13/06/2025
বলা হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হচ্ছে পিতার কাঁধে সন্তানের মৃ ত দে হ।
আবার এটাও বলা হয় যে হৃদয় কখনো জখম না হলে সে হৃদয় থেকে অমর কিছু সৃষ্টি হয় না।
বাংলা সাহিত্যের দুই প্রবাদপুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুজনকেই সন্তানের মৃ ত্যু র মত করুণতম ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছিল।
জমিদার রবীন্দ্রনাথ কিংবা অভাবে জীবন কেটে যাওয়া চিরদুর্দম, দুর্বিনীত ও বিদ্রোহী কবি নজরুল যেন সন্তান হারানোর বেদনায় এক বিন্দুতে এসে মিলে গেছেন।
স্রষ্টার পরীক্ষা স্পর্শ করে গিয়েছিল সম্পদের দিক থেকে দুই ভুবনের দুই পথিকের জীবন।
"ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হ’য়ে আমার গানের বুলবুলি —
করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি।।"
ছেলে অরিন্দম খালেদ (বুলবুল)-এর মৃ ত্যু র পর এই গান লিখেছিলেন নজরুল। সম্ভবত ৩-৪ বছর বয়সে বসন্তরোগে মারা যান কবির স্নেহের এই পুত্র।
আরেক পুত্র কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের কয়েক মাস পরেই মারা যান।
বুলবুল যখন অসুস্থ ছিল, তার চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে রেলগাড়িতে চেপে কলকাতায় কল্লোল পত্রিকার কার্যালয়ে আসছিলেন কবি।
পথে আনমনে একটি কাগজে ছাপা বিজ্ঞাপনের উল্টা পৃষ্ঠায় পেনসিল দিয়ে গজল লিখেছিলেন অমর সেই গান- "বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল-শাখাতে দিস নে আজি দোল।"
সন্তানের মৃত্যু প্রাণোচ্ছল এই কবির জীবনকে উল্টেপাল্টে দিয়েছিল। কেউ বলেন, এই মৃত্যুর পর তিনি আধ্যাত্ম্য সাধনার দিকে ঝুঁকে পড়েন।
কবি জসীম উদ্দীন লিখেছিলেন, নজরুলকে তিনি একদিন খুঁজে পেলেন ডিএম লাইব্রেরির এক কোণে।
পুত্রশোক ভোলার জন্য হাসির কবিতা লিখছেন আর কেঁদে চলেছেন। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল।
নজরুলের জীবনে প্রেম, সন্তান, অভাব, অসুখ সবকিছুই যেন বিশাল সব ঢেউয়ের মত আছড়ে পড়েছিল।
গ্রিক ট্র্যাজেডির মত বিপুল বিষাদকে সঙ্গী করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে তাঁকে।
অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের জীবনে অর্থকষ্ট বলতে কিচ্ছু ছিল না। কিন্তু সন্তান হারানোর শোক তো তাবৎ সম্পদ হারানোর চেয়েও বেশি।
এই শোকে রাজা আর ঋষি সমান পরাভব মানেন। এই শোকের কোনো তুলনা ত্রিভূবনে নেই।
যে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন- ব্যথাবেদনার পরশরতন গেঁথে গেঁথে পরমেশ্বর আমাদের জীবন সাজান, সেই রবীন্দ্রনাথও একজন বাবা। সন্তানদের ম র ণ যাত্রা তাঁকে বারবার দেখতে হয়েছে।
কন্যা রেণুকা ১২ বছর, আর পুত্র শমীন্দ্রনাথ মা রা যান ১১ বছর বয়সে।
আর সবচেয়ে প্রিয় কন্যা মাধুরীলতা মা রা যান ১৯১৮ সালে, ৩১ বা ৩২ বছর বয়সে।
কাবুলীওয়ালার 'মিনি' চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন মাধুরীলতাকে মনে রেখেই।
মাধুরীলতার জন্মের কথা স্মরণ করতে গিয়ে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'বেলা যেন মোমের পুতুলটির মতো হয়েছিল।'
জাহাজে চেপে দূরদেশে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ মাধুরীলতাকে স্বপ্নে দেখতে পেয়ে স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, 'কাল রাত্তিরে বেলাটাকে স্বপ্নে দেখেছিলুম- সে যেন স্টিমারে এসেচে- তাকে এমনি চমৎকার ভাল দেখাচ্চে সে আর কি বলব…।'
সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকলেও প্রথম সন্তান মাধুরীলতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অসীম আগ্রহ।
জন্মের পরে শিশু মাধুরীলতার স্নান করানো থেকে, রাতে দুধ গরম করে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিত্যসঙ্গী।
আদরের সেই সন্তান পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে কোন বাবার হৃদয় জখমে র ক্তা ক্ত হবে না?
আর হৃদয়ে জখম নিয়েই বাংলা সাহিত্যের এই দুই মহারথী আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন অজস্র গান আর কবিতা।
সূত্র: TBS, TDS