27/09/2024
আবু সাঈদ শিবিরকর্মী হলে আওয়ামি লিগের লাভ কী, ক্ষতি কী
আখতারুজ্জামান আজাদ
১ আগস্ট ২০২৪
২০২৪ সালের কোটাসংস্কার আন্দোলনের জের ধরে বাংলাদেশে যে আড়াই শতাধিক ব্যক্তি ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যকার প্রথমজনের নাম আবু সাঈদ। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুর দিন নিহত হয়েছে আরো ছয়জন ছাত্র। নিহতের মিছিলে প্রথম নামটি সাঈদেরই হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার ঠিকুজি নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হয়েছে। সাঈদহত্যার দৃশ্য সবারই মুখস্থ। গোটা ঘটনার ভিডিওচিত্র বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষ দেখে ফেলেছেন। রাজপথে সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তার ডানে কেউ ছিল না, কেউ ছিল না বাঁয়ে। একহাতে ছিল ছোট্ট একটা লাঠি। অন্য হাত খালি। হয়তো পুলিশকে সে বলছিল— 'সাহস থাকলে গুলি করো।' কোটাসংস্কারকে কেন্দ্র করে ২০১৮ বা ২০২৪-এর আন্দোলনে সাঈদের আগে কেউ নিহত হয়নি। ফলে, ওর হয়তো ধারণা ছিল— পুলিশ আর যা-ই করুক, ছাত্রদের বুকে গুলি করার মতো ভুল করবে না; কেননা সেরেফ একজন ছাত্রের লাশই যেকোনো দেশের যেকোনো সরকারের তখতে তাউসকে মুহূর্তে কাঁপিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সাঈদ জানত না— গণহত্যার পাণ্ডুলিপি আগেই রচিত হয়ে গেছে, কোনো এক নাট্যকার ইতোমধ্যেই লিখে ফেলেছেন নরহত্যার ন্যাক্কারজনক চিত্রনাট্য। সাঈদের বুক লক্ষ্য করে সরাসরি গুলি করা হয়েছে। প্রথম গুলির পর সাঈদ সটান দাঁড়িয়েই ছিল, দাঁড়িয়ে ছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুলির পরও; যেন কিছুই ঘটেনি, কিছুই ফোটেনি, কিছুই রটেনি ভবে। রাজপথ ছেড়ে সাঈদ পালায়নি, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেনি একটিবারও, প্রতিটি বুলেট শুষে নিয়েছে আপন কায়ার অমোঘ অভ্যন্তরে। কোনো এক সহযোদ্ধা এগিয়ে এসেছিল সাঈদকে ধরাধরি করে হয়তো হাসপাতালে নিতে। সাঈদ রাজপথে লুটিয়ে পড়ল। আর কখনোই দাঁড়ায়নি সে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ ছোট্ট একটা রশিদ ইশু করে, যাতে সাঈদের মৃত্যুর খবর খচিত ছিল। একই দিনে দেশে আরো ছয়জন নিহত হলেও সাঈদের আত্মাহুতির এই দৃশ্যই এই ইশুতে রাষ্ট্রকে প্রথমবারের মতো স্তম্ভিত করে এবং এর পরের ইতিহাস সবার জানা। লাশের পরে লাশ পড়ছে। ক্ষমতাসীন দল স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো আন্দোলনে নিহত সবাইকে অস্বীকার করতে চাইবে, প্রমাণ করতে চাইবে কিছুই ঘটেনি কিংবা মৃত্যুর জন্য মৃত নিজেই দায়ী। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামি লিগের মন্ত্রিপরিষদ, অনলাইন লাঠিয়ালবাহিনী, প্রোপাগান্ডা অধিদপ্তর— একেক সম্প্রদায় ভিন্ন-ভিন্ন তত্ত্ব উপস্থাপন করে আবু সাঈদের মৃত্যুকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। একজন মন্ত্রী বলেছেন যারা নিহত হয়েছে, তাদেরকে মাদক সেবন করিয়ে নেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা প্রোপাগান্ডা ভিডিওতে দেখলাম মাদকটির নামও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে— এলএসডি। সবচেয়ে ব্যাপক আকারে যে-তত্ত্বটি ছড়িয়ে পড়েছে, সেটি হলো— সাঈদ শিবিরকর্মী ছিল; যে-পুলিশ গুলি করেছে, সেও শিবিরকর্মী। আরেক জায়গায় দেখেছি— আবু সাঈদের বুকে পুলিশ ছুড়েছে সাধারণ রাবার বুলেট, যা প্রাণঘাতী নয়; তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য আড়াল থেকে গুলি করেছে অন্য কেউ। আর সাঈদহত্যামামলার এজাহারে পুলিশ উল্লেখ করেছে— বিভিন্ন দিক হইতে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়িয়া যাইতে দেখা যায়। ক্ষমতাসীন দলগুলোর বৃহত্তম কাঁচামাল মিথ্যাচার। কারণ ওরা জানে— এদের কোটি মিথ্যাচারেরও বিচার হবে না। সত্য একটাই হয়, মিথ্যা হয় হাজার রকমের। মিথ্যা সাজানোর জন্য অজস্র রকমের তত্ত্ব হাজির করতে হয় বিধায় এক তত্ত্বের সাথে আরেক তত্ত্ব মেলে না।
সাঈদকে পুলিশ পয়েন্ট ব্লাংক গুলি করে হত্যা করেছে, এর হাই ডেফিনিশন ভিডিও আছে। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক নিষ্প্রয়োজন। এখানে প্রয়োজনীয় ইশু হলো শিবিরবিতর্ক। জঙ্গিসংগঠনগুলো ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষদেরকে হত্যা করলে সাধারণ মানুষ তাতে গা করে না, রা করে না, না করে না। ধর্মে অবিশ্বাসীদেরকে হত্যা করার একটা ব্লাংক চেক জঙ্গিগোষ্ঠীকে জনগণ দিয়ে রেখেছে। অপরপক্ষে, আওয়ামি লিগও যেকোনো অপকর্ম করে এর দায়ভার জামায়াত-শিবিরের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেক নিজেরাই লিখে নিয়েছে এবং এই চেকের পাতা ফুরোনোর নামগন্ধ নেই। আলোচ্য ঘটনায় আবু সাঈদ 'শিবির' লেখা ব্যান্ডানা পরে রাজপথে নামেনি, তার গলায় 'শিবির' লেখা প্লাকার্ডও ঝোলানো ছিল না, পোশাকেও কোথাও সাঁটানো ছিল না 'শিবির' লেখা স্টিকার। ফলে, পুলিশ যে সেদিন সাঈদকে মেরে 'শিবিরনিধন' করেছে; তা নয়। সামনে ইসকন পেলেও পুলিশ সেদিন ইসকনই মারত। একজন ব্যক্তি শিবির করলেই বা ধর্মে অবিশ্বাসী হলেই বিনা হিশাবে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেওয়ার অনাপত্তিপত্র কেউ কাউকে দেয়নি। নির্দিষ্ট মতাদর্শের কাউকে দেখামাত্র নিকেশ করে দেওয়া নিশ্চয়ই সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য না। আবু সাঈদ কোনো এককালে জামায়াতনেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিল। এর মাধ্যমে যদি প্রমাণিতও হয় সাঈদ শিবিরের কর্মী ছিল; তা-ও আওয়ামি লিগের জন্য কোনো সুসংবাদ না, বরং দুঃসংবাদ। কারণ সাঈদ জীবন দিয়েছে, আওয়ামি লিগ জীবন নিয়েছে। জীবন-দেওয়াদেরকে ইতিহাস পূজা করে, জীবন-নেওয়াদেরকে ইতিহাস আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে। আওয়ামি লিগের জন্য— সাঈদ শিবির করলেও বিপদ, সাঈদ শিবির না-করলেও বিপদ। কারণ, সাঈদকে হত্যা করেছে আওয়ামি লিগের পুলিশ। হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামি লিগ ঐতিহাসিক গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছে।
কোটাসংস্কার আন্দোলনে ২০১৮ সালেও সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন নির্মমতার পরিচয় দিয়েছে, আর ২০২৪ সালে তো রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করে নির্বিচার গণহত্যা ঘটিয়েছে। দেখা গেল— ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন হিশেবে ছাত্রলিগ বরাবরই বিগত দেড় দশকে ছাত্রদের সমস্ত ন্যায্য দাবির বিরোধিতা করেছে, সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে যেকোনো ন্যায্য ছাত্র-আন্দোলনকে বর্বরোচিত উপায়ে পিষ্ট করেছে, অরাজনৈতিক ছাত্রছাত্রীদের কাছে ত্রাস হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে, সার্বক্ষণিক ভীতি সঞ্চার করে নিজেদেরকে অরাজনৈতিক ছাত্রছাত্রীদের প্রতিপক্ষ হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। কোটাসংস্কারের দাবিটা শুধু শিবিরের ছিল না, ছিল সার্বজনীন দাবি। ছাত্রলিগেরও অধিকাংশ নেতাকর্মী ব্যক্তিগতভাবে এই দাবির পক্ষে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়ালবাহিনী হিশেবে ছাত্রলিগকে যেহেতু ছাত্রদের যেকোনো গণদাবির বিরুদ্ধে রুটিনমাফিক দাঁড়াতে হয়, সেহেতু ছাত্রলিগ এই যাত্রায়ও শিবিরদমনের ধুয়া তুলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়েছে এবং গণঘৃণা উৎপাদন করেছে। ছাত্রলিগ যখন রাষ্ট্রের সমস্ত বেসামরিক-আধাসামরিক-সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় টিকে থাকতে পারেনি, বরং রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সটকে পড়েছে; তখন আবু সাঈদরা সটান সিনা নিয়ে দুই হাত দুই দিগন্তে প্রসারিত করে সশস্ত্রবাহিনীর উদ্ধত রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়েছে, বুলেটকে আলিঙ্গন করেছে, বুকে তিন বুলেট নিয়েও রণাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে না-গিয়ে মৃত্যুকে সহাস্য বরণ করেছে। ছাত্রলিগ পালালেও আবু সাঈদ পালায়নি।
আবু সাঈদ আবির্ভূত হয়েছে কোটাসংস্কার আন্দোলনের 'প্রথম শহিদ' হিশেবে। আবু সাঈদ ইতিহাসে নিজের নাম লিখিয়েছে বীরপুরুষের উপমা হিশেবে। আবু সাঈদ মহাকালে নিজের নাম খোদাই করেছে মৃত্যুঞ্জয় মহানায়ক হিশেবে। বয়সে যারা সাঈদের চেয়েও ছোট, তারা দেখল— তাদের রক্তে ছাত্রলিগের হাত রঞ্জিত আর গণমানুষের গণদাবির পক্ষে জীবন দিয়েছে 'শিবিরকর্মী' সাঈদ। এর ফলে, সাঈদের চেয়েও অনুজরা ছাত্রলিগকে মনে রাখবে 'ঘাতক' হিশেবে আর সাঈদের 'শিবির'কে মনে রাখবে 'বীরত্বের প্রতীক' হিশেবে। এর ফলে নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান হয়— আবু সাঈদ যদি শিবিরের কর্মী হয়ে থাকে অথবা সে শিবিরকর্মী না-হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামি লিগ যদি তাকে শিবিরকর্মী বলে প্রচার করে থাকে; এর কোনোটিতেই শিবিরের ক্ষতি নেই, বরং আছে লাভের ওপর লাভ। সাঈদ শিবিরকর্মী হলে শিবির দেখাতে পারছে যে, তাদের কর্মীরা গণদাবি আদায়ের প্রশ্নে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারে। পক্ষান্তরে, জাতি দেখছে— ছাত্রলিগ গণদাবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাধারণ ছাত্রদের রক্তে হাত রঞ্জিত করছে। ফলে, যে-প্রজন্ম ২০২৪ সালের রক্তক্ষয়ী কোটাসংস্কার আন্দোলন দেখল; তারা কখনোই ছাত্রলিগকে সভ্য সংগঠন ভাবতে পারবে না, আর শিবিরকে বিবেচনা করবে অধিকার আদায়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিশেবে। অর্থাৎ জেনারেশন জেড বা জেন-জির কাছে শিবির পেল বীরোচিত গ্রহণযোগ্যতা আর ছাত্রলিগ হয়ে গেল অকথ্য রকমের অপ্রাসঙ্গিক, অশ্রাব্য রকমের অপাঙ্ক্তেয়।
আবু সাঈদের মৃত্যুর পরেরদিন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নতুন করে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সীমান্তরক্ষীবাহিনী ডেকে এনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রাবাস খালি করে দেওয়ার পর আওয়ামি লিগ সরকার ভেবেছিল 'জয়' সুনিশ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু সাঈদের মৃত্যুর পরেরদিন যা ঘটেছে, তা আওয়ামি লিগের সিলেবাসের বাইরে ছিল। ঐদিন ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীরা নজিরবিহীনভাবে ফুঁসে উঠল, ঢাকা অচল করে দিল, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ভিডিও গেমের মতো নির্বিকার-নির্বিচার গুলি করে মানুষ মেরে বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করে দিল। একদশক ধরে চলমান আওয়ামি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে এল। অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে বিচলিত হয়ে সরকার কারফিউ দিল, সেনাবাহিনী মোতায়েন করল, গণঅভ্যুত্থান দমনের জন্য কোনো সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করল। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে চার-পাঁচ বছরের শিশুরা নিহত হতে লাগল; যাদের কেউ ছিল বাড়ির বারান্দায়, কেউ জানালার ধারে, কেউ কাছ থেকে হেলিকপ্টার দেখতে গিয়েছিল ছাদে। আওয়ামি লিগের সূত্র অনুযায়ী— চলমান আন্দোলনে নিহত অমুসলমান ছাত্ররাও শিবিরকর্মী, শিবিরকর্মী দুনিয়া বুঝে ওঠার আগেই দুনিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হওয়া শিশুরাও। আওয়ামি লিগ ও এর অঙ্গসংগঠনের পড়াশোনাবিমুখ কর্মীরা এমনই একটা শিবিরতত্ত্ব তৈরি করে রেখেছে— যে-তত্ত্বমতে এ-দেশের মানুষ মাতৃগর্ভ থেকেই শিবির হয়ে জন্মায়; এর পর যারা আওয়ামি লিগে যোগ দেয়, তারা 'মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি' আর বাকিরা সবাই রাজাকার-আলবদর। বিশ কোটি মানুষের দেশে আওয়ামি লিগ এভাবেই উনিশ কোটি মানুষকে শিবির বানিয়ে রেখেছে।
শেখ হানাদারবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে গণহত্যাপরবর্তী দুই সপ্তাহে যারাই কবিতা লিখেছে বা গান বেঁধেছে, আওয়ামি লিগ তাদেরকে জামায়াতের এজেন্ট বানিয়েছে; যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনকি প্রোফাইলছবি লাল করেছে, তাদেরকে যুদ্ধাপরাধীদের দালাল বানিয়েছে; পয়েন্ট ব্লাংক গুলি করার বিরুদ্ধে যে-আইনজীবী আদালতে রিট আবেদন দায়ের করেছেন, ছাত্রলিগের এক সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তাকেও প্রচার করেছেন শিবিরের সাবেক মোটিভেশনাল বক্তা হিশেবে। অর্থাৎ একটা ভয়াবহ গণহত্যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যারাই টুঁ শব্দটি করছেন, আওয়ামি হিশাবমতে তাদের সবাই জামায়াত-শিবির। শুভবুদ্ধির পুরোটুকু কৃতিত্ব জামায়াত-শিবিরের হাতে তুলে দিয়ে আওয়ামি লিগ জামায়াত-শিবিরের ঐতিহাসিক উপকার করল। আওয়ামি লিগের কাছ থেকে এত বড় সার্ভিস জামায়াত নিজেও আশা করেনি। প্রতিষ্ঠার তিরাশি বছরের ইতিহাসে যে-জামায়াত কখনও রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারেনি, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ মিলিয়ে যে-জামায়াত জাতীয় সংসদে তিরাশি বছরে তিরাশিটা আসন নিশ্চিত করতে পারেনি, দেশে-দেশে নিষিদ্ধ হতে-হতে যে-জামায়াত টিকে আছে বিলুপ্ত অতিকায় হস্তীর বিপরীতে নিছক তেলাপোকার মতো; আওয়ামি লিগ সেই জামায়াতকে দিয়ে দিচ্ছে আস্ত একটা গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব। যে-শিবিরের প্রতিষ্ঠাতারা একাত্তরে ছিল রাজাকার-আলবদর, সমস্ত সমালোচককে শিবির আখ্যা দিয়ে 'শিবির' শব্দটিকে খেলো করে দিয়ে ছাত্রলিগ সেই শিবিরকে রীতিমতো নতুন জীবন দিল এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে পুনর্বাসিত করল। গণঅভ্যুত্থানের প্রথম নিহত আবু সাঈদ যদি শিবিরকর্মী হয়, সাঈদকে হত্যা করা পুলিশ কনস্টেবলও যদি শিবিরকর্মী হয়, গণঅভ্যুত্থানে সাংস্কৃতিক ভূমিকা পালনকারী সব বুদ্ধিজীবীও যদি শিবিরকর্মীই হয়; তা হলে আওয়ামি লিগের উচিত হবে দেশের শাসনভার শিবিরের হাতে তুলে দিয়ে সাংগঠনিকভাবে দেশত্যাগ করা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এমন দ্বীপ খুঁজে বের করে নতুন দেশ আবাদ করা, যে-দ্বীপের নাম হবে হেলিকপ্টার আইল্যান্ড। ছাত্রলিগের বিভিন্ন উপদলের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়, আর কোনো অজুহাত না-পেয়ে তখনও এক উপদল আরেক উপদলকে 'শিবিরের অনুপ্রবেশকারী' বলে অভিহিত করে। অতিব্যবহারে-অতিব্যবহারে ছাত্রলিগের শিবির-অস্ত্র এখন এতটাই ভোঁতা হয়ে গেছে যে, এই অস্ত্র দিয়ে কোনোকিছু কাটতে গেলে সেই বস্তুটি ছাত্রলিগের হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে অনুরোধ করে বস্তুটিকে যেন আরেকটু ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটা হয়।
ছাত্রলিগের বয়স আওয়ামি লিগের চেয়েও বেশি। আওয়ামি লিগ প্রতিষ্ঠার দেড় বছর আগে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলিগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্রলিগের সবচেয়ে বেশি দুঃসময় থাকার কথা পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পটপরিবর্তনের পরবর্তী সময়টায়। কিন্তু ছাত্রলিগ সবচেয়ে দুরবস্থা পার করছে মূলত এখন। ছাত্রলিগই বাংলাদেশের একমাত্র ছাত্রসংগঠন, যাদের দল ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর ধরে যারা নিষিদ্ধ। ২০১৯ সালে সেখানকার শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার দায়ে ছাত্রলিগের বিশজন সোনার ছেলে এখন কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায় দিনাতিপাত করছে, পাঁচজন রুপার ছেলে যাপন করছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। মাঝে আদালতের মাধ্যমে ছাত্রলিগ রায় আনিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি উন্মুক্ত করে দেওয়ার পক্ষে। কিন্তু সেখানে ছাত্রলিগের এতই সুনাম যে, আদালতের রায়ের কাগজ হাতে নিয়েও ছাত্রলিগ ঐ প্রাঙ্গণে আর ঠাঁই পায়নি। ছাত্রলিগ যদি দাবি করে যে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলিগের পুনঃপ্রবেশ রুখে দিয়েছে শিবির; ছাত্রলিগের জন্য সেটাও লজ্জার। টানা দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামি লিগের ছাত্রসংগঠনকে যদি শিবিরই অর্ধদশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ছাড়া করতে পারে, তা হলে ছাত্রলিগের সব কর্মীর উচিত পলাশি মোড়ে দাঁড়িয়ে একযোগে বিষ পান করা। সেই বিষপান যেন ধানকাটা কর্মসূচির মতো নাটক না-হয়। আসল বিষ পান করতে হবে, যেন সবার মৃত্যু নিশ্চিত হয়। প্রথম দফা বিষপানে মৃত্যু নিশ্চিত না হলে পার্শ্ববর্তী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে পলাশি মোড়ে ফিরে পুনর্বার বিষ পান করতে হবে। ঢাকা মেডিকেল এতজনের ভার নিতে না-পারলে সলিমুল্লাহ্ বা সোহ্রাওয়ার্দি হাসপাতালে যাওয়া যেতে পারে। তাতেও কাজ না-হলে গলায় দড়ি দিতে হবে বা কমলাপুরে গিয়ে ট্রেনের নিচে একযোগে মাথা দিতে হবে।
দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীদের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মতো হলে ২০১৪-এর পরে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রলিগ নিষিদ্ধ থাকত। ২০১৮ সালের কোটাসংস্কার আন্দোলনের সময়ে সাধারণ ছাত্রীরা গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলিগ সভানেত্রীকে হল থেকে বের করে দিয়েছিল। ২০২৪ সালের কোটাসংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলিগ সেরেফ বানের জলে কচুরিপানার মতো ভেসে গেছে। ছাত্রলিগের কেন্দ্রীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের হলকক্ষ ভাঙচুর করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার বিজিবি নামিয়ে হল খালি করার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে গোটা ছাত্রলিগ সটকে পড়েছে। ছাত্রলিগের কিছু নেত্রীকে অন্য ছাত্রীরা কান ধরে ওঠবস করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ছাড়া করেছে, কাউকে বেঁধে রেখেছে বৈদ্যুতিক খুঁটি বা স্টিলের বেড়ার সাথে, বাঁধার আগে মুখে পেঁচিয়ে দিয়েছে স্কচটেপ। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছে ছাত্রলিগের অসংখ্য নেতাকর্মী। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে ছাত্রলিগের দম্ভপ্রাসাদের সবগুলো ইট। দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন এভাবে সারা দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একযোগে বিতাড়িত হলো। ছাত্রলিগ যদি দাবি করে— ছাত্রলিগকে 'দেশছাড়া' করার এই কাজটি সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা করেনি, করেছে শিবির; তা হলে ছাত্রলিগকে পূর্বোক্ত বিষপানচিকিৎসাই গ্রহণ করতে বলব। ছাত্রলিগ বিষ এ-ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর গোলাপ শাহ্ মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে খাবে, নাকি ধানমন্ডি ৩/১-এর কোনো সুবিধাজনক মোড়ে দাঁড়িয়ে খাবে; সেটি ছাত্রলিগের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেন্দ্রীয় ছাত্রলিগের এক সাবেক সভাপতির কাছে বিয়ে দিয়ে গলায় পাদুকামাল্যপ্রাপ্ত ছাত্রলিগনেত্রীকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ছাত্রলিগকে এবার তিনি বিজিবি নামিয়েও রক্ষা করতে পারলেন না। কান ধরা ছাত্রলিগনেত্রীরা গণভবনে গিয়েছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। হাসিনা তাদের প্রত্যেককে জড়িয়ে ধরে প্রাণপণে কেঁদেছেন। কিন্তু ছাত্রলিগের এই কর্ণকুমারীদেরকে বিয়ে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত ছাত্রলিগ-সভাপতি শেখ হাসিনার হাতে আর নেই। শেখ হাসিনার সবকিছু এখন শেষের পথে। পরিপূর্ণভাবে দপ করে নেভার আগে তিনি শেষবারের মতো জ্বলে উঠেছেন। তার হাতে এখন কিছু বন্দুক ছাড়া আর কিছুই নেই। আছে— কিছু ড্রোন, কিছু ট্যাংক, কিছু হেলিকপ্টার।
শেখ হানাদারবাহিনীর চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে যখনই কোনো প্রবীণ বুদ্ধিজীবী অবস্থান নিচ্ছেন, আওয়ামি লিগ তাকে 'রাজাকার' আখ্যা দিচ্ছে; যখনই ধীশক্তিসম্পন্ন কোনো নবীন বুদ্ধিজীবী এই গণহত্যার প্রতিবাদ করছে, তাকে 'শিবির' খেতাব দিচ্ছে ছাত্রলিগ। অর্থাৎ এখন দেশের শুভবোধসম্পন্ন সব মানুষই আওয়ামি লিগের বীজগণিতমতে জামায়াত-শিবির-রাজাকার। পক্ষান্তরে, আওয়ামি লিগের পক্ষে কথা বলার মতো বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একজনও মেরুদণ্ডসম্পন্ন সৎ বুদ্ধিজীবী নেই। আওয়ামি লিগের পক্ষে কথা বলার মতো কোনো সুযোগ আওয়ামি লিগ আর অবশিষ্ট রাখেনি। যাদেরকে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বলে এতদিন জেনে এসেছি; এই আওয়ামি জাহেলিয়াতকালে এসে আবিষ্কৃত হচ্ছে এদের প্রত্যেকে ভণ্ড, প্রতারক এবং আওয়ামি লিগের উচ্ছিষ্টভোজী। বিগত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন রীতিমতো প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন আওয়ামি লিগ সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কলাম লেখার জন্য সরকার মানসম্পন্ন কলামিস্ট খুঁজছেন, বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। অর্থাৎ এত দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামি লিগকে ভাড়ায় কলামিস্ট খুঁজতে হয়েছে। একটা রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া আর কতটা ছোকলা-ছোবড়া-ছাতু হয়ে গেলে দশা এমন দাঁড়ায়, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। টাকার লোভ দেখিয়েও আওয়ামি লিগ সরকার নিজেদের পক্ষে লেখানোর মতো কোনো জুতসই কলামিস্ট পায়নি। মজার ব্যাপার হলো— দেশের পোষা কলামিস্টদেরকে দিয়েই কলাম লিখিয়ে সরকার সেই কলাম অদ্ভুত-অদ্ভুত নামে আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ রকম একজন কলামিস্টের নাম ডরিন চৌধুরী, আরেকজনের নাম ফুমিকা ইয়ামাদা। বাস্তবে এসব নামে কোনো মানবসন্তানের অস্তিত্ব নেই।
ছাত্রলিগের বর্তমান সভাপতি যখন ডাকসুর এজিএস ছিল, তখন শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে ছাত্রলিগ পঞ্চাশজন প্রভাবশালী তরুণের লেখা নিয়ে ডাকসুর ব্যানারে একটা স্মরণিকা প্রকাশ করেছিল। ছাত্রলিগ আমার কাছেও লেখা চেয়েছিল। শেখ হাসিনার কিছু কর্মকাণ্ডের যথাসম্ভব মোলায়েম সমালোচনা করে এবং বিনয়ের সাথে কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক দাবিদাওয়া তুলে ধরে একটা লেখা লিখেছিলাম। বলাই বাহুল্য— ছাত্রলিগ সেই স্মরণিকায় আমার লেখাটা রাখেনি। শেখ হাসিনা নিজের সমালোচনা শুনতে চান না। ছাত্রলিগও চায় না শেখ হাসিনার কাছে কোনো সমালোচনা বা সৎ পরামর্শ পৌঁছাক। শেখ হাসিনা কেবল প্রশংসা চান, ছাত্রলিগও শেখ হাসিনাকে কেবল প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রশংসাই সরবরাহ করে। উদ্বৃত্ত প্রশংসা তিনি বমি করে ফেলে দেন, তবুও তিনি প্রশংসায় ক্লান্ত হন না। ছাত্রলিগ যদি সেদিন আমার লেখাটা ছাপত; তা হলে অন্তত ব্যক্তিগতভাবে প্রমাণ পেতাম এই ছাত্রলিগ অতীতের ছাত্রলিগের মতো না, কিছুটা আধুনিক। কিন্তু বিধি বাম— থোড়বড়ি খাঁড়া-খাঁড়া, খাঁড়াবড়ি থোড়। ছাত্রলিগ গতবছরও শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিতব্য স্মরণিকায় আমার কাছে লেখা চেয়েছিল। দিইনি। ডরিন চৌধুরী বা ফুমিকা ইয়ামাদা হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
আওয়ামি লিগের মতো ছাত্রলিগেও বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যের ছড়াছড়ি। ন্যূনতম পড়াশোনা নেই, সাংস্কৃতিক চর্চা নেই, ছাত্রদের গণদাবির পক্ষে কথা বলার প্রবণতা নেই; আছে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মতো ভয়ানক ফৌজদারি অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততা। ছাত্রলিগে এই মুহূর্তে এমন একজন কবি নেই, যার কবিতা দেশের মানুষ আগ্রহের সাথে পড়বে; একজন প্রাবন্ধিক নেই, দলের পক্ষে যে একটা কলাম লিখলে মানুষ বিশ্বাস করবে; একজন বক্তা নেই, টেলিভিশন টকশোয় গেলে যার বক্তব্য শুনে মানুষ নির্ভরতা খুঁজবে বা নির্ভার হবে। সারাদেশ যখন শেখ হাসিনার ওপর বীতশ্রদ্ধ, তখন ছাত্রলিগের ছেলেমেয়েরা 'শেখ হাসিনায়ই আস্থা' লেখা ছবি ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে ব্যবহার করছে। কিন্তু যে-শেখ হাসিনার মুখের লাগামহীনতার কারণে দেশের এই দশা, সেই শেখ হাসিনায় এখনও কেন আস্থা— এ নিয়ে দুই পৃষ্ঠার একটা লেখা লিখতে দিলে ছাত্রলিগের নিরানব্বই শতাংশ ছেলেমেয়ে ডাহা ফেল করবে। এদের প্রোফাইলে স্বরচিত কোনো প্রবন্ধ থাকে না, কবিতা থাকে না, গবেষণা থাকে না; থাকে তোষামোদ। রাস্তায় নেমে দিগম্বর হয়ে চিৎকার করেও কেউ যদি বলে— আমি ছাত্রলিগ, আমার কথা বিশ্বাস করো; কেউ ফিরেও তাকাবে না, উন্মাদ ভেবে বরং গায়ে চিমটি কেটে যাবে বা দু-টুকরো পাউরুটি ছুড়ে মারবে। সশস্ত্র শেখ হানাদারবাহিনীর প্রহরা ছাড়া এই মুহূর্তে দেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলিগ পা রাখলে এদের একজন কর্মীও বাড়ি ফিরে যাওয়ার অবকাশ পাবে না, ছাত্রছাত্রীরা ষোলো বছরের আমলনামা হাতে ধরিয়ে দেবে, নিশ্চিহ্ন করে দেবে ইতিহাসের পাতা থেকে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলিগের সভাপতি যদি আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার সাথে-সাথেই ছাত্রছাত্রীদেরকে আশ্বস্ত করে বলত যে, ছাত্রলিগই প্রধানমন্ত্রীর সাথে বসে এক সপ্তাহের মধ্যে কোটার পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনবে; তা হলে ইতিহাসে ছাত্রলিগ নায়ক হয়ে থাকত। কিন্তু গণদাবির বিরুদ্ধে গিয়ে ছাত্রলিগ শেখ হাসিনার পেটোয়াবাহিনী হিশেবে কাজ করেছে, ছাত্রছাত্রীদের ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং শেষ পর্যন্ত গগনবিদারী গণপ্রতিরোধের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে গেছে। আন্দোলনকারীদেরকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলিগ এখন ছাত্রশূন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঠবেড়ালি গুনছে। একাত্তরে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন— পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাই না, মাটি চাই। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেই, মাটি আছে। ছাত্রলিগের নেতাকর্মীরা চাইলে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি কেটে ট্রাকে ভরে গণভবনে পৌঁছে দিয়ে অবসর কাটাতে পারে। এই ছাত্রশূন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু মিছিলে যোগ না-দেওয়ার অপরাধে অরাজনৈতিক ছাত্রছাত্রীদেরকে পিটিয়ে বা হলের বা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকার দোকানপাট থেকে চাঁদা তুলে সময় কাটানোর সুযোগ নেই, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি কেটে গণভবনে পৌঁছে দেওয়া ছাড়া ছাত্রলিগের হাতে আর কোনো কাজ থাকার কথা না।
নিম্নাঙ্গে সোনালি পাড় শিফন লুঙ্গি, ঊর্ধাঙ্গে ধবধবে হাফহাতা গেঞ্জি, মাথায় মিচকে মাথাল, হাতে রোলেক্স সেঁধিয়ে কৃষকের কাঁচা ধান কেটে দেওয়ার ছবি আপলোড করলে; জনসেবার নামে নির্লজ্জ ফটোসেশন করে মানবতার ফেরিওয়ালা সাজলে ছাত্রসংগঠনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না। ভ্যানগাড়িতে করে ন্যায্যমূল্যে শবজি বিক্রি করলে, ইদে-চান্দে শাড়ি-লুঙ্গি-কম্বল বিতরণ করলে হাত থেকে রক্তের দাগ মুছে যায় না। গণআন্দোলনে জীবন দেওয়া বীরপুরুষদেরকে জামায়াতের প্রেতাত্মা বা শিবির আখ্যা দিলে দায়মুক্তি ঘটে না। চলমান আন্দোলনে পালটা-আক্রমণে কিংবা পুলিশের 'ভুলবোঝাবুঝি'তে ছাত্রলিগেরও কয়েকজন মারা গেছে। তাদের মৃত্যুতে কেন কেউ অশ্রুপাত করছে না, ছাত্রলিগ এই প্রশ্ন তুলছে। কিন্তু ছাত্রলিগ জানে না— স্বতঃস্ফূর্ত অশ্রু খুব দুর্লভ একটা সম্পদ। নিপীড়কদের মৃত্যু হলে মানুষ কাঁদে না, উলটো স্বস্তি পায়। ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে থেকে জুলুম চালাতে গিয়ে আত্মঘাতী গোল হয়ে গেলে সেই মৃত্যু কেউ মনে রাখে না, কালের গহন গহ্বরে হারিয়ে যায়, সময়ের উষ্ণ জলে ভেসে যায়। 'শিবির' খেতাব দিয়ে ছাত্রলিগ যে-আবু সাঈদের মৃত্যুকে সোল্লাসে উদ্যাপন করেছে— কালের গর্ভে টিকে থাকতে হলে, ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেতে চাইলে, গণমানুষের মনের মণিকোঠায় স্থায়ী আসন পেতে চাইলে আবু সাঈদের মতো রাজপথে দুই হাত দুই দিগন্তে প্রসারিত করে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে চোখ বুজে উন্মত্ত সশস্ত্রবাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়, উপর্যুপরি গুলি খেয়েও দাঁড়িয়েই থাকতে হয়, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েও চোয়াল শক্ত রাখতে হয়। আবু সাঈদ যদি শিবির হয়, তা হলে গোটা ছাত্রলিগেরই এখন শিবির হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। ছাত্রলিগ ইতোমধ্যেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। জীবন 'নিয়ে' ইত