27/07/2025
আজকের IELTS পরীক্ষা: একটি আশার ঝলক, নাকি গভীর ক্ষত?
আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী IELTS পরীক্ষায় বসেছে। এই ভিড় কি আমাদের জন্য একটি আশার আলো, নাকি সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক বড় সমস্যার ইঙ্গিত?
আমরা দেখছি, দেশের বেশিরভাগ তরুণই কোনো না কোনোভাবে এই দেশ ছাড়তে চাইছে। কেউ স্টুডেন্ট ভিসায়, কেউ শ্রমিক ভিসায়। অথচ আমরা সবাই জানি, বিদেশে জীবন মোটেই সহজ নয়। তবুও কেন বিদেশ থেকে একটাই আওয়াজ আসে – 'আগে বাংলাদেশ থেকে বাইর হইয়া আয়'?
ডেইলি মেসেঞ্জারের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে শুধু লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথেই আট হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। ১৭-১৮ লাখ টাকা খরচ করে যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে চান, সেই একই টাকায় কেন তারা নিজেদের দেশেই একটু কম ঝুঁকি নিয়ে থাকতে চান না? এটা কি কেবলই টাকার লোভ?
যদি শ্রমিকদের কথা বলি, হয়তো তাদের জন্য অর্থের লোভ একটি বড় কারণ। কিন্তু আমাদের দেশের মেধাবীরা কেন থাকতে চায় না?
তাদের জিজ্ঞেস করলে সরল উত্তর আসে: 'কারণ এই দেশে জীবনের নিরাপত্তা নেই, সম্মান এখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং লিগ্যাসি থেকে আসে।'
চীনের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করে আবার নিজেদের দেশে ফিরে আসে। কারণ তাদের দেশ তাদের জীবন ও সম্মান দুটোই নিশ্চিত করে। কিন্তু আমাদের দেশের মেধাবীরা উচ্চশিক্ষা শেষে আর ফিরতে চায় না। এর কারণ কী?
কারণ, এখানে জীবন ও সম্মানের নিরাপত্তা নেই। বরং উল্টো চিত্র:
* আপনার সন্তান ভেজাল খাবার খেয়ে অসুস্থ হতে পারে, এমনকি প্রাণও হারাতে পারে।
* আপনার মেয়ে বা স্ত্রী বাইরে বের হলে ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকে।
* ফিটনেসবিহীন একটি বাস যেকোনো সময় পুরো পরিবারকে চাপা দিতে পারে।
* স্কুলে পাঠানো সন্তান ঘরে ফিরতে পারে লাশ হয়ে।
* রেস্টুরেন্টে খেতে বসেও পুরো পরিবারসহ পুড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
* ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ট্রলার ডুবিতে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা থাকে।
* একজন রাজনৈতিক চামচা যেকোনো পরিস্থিতিতে যে কাউকে অসম্মান করতে পারে।
আমাদের দেশের দুর্নীতি, বিচারহীনতা এবং জবাবদিহিতার অভাব প্রতিটি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। পরিস্থিতি এমন যে, এই দেশে ঘুষ না খাওয়াটাই যেন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ! কিছুদিন আগে একজন বিএনপি নেতা ইউএনও-কে ফোন করে বলেছিলেন, '১৭ বছর পর কাজ পেয়েছি। মাতব্বরি করে ঝামেলা পাকাতে এসো না। ঝামেলা করলে ঝামেলা বাড়বে।' এমন অবস্থায় কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাই বোঝা মুশকিল।
ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে আমরা দেখি, পরিবার-পরিজন ছেড়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছে তরুণরা। ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ করে তারা বিদেশে গিয়ে Odd Job করছে। পড়াশোনা সামলিয়ে নিজেদের রান্না নিজেদেরই করতে হচ্ছে। তবুও তারা সন্তুষ্ট। অন্তত তারা নিরাপদ!
আপনার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করুন, ১৬-১৭ লাখ টাকা খরচ করে দেশে ব্যবসা না করে কেন তারা বিদেশে গিয়ে Odd Job করছে? গ্রামে অনেক নতুন উদ্যোক্তা দেখি, উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করে। কিন্তু পরের দিনই চাঁদা না দিলে পুকুরের মাছ মরে ভেসে ওঠে, লাগানো গাছ কেটে ফেলা হয়। যে কৃষি দিয়ে চীন বিপ্লব ঘটিয়েছিল, আমাদের দেশে সেই কৃষিই কৃষকের পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে।
আমাদের মেধাবী ডাক্তাররা ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া চলে যান, আর আমাদের মন্ত্রীরা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান। এমনকি ছোটখাটো সমস্যার জন্যও ভারত থেকে চিকিৎসক আনতে হয়।
কেন?
দেশে যে মেধাবীরা আছেন, তারাও আটকা পড়েছেন বিসিএস নামক এক স্বপ্নাতুর জালে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করে এই বিসিএস ক্যাডাররাই। কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে সে দেশের কৃষক ধমক দিলেও কৃষকের কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু আমাদের দেশে বিসিএস ক্যাডারকে 'স্যার' না ডাকলে বিপদ হয়ে যায়!
চীন তাদের মেধাবীদের কাজে লাগিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে দাপট দেখাচ্ছে, ইরান তাদের মেধাবীদের দিয়ে ওয়ার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর আমরা আমাদের মেধাবীদের শিখিয়েছি কিভাবে মেধাবী হয়ে সামাজিক স্ট্যাটাস বাড়াতে হয়, কিভাবে নিজের 'হ্যাডম' দেখাতে হয়। একজন ম্যাজিস্ট্রেট হলেই যেন তার চৌদ্দগোষ্ঠীর ক্ষমতা চলে আসে, যা ইরান বা আমেরিকারও নেই!
অন্যান্য দেশ যখন তাদের মেধাবীদের ফিরিয়ে আনছে, আমরা তখন আমাদের মেধাবীদের পাচার করছি। মেধাবীদের একটি ভুল সিস্টেমে ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা তাদের অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে কেন, স্বাধীনতার ১০০ বছরেও এই দেশের পরিবর্তন আসবে না। তারপর কোনো এক দুর্ঘটনার পর আবার কেউ বুক চাপড়ে বলে উঠবে, 'আমি আর এই দেশে থাকব না...!'