01/08/2025
কয়দিন ধরে বউটা বায়না ধরেছে শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্য। আমি তাকে সুন্দর মত বুঝিয়ে বললাম, কাছেই তোমার ছোট বোন থাকে, তাকে নিয়ে গিয়ে কিনে আনো। বিল যা আসে আমি দিয়ে দিবো।'
কিন্তু না, সে সোজাসুজি বলে দিয়েছে, হয় আমাকে তার সাথে যেতে হবে,নয়তো অনলাইন থেকে সে নিজে পছন্দ করে কিনে নিবে।'
এই একটা জায়গাতে বউ আমাকে দূর্বল করে দেয়। আমার আবার অনলাইনে জিনিস কেনাতে বেশ এলার্জি।
হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে, দু পাঁচটা দোকান ঘুরে ঘুরে জিনিস কেনার মত মজাটা ঠিক অনলাইনে কেনাকাটাতে আসেনা।
দেখাবে একটা আর দিবে আরেকটা,সে আরেক ঝামেলা। তখন রাতদিন আমারই কানের গোড়ায় ঘ্যানঘ্যান করবে,চেঞ্জ করিয়ে নেওয়ার জন্য, বরং সেই ভালো আমি নিজেই যাবো।
যেই ভাবনা সেই কাজ,শুক্রবারের এক বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম বউটাকে নিয়ে।
কয়েকটা দোকান ঘুরাঘুরি করেও স্ত্রীর মনপছন্দ শাড়ির হদিস মিললো না। এখন বড্ড বিরক্ত লাগছে,কোন কুলক্ষণে যে সেদিন দু পাঁচটা দোকান ঘুরার কথা মুখে এনেছিলাম কে জানে।
এদিকে পায়চারী করতে করতে পায়ের অবস্থা নাজেহাল।বোবা কান্নায় পা জোড়া হাত জোড় করে বলছে, 'রেহাই দে ভাই এবারের মত।
ঠিক করলাম,এবার যেই দোকানে ঢুকবো খারাপ ভালো যাই-ই হোক বলবো,'তোমাকে খুব সুন্দর মানাবে এইটাতে। নিয়ে নাও।'
মেয়েরা আবার কমপ্লিমেন্ট শুনতে বেশ পছন্দ করে। করলামও তাই,দোকানী কয়েকটা শাড়ি বার করতেই আমি এক এক করে বউয়ের কাধের উপরে রেখে বললাম,'বাহ্ অপরুপ। খুব সুন্দর মানাবে তোমাকে। কোনটাতে নীলাঞ্জনা,কোনটাতে সুচিত্রা আবার কোনটাতে মাধবীলতার সাথে তুলনা করে বেছে বেছে তিনটা শাড়ি পছন্দ করে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম,'এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।
দোকানির ঠোঁটে ধূর্ত হাসি ফুটে উঠেছে। তিন তিনটা শাড়ি নির্ঘাত এবার আকাশ ছোঁয়া দাম হাঁকিয়ে বসবে!
হলোও তাই,দোকানী একটা চওড়া হাসি দিয়ে শাড়ি তিনটা প্যাক করার পর যখন দাম বললো,তা শুনে তো আমার দেহ থেকে প্রাণ ভোমরা বের হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা।
তিনটা শাড়ির দাম ত্রিশ হাজার টাকা! দাম শুনে ব্যাগ থেকে শাড়ি তিনটা বার করে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে বললাম,'শাড়ির সুতো গুলো কি ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড়ের তৈরী?'
দোকানদার হেসে বললো, -'না স্যার। একদম খাঁটি ক্যাট সুতো দিয়ে তৈরী।'
'তাহলে কি শাড়ি তাঁতে বোনার সময় স্বর্নের পানির ভিতরে চুবিয়ে রাখা হয়েছিলো?'
'আরে কি যে বলেন না আপনি।'
'তাহলে এত দাম কেন ভাই? এমন ফ্যাতফেতে শাড়ির দাম এত হয়? এত দাম বলে গরীবের হার্টের প্রবলেম কেন বাড়াচ্ছেন মিছামিছি?'
'দাম বেশি চাইনি তো,জিনিস যেটা ভালো দাম তো তার একটু বেশিই হবে। ভাবিসাব দোকানের সবচাইতে রেয়ার শাড়ি তিনটায় পছন্দ করেছেন। দাম তো একটু বেশি হবেই।
চাইলে আপনি আশপাশের দোকান যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারেন। যদি কমে পান,তাহলে আমি তিনটা শাড়ি ভাবিকে ভালোবেসে গিফ্ট দিয়ে দিবো।'
এই সেরেছে রে,আজকাল এমন ফ্রি ভালোবাসা দিলে তো ঘরে বউ রাখা মুসকিল হয়ে যাবে। খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,'সব রসুনের …... এক। এই কথাটা নিশ্চয় শুনেছেন?'
'হ্যাঁ।'
'তাহলে আর অন্যকোথাও যাচাই-বাছাই করে কাম নেই।আপনি কমে কত পারবেন সেইটা বলেন?'
আমাদের দুজনের বাক বিতর্ক এতক্ষণ চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলো আমার স্ত্রী। ঠিক চুপচাপ নয়, ও মনোযোগ দিয়ে আরেকটা শাড়ি পছন্দ করছিলো তাই আমাদের দিকে এতক্ষণে ধ্যান দেয়নি।
শাড়ি রেখে এসে দোকানিকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠলো, 'আপনাদের দুজনের দাম-ই থাক। আমি একটা দাম বলি?'
দোকানদার বুক ফুলিয়ে বললো, 'এইতো এতক্ষণে বিচক্ষণ মানুষ পেয়েছি। হ্যাঁ ভাবি আপনিই বলুন।'
বউ কিছুক্ষণ শাড়ি তিনটার দিকে তাকিয়ে থেকে অকপটে বলে দিলো, 'একদাম তিনটা শাড়িতে পাঁচ হাজার টাকা দেবো।'
দাম শুনে আমি তো বাকরুদ্ধ সাথে দোকানী নিজেও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছে।
কোথায় নানির বাড়ি আর কোথায় মিষ্টি চাইছে? ত্রিশ হাজারের জিনিস সোজা পাঁচ হাজার! ভাবা যায়। লজ্জায় আমি দোকানির দিকে পিছন ঘুরে দাঁড়ালাম।
দাম শুনে তো লজ্জায় 'ছেড়ে দে মা সম্মান বাঁচাই'এমন একটা অবস্থা। এমন দাম তো আমি কল্পনাতেও আনতে পারবো না। আর আমার বউ সোজাসাপ্টা বলে দিলো! ইচ্ছা করছে এই লজ্জা ঢাকতে বউয়ের জন্য পছন্দ করা শাড়িগুলো দিয়ে নিজের আপাদমস্তক ঢেকে ফেলি।
দোকানি এবার খানিকটা অসহায়ত্ব দেখিয়ে বললো,'ভাবি এইটা কোনো কথা বললেন! আপনাকে তো বিচক্ষণ ভেবেছিলাম। এই দামে এত সুন্দর বাহারি কাজ করা শাড়ি পাবেন আপনি? আপনি বরং তিনটা শাড়ি মিলিয়ে ২০ হাজার দেন।'
বউয়ের এক দামে দোকানিকে বুর্জ খলিফার আপার ফ্লোর থেকে মিড ফ্লোরে নেমে আসতে দেখে আমি তো অবাক।
একবারে ত্রিশ থেকে সোজা বিশ!
কিন্তু বউ আমার এক কথার মানুষ,সে তার দামে অটল। দোকান ভেঙ্গে যাবে তবুও সে ভাঙবে না।
দোকানী এবার উল্টো কাউন্ট করা শুরু করলো। ভাবি ১৯,১৮,১৭,১৬,১৫ হাজার, ম্যাডাম একদাম ১৩ হাজার এর নিচে আর পারবো না।
কিন্তু তখনো দেখলাম আমার বউ তার জবানে অটল। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। উঠবেই না আর।
এদিকে দোকানদার মশাই সিড়ি বেয়ে, না সিড়ি নয়,লিফ্টের মত দাম নিচে নামিয়ে চলেছে তরতর করে।
দুজনের দরদাম দেখে মুখ চেপে হাসছি আমি।
কোথায় সাবেদ আলী আর কোথায় জুতোর কালি? এতো দেখি আস্ত চোরাকারবারি। এবার ঠেলা সামলাও বৎস। খুব তো বিচক্ষণ দেখতে চেয়েছিলে।
দোকানদার এবার আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,'ভাই আপনারা আমার প্রথম কাস্টমার।
জুম্মার নামাজ পড়ে প্রথম কাস্টমার ফিরিয়ে দিলে দোকানের অমঙ্গল হবে। আপনি কিছু একটা করুন।'
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,'ভাই বউয়ের মুখের উপর কথা বলিয়ে কেন আমার জীবনটা বিপদে ফেলতে চাইছেন? তখন তো নিজেই ডেকে নিলেন বিচক্ষণ বলে। এখন নিজেই সামলান।'
তারপরও হাজার হলেও পুরুষ তো,একই জাত।
খারাপ লাগলো খানিকটা। বউয়ের দিকে তাকাতেই বউ হাত ধরে বললো,'চলো অন্য দোকানে যাব,শাড়ির কি অভাব পড়েছে নাকি?'
কথাটা বলেই আমার হাতটা ধরে হিড়হিড় করে বেরিয়ে যাওয়া ধরতেই দোকানদার পিছন থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো,'ভাবি দুজনের দামই থাকুক,নিজের ছোট ভাই ভেবে দশ হাজারটা টাকা দিয়েন।'
আমার বউ তাতেও সন্তুষ্ট নয়। চোখ মুখ শক্ত করে বললো,'দ্যাখেন আমি দরদাম একদমই পছন্দ করিনা। আপনি যখন বড় বোন বলে ডেকেছেন,দরকারে ছোট ভাই হিসাবে আপনাকে আমার বাসায় দাওয়াত করে পোলাও মাংস,বোরহানি খাওয়াবো। তারপরও আমি এর বেশি একটা টাকাও উঠতে পারবো না।'
দোকানিও ছাড়বার পাত্র নয়,সেও ধরে বেঁধে লেগেছে।যেভাবেই হোক শাড়ির ব্যাগটা সে আমার বউয়ের হাতে দিবেই দিবে। মুখে নির্বোধের হাসি হেসে বললো,
'ভাবি লাস্ট একটা দাম বলি,'আট হাজার,আর না করবেন না। শাড়িগুলো ভালো মানের। অন্যসময় আসলে তিনটার দাম দশ হাজারের এক পয়সাও কমে দিতাম না। বৌনির কাস্টমার,ফিরাবো না তাই দিয়ে দিচ্ছি।'
বউ এবার ঠোঁট কেটে বললো,'ওমা তাই,বৌনির কাস্টমার ফেরালে কি দোকানের মালে পোকা ধরে? যত্তসব। এইসব ভুজুংভাজুং অন্যদেরকে বুঝাবেন। আমি যে দাম বলেছি ঐ দামে হলে দিন,নয়তো দোকানের অভাব নেই। আর শাড়িগুলো আমার এতটাও জরুরী নয় যে ওগুলো নিতেই হবে।'
দুজনে বেরিয়ে যাবো,দোকানদার আমার হাতটা ধরে ফেলে বললো,'ভাই আপনি আমার ভায়ের মত,আর দরদাম কইরেন না। লাস্ট সাত হাজার দিয়ে নিয়ে যান।'
দুজনের দর কষাকষিতে আমি পড়লাম বিপাকে। দোকানির উপর যেমন মায়া লাগছে,তেমনি বউয়ের মুখের উপরেও কথা বলার সাহস পাচ্ছিনা।
বউ এবার চোয়াল শক্ত করে বললো,'আমি একটা লাস্ট দাম বলছি,দিলে দিবেন না দিলে নাই। একদাম ছয় হাজার দিবো। যদিও লস হয়ে যাচ্ছে।'
'ম্যাডাম অনেক লস হয়ে যাবে,আর পাঁচশত টাকা বাড়িয়ে দিন। চা খাওয়ার জন্যই দিন। আর না করবেন না।'
বউ কিছু বলার আগে আমি নিজে এগিয়ে গিয়ে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম,' খুঁজুন না আরও বিচক্ষণ। আমি হলে বিশ হাজারেই মামলা চুকে যেতো। বিচক্ষণ খুঁজতে গিয়ে খেলেন তো বাঁশ।'
তারপর শাড়ির ব্যাগটা নিয়ে আসতেই বউ হাত চিমটে মুখ ভেঙচিয়ে বললো,'তুমি না,সবসময় বেশি বেশি করো।
আমি দিলেও খুব জোর একশত টাকা দিতাম।
এর একটা টাকাও বেশি দিতাম না।
দিলে তো পনেরো শত টাকা লস করিয়ে। এমনিতেই বেশি দাম বলে ফেলেছি।'
বউয়ের কথাগুলো শুনে বুকে ফু দিয়ে নিজের মনেই বললাম,এতদিন হুদাই বউকে বকাবকি করে এসেছি টাকা অপচয় করার জন্য। আশিক তুই জিতছিস ভাই,তুই জিতছিস। এমন জোহর কয়জনার কপালে জুটে।'
সামনে বার যদি একটা সেন্ডো গেঞ্জিও কিনি,তারপরও বউকে নিয়ে যাবো। দরকার পড়লে বউকে এক হাজার টাকার শাড়ি কিনে দিবো,তারপরও নিয়ে যাবো।বহুত ঠকেছি আর ঠকা যাবেনা।
খায়লে ঘরের মানুষ খাক,পরে কেন খাবে? এ্যাঁহ্।