05/08/2025
৩৫শে জুলাই ইসিবি চত্বরের আন্দোলন সফল করে সন্ধ্যার পূর্বেই আমরা সবাই ঘরে ফিরে আসলাম। ইতোমধ্যে, লং মার্চ টু ঢাকার ঘোষণা হয়ে গেছে। শুধুমাত্র ওয়াইফাই চলার দরুন মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় আমরা সেটা বাসায় এসে জানতে পারলাম। রাতটা ছিলো এক গভীর উৎকন্ঠাময়।
৩৪শে জুলাই আন্দোলন শেষে বাসায় এসে জানতে পারি স্থানীয় আওয়ামী লীগ দোসর আমার সম্পর্কে আমার মাকে জিজ্ঞেস করেছে। সেটাও ছিলো আমার পরিবারের জন্য একটা আতঙ্ক। বুঝতে পেরেছিলাম হয়তো এই স্বৈরাচার থাকবে নয়ত আমরা। পিছু হটবার সুযোগ নেই।
৩৩ শে জুলাই, সকালে আন্দোলনের জন্য ইসিবি রওনা হই, কালশী মোড়ে অবস্থান দেখতে পারি ছাত্রলীগের কুত্তাগুলোকে। ভয় আর সাহস দুটোই নিয়ে রিকশা নিয়ে রওনা হই ইসবি, ইসিবি অনলাইন সড়কের নিকট পৌঁছে দেখি হায়নাগুলো ইসিবি চত্বরে দখল নিয়েছে আর ছাত্রদের ধাওয়া করছে। বেশ কিছু ছাত্র ইতোমধ্যে মারও খেয়েছে। আমি অনলাইন সড়ক হয়ে চলে গেলাম মাটিকাটা। সেখানে দেখতে পেলাম আরও বেশ কিছু ছেলেমেয়ে একত্রিত হচ্ছে। সংখ্যায় কম হওয়ায় আমরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম। আসার সময় এক মধ্যবয়সী আঙ্কেল আমাদের ডাক দিয়ে বললো - খালি হাতে ওদের সাথে পারবা না এদিকে আসো, ওনার বাড়ির কনস্ট্রাকশানের কাজ চলছিলো তারই কিছু লাঠি আর কাঠ ছিলো মেইন গেটটা আমাদের জন্য খুলে দিয়ে বললেন এখান থেকে লাঠি নিয়ে যাও। একটাকেও ছারবে না ওদের। এরই মধ্যে আমার বাবার ফোন, তিনি এক কারণবশত আমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। সব কিছু বন্ধ করে দেয়ায় ঢাকা আসতে পারেননি। ফোন দিয়ে বললেন আমি যেনো বাসায় থাকি বাহিরে না যাই। আব্বুকে মিথ্যা বললাম আচ্ছা যাবো না। এর ঠিক আগের রাতের ভয়াবহতা দেখে আম্মুও বলেছিলো আর যাবার দরকার নেই। আম্মুকে শুধু বলেছিলাম যেই ছেলেমেয়েগুলো মারা গেছে তারাও কারো সন্তান। তাদেরও বাবা মা আছে। কিভাবে চুপ থাকি? আম্মু আর কিছু বলেনি সেদিন। বলেছিলাম দোয়া কইরো আমাদের জন্য, তোমাদের দোয়াই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আম্মু বললেন দোয়া সবসময়ই তোদের জন্য থাকে। সাবধানে থাকিস।
৩৫ জুলাইয়ের রাতটা যেমন ছিলো ভয়ানক আর আতঙ্কের তার চেয়েও বেশি কাজ করছিলো সাহসের। সাধারণত রক্ত দেখলে আমি ভয় পাই। কিন্তু জানিনা আন্দোলনের দিনগুলোকে এই অজানা সাহস কিভাবে আসলো। তখন শুধু একটা কথাই মনে বেজেছিলো - মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু।
ঘুমহীন সারারাত আর গুজবের ফেসবুক ছিলো পতনের পূর্ব বিনোদন।
৩৬শে জুলাই সকাল ৯/১০ টার দিকে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা আজ বের হবোই হয় আমরা মরবো না হয় ওরা। কিন্তু আব্বু তার আগপরদিন কাটালাইনে ঢাকা এসে পরলেন। আমাকে বের হতে দিলেন না। আমাদের বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে বের হয়ে গিয়েছে। কিছু সময় পর খবর পেলাম ১০ নাম্বারে সেনাবাহিনী গুলি ছুড়ছে, ভয়টা যেনো আরেকটু বেড়ে গেলো। তারও অল্প সময় পরেই জানতে পারলাম ১০ নাম্বার সেনাবাহিনী ছাত্রজনতার পক্ষে দাড়িয়েছে। আঁচ করতে পারলাম হাসিনার পতন অনিবার্য।
সময় সকাল ১১ টা, হঠাৎ করেই আবারও ইন্টারনেট ডাউন। ভয়টা যেনো আবারও বাড়লো, ইন্টারনেট বন্ধ করে না জানি কত হত্যা করবে এবার। বাসায় আব্বু আম্মুকে বোঝাতে শুরু করলাম আমি বের হবো যাবো। অনেক কষ্টের পর তাদের বুঝিয়ে বের হলাম। আমি আর আমার এলাকার একটা বন্ধু দুজন বের হলাম। উদ্দেশ্য গণভবন। আরও কিছু বন্ধু যোগ হলো পথিমধ্যে। যাওয়ার পথেই সেই কাঙ্ক্ষিত খবর, খুনি হাসিনা পালিয়েছে ।
সেই মুহুর্ত টা হয়তো বলে বোঝাতে পারবো না! খুশিতে কান্না পাচ্ছিলো সেদিন। মানুষ ঘরথেকে পাখির মতো ছুটে বের হলো। সবার হাতেই দেশের পতাকা। বাংলার কোনো রাজপথ সেদিন ফাঁকা ছিলো না। ছিলো না আর কোনো আতঙ্ক। ছিলো শুধু একটাই দ্রোহ, স্বদেশপ্রেম। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার মুখেই ছিলো আনন্দের স্লোগান -
"পলাইছে রে পলাইছে, খুনি হাসিনা পলাইছে"
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!
মো. রফিকুল ইসলাম
ব্যাচ - ২০২৩