30/09/2024
কানপুর টেস্টের চতুর্থ দিন উইকেট পড়েছে ১৮টা। এই কথা শুনে মনে হতে পারে, আজ গোটা দিনটাই বুঝি বোলারদের দখলে ছিল। আদতে তা নয়। ১৮ উইকেট পড়া দিনটাতেও সব আলো কেড়েছেন ব্যাটাররাই।
আরো মজার ব্যাপার হলো, টানা দুইদিন একটা বল মাঠে না গড়ানো সত্ত্বেও মাত্র দেড় দিন অর্থাৎ সাড়ে চার সেশনের খেলার ওপর ভর করেই পুরোপুরি জমে ওঠেছে টেস্টটা। দুর্দান্ত পরিকল্পনা ও ফলপ্রসূ প্রয়োগের মাধ্যমে এত কম সময়ের মধ্যেও টেস্টটাকে জিইয়ে তোলার কৃতিত্বটা ভারতীয় ব্যাটারদের।
ভারতের ব্যাটাররা নিজেদের ব্যাটিংয়ের পুরোটা সময় আজ টি-টোয়েন্টি মেজাজে খেলেছেন। শুরুটা করেছেন দুই ওপেনার যশস্বী জয়সোয়াল ও রোহিত শর্মা। তারপর নবম উইকেট পর্যন্ত যিনিই উইকেটে নেমেছেন, তিনিই হয় মেরে খেলেছেন, নয়তো সে চেষ্টাটাই শুধু চালিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে, প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের করা ২৩৩ রান মাত্র সোয়া এক ঘণ্টা উইকেটে থেকে ২৭.৫ ওভারেই পেরিয়ে যায় ভারত। তাঁদের প্রথম ছয়জন ব্যাটারের মধ্যে পাঁচজনই ব্যাটিং করেন শয়ের উপর স্ট্রাইক রেটে। এই সময়টায় টেস্টে দলীয় দ্রততম অর্ধশতক, শতক, দেড় শতক, দ্বিশতক ও আড়াই শতকের রেকর্ডও গড়েন তাঁরা।
তবে মারতে গিয়ে উইকেটও খুইয়েছেন ভারতীয় ব্যাটাররা। একটা সময় টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডার ব্যাটাররা অনবরত মেরে খেলে পার পেয়ে গেলেও লোয়ার মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় শেষ ৩৯ রানে ৫ উইকেট হারান তাঁরা। এ কারণে কেবল ৫২ রানের লিড পান স্বাগতিকরা। বাংলাদেশের সাকিব ও মিরাজ সর্বোচ্চ ৪টি করে উইকেট পান। আর ১ উইকেট হাতে রেখেই ২৮৫ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত।
আজকে শুরুতে আমাদের বোলারদের বোলিং দেখে মনে হয়েছে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের এ-রকম তোপের মুখে পড়ার জন্য তাঁরা একদমই প্রস্তুত ছিলেন না। হঠাৎ উদ্ভূত এ-রকম পরিস্থিতিতে শুরুতেই খেই হারিয়ে ফেলেন বোলাররা এবং এলোমেলো বল করতে থাকেন।
তাছাড়া ফিল্ডিংটাও ছিল যাচ্ছেতাই৷ বিশেষ করে, খালেদ আহমেদের কথা বলতেই হয়। নিজের বলে নিজে ফিল্ডিং করতে গিয়ে মাত্র ১০-১২ সেন্টিমিটার দূরত্বের স্টাম্প ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে বিরাট কোহলিকে ব্যক্তিগত ২ রানের মাথায় জীবন দেন তিনি। তখন কোহলি পপিং ক্রিজের বেশ বাইরে ছিলেন এবং খালেদ বলটা না ছুড়ে সময় নিয়ে নিজ হাতে স্টাম্প ভাঙলেই তাঁকে আউট করতে পারতেন। একই ওভারে আবারও জীবন পান কোহলি। তাঁর ব্যক্তিগত ১১ রানের সময় সাকিব আল হাসানের একটা সরাসরি থ্রো স্টাম্পে লাগলেই সাজঘরের পথ ধরতে হতো তাঁকে। তারপর ব্যক্তিগত ৩৪ রানে থাকাকালীন তাইজুলের বলে লিটন স্টাম্পিংয়ের সুযোগ মিস করলে তৃতীয়বারের মতো জীবন পান ৪৭ রানের ইনিংস খেলা কোহলি। সেইসাথে শুরুতে ব্যক্তিগত ১২ রানের সময় হাসান মাহমুদের বলে কট বাহাইন্ডের আবেদনে আম্পায়ারের নাকচ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে রিভিয়ো না নেওয়ায় জীবন পান ২৩ রানের ইনিংস খেলা রোহিত।
ফিল্ডিংয়ের মতো দিনের শেষ দিকে দ্বিতীয় ইনিংসের ব্যাটিংয়েও হতশ্রী বাংলাদেশ। মাত্র ২৬ রানের মধ্যেই ওপেনার জাকির হাসান ও নাইটওয়াচম্যান হাসান মাহমুদ ফিরে যান সাজঘরে। ২৬ রানে পিছিয়ে থেকে আগামীকাল দিন শুরু করবেন ৭ রানে অপরাজিত থাকা সাদমান ইসলাম ও কোনো রান না করা মুমিনুল হক।
এই মুহূর্তে কানপুর টেস্টটা পুরোপুরি ভারতের দখলে। এখন দুইটা ফলাফলের সম্ভাবনা পঞ্চম দিনে টিকে রয়েছে। সেগুলো হলো- ভারতের জয় কিংবা ড্র। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের জেতার কোনো সুযোগই দেখছি না আমি। কারণ, তাঁরা জিততে চাইলে ভারতের প্রথম ইনিংসের মতোই মারকুটে ব্যাটিং করে সর্বোচ্চ এক সেশনের মধ্যে একটা ঝুঁকিমুক্ত লক্ষ্যমাত্রা দাঁড় করাতে হবে, যা পরিস্থিতি কোনোভাবেই সমর্থন করছে না। এমনটা বাংলাদেশের ব্যাটাররাও করতে যাবেন নিশ্চিতভাবেই। তার চেয়ে বরং তাঁদের লক্ষ্য থাকবে কোনোভাবে ম্যাচটা ড্র করা৷ সেটাও যে সহজ হবে না, তা হলফ করে বলাই যায়।
অন্যদিকে ভারতের ক্রিকেটাররা মরিয়া হয়ে আছে এই ম্যাচটা জেতার জন্য। সেটা তাঁদের প্রথম ইনিংসের অপ্রচলিত ব্যাটিংয়েই স্পষ্ট৷ তাই আগামীকাল তাঁদের লক্ষ্য থাকবে যত দ্রুত পারা যায় বাংলাদেশকে অল আউট করে ফেলা। তারপর যে ছোটখাটো একটা লক্ষ্যমাত্রা পাবে, সেটা তাড়া করে জেতা। এক্ষেত্রে একটা ড্র মানেই বাংলাদেশের প্রাপ্তি। কারণ, এ ম্যাচে এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার নেই তাঁদের। সেজন্য উইকেট না হারিয়ে শেষ সেশন অবধি ব্যাটিংটা নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি বাংলাদেশের জন্য। আর সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার এটাই যে, ম্যাচটা রক্ষা করার পুরো বিষয়টাই এখন নির্ভর করছে দলের ব্যাটারদের ওপর।
আসলে বাংলাদেশের ব্যাটারদের যে সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, তাতে তাঁদের ওপর খুব একটা ভরসা করা যাচ্ছে না। এই যেমন আজ সকালেই প্রথম ইনিংসে এক মুমিনুল বাদে কেউ উইকেটে টিকে থাকতে পারেননি। মুশফিক, লিটন ও সাকিব উইকেট বিলিয়ে দিয়ে নিজেদের 'দায়িত্ব' সেরেছেন। অথচ মুমিনুল প্রথমে টানা ১৪ বলে রান না পেলেও বিচলিত না হয়ে ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরেছেন এবং ছন্দে ফেরার পর নিখুঁত ব্যাটিং করে শতক হাঁকিয়েছেন।
ঠিক এ কাজটাই আগামীকাল সকালেও করতে হবে মুমিনুলকে। আজ সিমারদের শর্ট বলে বেশ ভালো পুল করে এবং স্পিনারদের বিপক্ষে সাবলীলভাবে একের পর এক সুইপ খেলে রান তুলেছেন তিনি।
ওদিকে উইকেটের যে অবস্থা, তাতে আগামীকাল ব্যাটিংটা আরও কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। আজ শেষ বিকেলে সিমারদের বল নিচু হয়ে এসেছে এবং অশ্বীনের বল ভালো বাঁক পেয়েছে। এ-রকমটা আগামীকালও বজায় থাকলে এই উইকেটে পড়ে থাকাটা মারাত্মক কঠিন হবে। তাছাড়া শুধু টিকে থাকার চিন্তা করে খেললে রান তো হবেই না, ওলটো বাঁক খাওয়া বা নিচু হওয়া কিছু বলে উইকেটগুলা খুইয়ে আম-ছালা দুটোই যাবে।
তাই যথাসম্ভব ইতিবাচক থেকে রান করার মাধ্যমে উইকেটে টিকে থাকাটাই হতে পারে ভালো একটা পছন্দ৷ তার মানে এই না যে, রানের জন্য ভারতের মতো মরিয়া হয়ে মেরে খেলতে হবে৷ শুধু দেখেশুনে ছাড়ার বল ছেড়ে, মারার বল মেরে এবং স্ট্রাইক রোটেট করে খেলাটা চালিয়ে যেতে হবে৷ এতে করে রানের চাকা সচল থাকবে এবং তাতে প্রতিপক্ষের বোলারদের মনোবলেও একটা সময় চিড় ধরবে।
যদিও কথাগুলা যতটা সহজে বলে ফেললাম, কাজের বেলায় করে দেখানো ঠিক ততটাই কঠিন। আর ব্যাটিং লাইন-আপটা যদি আমাদের দলের মতো ভঙ্গুর হয়, তাহলে তো কথাই নেই!
তার পরেও আশা রাখছি। হাজার হোক, বাংলাদেশের মতো দলের সমর্থকদের জন্য আশাটাই যে সম্বল!
©️ Udoy Sina