18/06/2025
আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনির সঙ্গে মূলধারার সুন্নি উম্মাহর আদর্শিক দূরত্ব বহু পুরনো। বহু বিষয়ে মতবিরোধ এমন স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে ইমান ও কুফরের সীমারেখাও কখনো কখনো আলোচনায় উঠে এসেছে। তথাপি, রাজনীতির নির্মম বাস্তবতায় একটি চিরন্তন সূত্র আজও কার্যকর—"শত্রুর শত্রুই আমার সম্ভাব্য মিত্র"। এই সমীকরণে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে এই প্রবীণ আলেমের মতো একনিষ্ঠ ও স্পষ্টভাষী বন্ধু আমাদের আর কেউ নেই।
আজকের এই নিষ্ক্রিয়, আধুনিকতা-মোহে বিভোর মুসলিম নেতৃত্ব যখন ‘প্রতিবাদ’ নামক শব্দটিকেও ফরমালিটি বানিয়ে ফেলেছে, তখন খোমেনি এক হাতে অক্ষম হয়েও নিঃশব্দতা ভেঙে আওয়াজ তুলছেন। তাঁর উচ্চারণে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর নিপীড়কের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান। এমন একজন বৃদ্ধ নেতার সরব অবস্থান এক জাতিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, যারা বরাবরই অন্যায়ের বিরোধিতায় অভ্যস্ত নয়।
আক্বিদার জায়গায় আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও, তাঁর নেতৃত্ব ও সাহসিকতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ইরানিদের মধ্যে তাঁর প্রতি যে আনুগত্য ও আবেগ, তা কেবল নেতৃত্ব নয়—বরং তাঁকে একটি আদর্শ, এক প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। তিনি নিজেই একটি আন্দোলন, এক ধরণের অনড় অবস্থান। তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—তিনি প্রচারবিমুখ, নিরব-নিভৃত; কিন্তু শত্রুর ব্যাপারে চূড়ান্ত রকমের অনমনীয়।
অনুভব হয়, আল্লাহ যেন তাঁকে পশ্চিমা আধিপত্যবাদীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর মতো কেউ না থাকলে হয়তো আজও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা নোবেল আর বিলাসবহুল প্রতিদান দিয়ে আরব বিশ্বকে নিস্তব্ধ রাখত।
এই ক্ষীণ কণ্ঠের গভীরতায় এমন সাহসিকতা আছে, যা বহু তরুণ নেতার মাঝেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তিনি বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন—নেতৃত্ব মানে চেয়ারে বসে থাকা নয়, বরং সত্যের জন্য দাঁড়ানোর সাহস দেখানো। যখন গোটা মুসলিম বিশ্বের নেতারা বিলাসিতা আর নিরবতায় মগ্ন, তখন খোমেনি এক ব্যতিক্রমী বিবেকের ধ্বনি হয়ে উঠেছেন।
হ্যাঁ, আমরা তাঁর আক্বিদার অনুসারী নই, কিন্তু তাঁর আপসহীনতা, দৃঢ়তা, এবং প্রতিবাদী অবস্থান আমাদের শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, একদিন যখন সবাই নিশ্চুপ ছিল, তখন এই বৃদ্ধ বলেছিলেন, "না"।
তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না—ইরাক, সিরিয়া কিংবা লেবাননের বহু সুন্নি মুসলিম হত্যাকাণ্ডে ইরানি নীতির কিছুটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায় আছে। খোমেনির নেতৃত্বাধীন পররাষ্ট্র কৌশল এবং সামরিক জোট অনেক ক্ষেত্রে এসব ট্র্যাজেডিকে জন্ম দিয়েছে। এই দায় থেকে একেবারে মুক্ত থাকাও সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের ইতিহাস হয়তো তাঁকেও এই ইস্যুতে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
তবু, বর্তমানে যখন এক অবৈধ রাষ্ট্র গোটা মুসলিম ভূখণ্ডে রক্তপাত ঘটাচ্ছে, তখন এই বর্বরতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সাহসী কণ্ঠস্বর খোমেনিরই। এই মুহূর্তে আমরা তাঁর মতাদর্শ নয়, তাঁর অবস্থানকে মূল্যায়ন করছি। কারণ বাস্তবতা বলছে, মুসলিম বিশ্বের এখন প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব ও সম্মিলিত প্রতিরোধ।
আজ খোমেনি সেই প্রতিরোধের একমাত্র পুরোধা। তিনি নেতৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করছেন নতুনভাবে—যেখানে চুপ থাকা নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চিৎকার করাটাই আসল নেতৃত্ব। ইতিহাস এই বৃদ্ধ মানুষটিকে হয়তো সাদ্দাম বা গাদ্দাফির ভাগ্যে পৌঁছে দেবে। তবে তাঁর রক্ত বিভ্রান্তি নয়, বরং প্রতিবাদের আগুন জ্বালাবে। তিনি একনায়ক হয়ে নয়, প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন।
আর আরব বিশ্বের সেইসব শাসক যারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমা দাসত্বে লিপ্ত, তাদের কপালেও হয়তো খোমেনির মতো অবস্থা আসবে। তখন তারা উপলব্ধি করবে—যে বৃদ্ধকে তারা সহানুভূতি দেখায়নি, সেই-ই ছিল তাদের একমাত্র প্রহরী। কিন্তু তখন হয়তো সময় আর থাকবে না।
খোমেনি আজ একা নন, তিনি একটি অবস্থান। তিনি হেরে যাননি—বরং সময়কে জাগিয়ে তোলার সাহসী উচ্চারণে পরিণত হয়েছেন।