একটি পুকুরের পানি সবার জন্য উন্মুক্ত হলেও, যে ব্যক্তি পুকুরে নেমে স্নান করে, সে-ই তার শীতলতা উপভোগ করতে পারে।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত:
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো জগাই-মাধাইকে উদ্ধার করা। তারা দুই ভাই ছিল অত্যন্ত পাপি ও দুশ্চরিত্র। একসময় তারা নিত্যানন্দ প্রভুকে আঘাত করলে, মহাপ্রভু ক্রোধে সুদর্শন চক্র আহ্বান করেন। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভু তাদের পক্ষ নিয়ে মহাপ্রভুর কাছে করুণা ভিক্ষা করেন। মহাপ্রভু তখন শান্ত হয়ে তাদের প্রতি কৃপা করেন। এই লীলা থেকে বোঝা যায় যে মহাপ্রভু পাপীকে ঘৃণা করেন না, বরং পাপকে ঘৃণা করেন এবং সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ দেন। এটি যেন এক বিশাল বটবৃক্ষের মতো, যা তার ছায়ায় আশ্রয় নেওয়া সকল পথিককে সমানভাবে শীতলতা দেয়।
তৃণাদপি সুনীচেন শ্লোক:
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বিখ্যাত 'শিক্ষাষ্টক'-এর একটি শ্লোক হলো:
"তৃণাদপি সুনীচেন তরোরপি সহিষ্ণুনা।
অমানীনা মানদেন কীর্তনীয়া সদা হরি।।"
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তৃণ থেকেও নীচ, তরুর চেয়েও সহিষ্ণু, নিজেকে মানহীন মনে করে এবং অন্যকে সম্মান দেয়, সেই ব্যক্তিই সর্বদা হরিনাম করতে পারে।
এই শ্লোকটি গুরুমহারাজের উক্তির সারসংক্ষেপ। একজন প্রকৃত বৈষ্ণব এই গুণের অধিকারী হয় এবং কখনো সন্ন্যাসী বা অতিথিদের হয়রানি করতে পারে না, বরং সকলের প্রতি বিনয় ও সম্মান প্রদর্শন করে।
বাণীর সারসংক্ষেপঃ
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর করুণা ছিল সার্বজনীন এবং শর্তহীন। তিনি কোনো বিচার ছাড়াই সকল জীবের প্রতি স্নেহ ও কৃপা বিতরণ করতেন। তাই তাঁর প্রকৃত অনুসারী তারাই, যারা মহাপ্রভুর এই করুণা ও যত্নশীলতার আদর্শকে নিজেদের জীবনে ধারণ করে। যারা সন্ন্যাসী, অতিথি বা যেকোনো জীবের প্রতি হয়রানিমূলক আচরণ করে, তারা কখনোই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রকৃত শিক্ষা অনুসরণ করে না। প্রকৃত অনুসারীর প্রধান লক্ষণ হলো বিনয়, করুণা এবং সকলের প্রতি সম্মান।