28/10/2025
#বুকের_ভেতর_বৃষ্টি (৩)
#শারমিন_প্রিয়া
ভাই, আব্বু আর আমার ছোট্ট সংসার সুন্দরভাবে চলতে লাগল। রান্নাবান্না তেমন একটা পারি না আমি। আব্বু অফিস যাওয়ার সময় রান্না করবেন, আবার ফিরে এসেও রান্না করবেন। এটা খারাপ দেখায়। আমি জোর করে টুকটাক রান্না করি, অনেক সময় হাত-পা পুড়িয়ে ফেলি। যখন যা পারি না, ইউটিউবের সাহায্য নেই। এসব করতে করতে মোটামুটি হাতের মুঠোয় চলে আসে রান্না।
তায়েফ নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমিও একই কলেজে। আজকাল কলেজে যেতে লজ্জা করে আমার, শুধু এই পোড়া মুখটার জন্য। যখন না গেলে উপায় থাকে না, তখন যাই, তাও মুখ ঢেকে। মাঝেমধ্যে ভাবি, অনেকে সস্তা ডায়লগ দেয়, “চেহারা দিয়ে কিছু হয় না, মনের মিল’ই আসল।” আসলে এটা শুধু সান্ত্বনামূলক কথা। চেহারা ভালো না থাকলে সবাই ইগনোর করে। ভালোবাসার মানুষটাও ফেলে যেতে দুবার ভাবে না। আমি তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
বয়স বাড়ছে আমার। এখন আর ভুলেও বিয়ের প্রস্তাব আসে না। এসব নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগি আমি। তায়েফ ছাড়া সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। বাবা কম কথা বলেন। আম্মু থাকলে হয়তো ভরসার হাত পেতাম। জানি না আম্মু কেমন আছেন, উনার কি আমাদের কথা মনে পড়ে? কে জানে, হয়তো পড়ে, নয়তো না। শুনেছি, চাকরি সূত্রে আম্মু অন্য বিভাগে গিয়েছেন। কোথায় গেছেন, কে জানে?
আম্মুর মুখটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমার। হাত বুলাতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় আম্মু তায়েফ আর আমাকে দুপাশে রেখে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন। আমরা চুপটি করে আম্মুর বুকে শুয়ে থাকতাম। ইদানীং মন খারাপের রাতগুলোতে ছোটবেলার মতো আম্মুর বুকে চুপটি করে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
আশপাশের মানুষ এখন নানা কথা বলে। “এই মেয়ের আর বিয়ে হবে না! এই মুখ দেখে কেইবা বিয়ে করবে!” তাদের কথা শুনতে শুনতে আমার মাইগ্রেন হয়েছে, তাও তারা মুখ বন্ধ করে না। দেখলেই এসব বলে। কান্না চলে আসে আমার। ফিরে কিছু বলার সাহস হয় না। তায়েফ এসব শুনলে মারামারি লাগবে একশো পার্সেন্ট।
একদিন আব্বু আমাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেলেন। রাতে দেখি কয়েকজন মহিলা আর একজন পুরুষ এসেছেন। নতুন মা বললেন, আমাকে নাকি তারা দেখতে এসেছে। আমি অবাক হলাম, আমাকেও কেউ দেখতে এসেছে? আমারও সত্যি বিয়ে হবে?
নতুন মা জানালেন, যারা দেখতে এসেছে তারা উনার আত্মীয়। যে ছেলেটা এসেছে, তার আগের পক্ষের স্ত্রী আছেন— সেই স্ত্রী সাথেই এসেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “স্ত্রী থাকা স্বত্ত্বেও বিয়ে কেন করবেন?”
বললেন, “দশ বছর হয়ে গেছে বিয়ের, বাচ্চা-কাচ্চা নাই। পুরনো জমিদার বংশধর। বংশের হাল কে ধরবে?” যতটা খুশি হয়েছিলাম, ততটাই নিভে গেলাম। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্যই তাহলে বিয়ে করবে। আমার কপালে এ ছাড়া আর কিইবা থাকতে পারে!
আমাকে শাড়ি পরিয়ে তাদের সামনে নেওয়া হলো। নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। পোড়া মুখ নিয়ে তাকাতে অস্বস্তি হচ্ছিল। কেউ একজন বলল, “তাকাও আমাদের দিকে।” আমি তাকালাম।
একজন হাসিমুখে বলল, “পছন্দ হয়েছে, এই মেয়েই ফাইনাল।”
পাশ থেকে আরেকজন আমাকে বলে দিল, “এই হচ্ছে তোমার বরের আগের পক্ষের স্ত্রী, নাম রহমা।”
রহমা! উনিই নাকি আমাকে পছন্দ করেছেন, আর সবাইকে বলেও দিয়েছেন। উনি নিশ্চয়ই বেশ চালাক আর জেলাসি টাইপের হবেন। বরের জন্য খুঁজে খুঁজে এসিডে পোড়া মেয়েটাকেই চয়েস করেছেন। তার কারণ, আমার প্রতি তার স্বামীর আকর্ষণের কোনো কারণ নেই। কোনো পুরুষই আমাকে দেখে ক্রাশ খাবে না।
আমি রহমাকে আড়চোখে দেখলাম, উনি হাসছেন ঠিকই, কিন্তু চাপা কষ্ট উনার চোখেমুখে লুকিয়ে আছে। পাশে উনার স্বামী গম্ভীর মুখে বসে আছেন। উনি আমার দিকে একবারও তাকাননি। রহমা যা বলবে, সেটাই হয়তো ফাইনাল।
আমার বিয়ে ফাইনাল হলো। পরের সপ্তাহেই বিয়ে। তায়েফকে বললাম, “যাবি না আমার সাথে।”
সে একগাল হেসে বলল, “তখন ছোট ছিলাম, বুঝিনি। বোনের শ্বশুরবাড়িতে থাকাটা কেমন যেন দেখায়। মন চাইলে তোমাকে দেখে আসব। সাবধানে থাকবে তুমি, নিজের যত্ন নিও। আর আমি তো আছিই।” তায়েফ এমনভাবে কথা বলে যে মন ভালো হয়ে যায়।
বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা দিলাম। আমার স্বামী রাহাত। উনি পুরো রাস্তায় বা বাড়িতে এসেও একবারও কথা বলেননি আমার সাথে। আমাকে আমার ঘরে রাখা হলো। দীর্ঘসময় পর রাহাত ঘরে এলেন। গুমড়ো মুখে হাঁটাহাঁটি করছিলেন ঘরে। আমিও চুপচাপ বসে আছি। আধঘণ্টা পর উনি খাটে বসে বললেন,
“তুমি নিশ্চয়ই জানো এই বিয়ের কারণ। আসলে আমি বিয়ে করতে চাইনি। মা জোর করে বিয়ে দিয়েছেন, বাচ্চার জন্য। নিরুপায় হয়ে করেছি।”
আমাদের মধ্যে মিলন হলো। মাস দুই পার হয়ে গেল, কনসিভ করিনি আমি। শাশুড়ি বকাবকি শুরু করলেন। নানা রকম কথা শুনতে হয়। তখন রহমা খুব সাপোর্ট করতেন আমাকে, শাশুড়িকে বুঝাতেন যেন বকাবকি না করেন।
আমি গর্ভবতী না হলেও রহমা হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে গেলেন। তারা যে কী পরিমাণ খুশি হল, তাদের খুশি দেখে আমারও ভালো লাগল। নতুন মেহমান আসার আনন্দে গরু জবাই করে রাহাত আর তার পরিবার পুরো এলাকায় খাওয়ালো।
পরে রাহাত আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইলেন। কারণ, আমি বাচ্চা দিতে পারিনি। “শুধু শুধু বউ হয়ে কেন থাকব” -তাদের মাথায় বোধহয় এটাই চলছিল। শাশুড়িও ভালো চোখে দেখেন না আমায়।
এই খবর শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। এমনিতেই আমি কলঙ্কিনী, তার উপর বাচ্চা জন্ম দিতেও ব্যর্থ। এখন ডিভোর্স হলে কোথায় মুখ লুকাব আমি? এত পোড়া কপালী হয়ে কি বাঁচা যায়?
রহমার ব্যবহার সবসময় আমার প্রতি স্নেহপূর্ণ ছিল। উনি কখনো কিছু বলেননি। আমি উনার পায়ে পড়ে বললাম, “আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না দয়া করে। আমি স্বামীর সঙ্গ না পেলেও এই পরিচয়ে থাকতে চাই।”
রহমা আমাকে ধরে তুললেন, “ছিঃ, ছিঃ! তুমি আমার পায়ে পড়ছ কেন, মারিয়া? কে বলেছে তোমায় ডিভোর্স দেবে? আমি রাহাতকে বুঝাব, সে তোমায় ছাড়বে না। তুমি আজন্ম রাহাতের বউ হয়ে থাকবে এখানে। কান্নাকাটি বন্ধ করো।”
রহমার কথা রাহাত শুনলেন। তিনি আমাকে ডিভোর্স দিলেন না। তবে সম্পর্কও গড়ে উঠল না। তিনি থাকেন রহমার ঘরে, আমি আমার ঘরে।
শাশুড়ির চোখে আমি বিষ। কোনো ঝগড়া না করেও উনি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না।
এভাবেই দিন যেতে লাগল। তায়েফরা সবাই ভাবে আমি খুব ভালো আছি। শুধু আমি জানি—স্বামী থাকা সত্ত্বেও স্বামীর সঙ্গ না পেয়ে ভেতরে ভেতরে কতটা মরে যাচ্ছি।
রহমা আপুর বাচ্চা হলো। সবার মতো আমিও খুশি। ছোট ছোট হাত-পা, নাড়লে ভীষণ কিউট লাগে। আমি বারবার তাকে কোলে নিই, রহমা আপু বারণ করেন না। কি আদুরে বাচ্চা! আলাদা একটা টান তৈরি হলো তার প্রতি।
বাবুর ছয় মাস যেতে না যেতেই রহমা আপু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গলায় প্রচণ্ড ব্যথা। ডাক্তার দেখিয়ে কোনো লাভ হলো না। অবশেষে ঢাকায় গিয়ে জানা গেল, রহমা আপুর গলায় ক্যান্সার।
এই খবর শুনে সবাই ভেঙে পড়ল। রাহাত তো আরও বেশি, পুরুষ হয়েও উনি শিশুর মতো কান্না করলেন।
এক রাতে আপু আমাকে একা ঘরে ডেকে নিয়ে হাত ধরে বললেন,
“আমি আমার স্বামীকে খুব ভালোবাসি। বাচ্চা না হওয়ায় শাশুড়ির যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছিল না। তারা বলেছিল, বাচ্চা লাগবে, না হলে রাহাতকে বিয়ে দিবে। আমি রাজি হইনি। তোমার নতুন মা আমার দূর সম্পর্কের খালা। একদিন উনার কাছে তোমার কথা শুনি। আমি নিজে তোমাকে দেখতে যেতে চাই। আমি কোনো সুন্দরী মেয়ে আনতে চাইনি, কারণ ভয় ছিল রাহাত পাল্টে যাবে। তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল কারণ তোমার মধ্যে সেই সৌন্দর্য নেই যা দেখে রাহাত গলবে। কিছু মনে করো না, মারিয়া, তবে এসব মন খুলে বলছি।”
মারিয়া এক সেকেন্ড থেমে আবার বলা শুরু করলেন, “তুমি এতদিন ধরে আমাদের সাথে আছো, খুব ভালো মেয়ে তুমি। তোমাকে আমি বোনের মতো দেখি। আমার ক্যান্সার হয়েছে, আমি বাঁচব না বেশিদিন। আমি শিওর, রাহাত ছাড়া একমাত্র তুমিই একজন, যে বাবুকে আদরে ভালোবাসায় রাখবে। আমার ছেলেকে তোমার হাতে দিলাম, নিজের ছেলের মতো রেখো।”
রহমা আপু কান্না করলেন, আমিও কান্না করলাম।
ধীরে ধীরে আপুর অবস্থা খারাপ হলো। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এক রাতে রাহাত আমি রহমা আপুর পাশে বসা। রহমা আপু রাহাতের হাত ধরে বিনয়ী কন্ঠে বললেন,
“শেষ একটা ইচ্ছে পূরণ করবে আমার?”
রাহাত বললেন, “কি?”
“টাকা-পয়সার তো অভাব নেই তোমার। আমি চাই, যত টাকা লাগে মারিয়ার মুখটা সার্জারি করাও, স্বাভাবিক করে দিও। আমি মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করো না, মারিয়ার সাথে সংসার করো। মারিয়া তোমাকে আর আমার মেয়েকে খুব ভালো রাখবে।”
রহমা আপু আরও শক্ত করে ধরলেন রাহাতের হাত, “প্লিজ, রাহাত, ফিরিয়ে দিয়ো না আমায়। আজই কথা বলো ডাক্তারের সাথে।”
রাহাত অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। চোখ টলটল করছিল। তারপর বললেন, “ঠিক আছে।”
রহমা আপু হাসপাতালে থাকা অবস্থায় আমার সার্জারি হলো। আমার আগের ছবি দেখে ডাক্তাররা যতটা সম্ভব আগের মতোই বানিয়েছেন। আয়নায় মুখ দেখে বহু বছর পর আমার মুখে স্বস্তির হাসি ফুটল। আমার সুন্দর চেহারা ফিরে পেয়েছি।
আমি রহমা আপুর হাত ধরে কৃতজ্ঞতার চুমু খেলাম, “তুমি না থাকলে এসব হতো না, আপু।”
রহমা আপু হাসার চেষ্টা করলেন। চিবুক ধরে বললেন, “তুই তো ভীষণ সুন্দর মেয়ে, মারিয়া। রাহাত আর দূরে থাকবে না। দেখিস, ঠিক তোকে পছন্দ করবে।”
আমি বললাম, “রাহাতকে আমার হাতে ছেড়ে দিচ্ছ, খারাপ লাগছে না আপু?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রহমা আপু, “পরিস্থিতি এমন, কি আর করব! আমি মারা যাওয়ার পর তো এমনিতেই সে বিয়ে করত। একা মরা যায়, বাঁচা যায় না। অন্য কেউ আসার চেয়ে তুই থাকবি বউ হয়ে, আমার আত্মা শান্তি পাবে, আমার মেয়ে ভালো থাকবে।”
চলমান….! (পরের পর্বেই শেষ)
পরবর্তী অংশ সবার আগে পেতে ফলো করুন 👉R.R media