21/01/2025
যারা নবীজিকে ভালোবাসে তারা সাড়া দাও আর যারা ভালোবাসেন না তারা এড়িয়ে চলে যাবেন
রওজা শরীফ/মাজার শরীফে ইমারত নির্মাণ প্রসঙ্গ ( কোরআন ও হাদীসের আলোকে)
কবর বা মাজার বলতে আমরা বুঝি মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মৃত দেহের অবস্থান স্থলকে আরবী ভাষায় কবর বলে।
আল্লাহর অলি ও বুজুর্গগণের কবরকে ফার্সী ভাষায় মাজার বা দরগাহ বলা হয়। আর নবী ও রাসুলগণের কবরকে রওজা বা বেহেশতের বাগান বলা হয়।
দুনিয়ার সমস্ত মাযারের মধ্যে সর্বোউত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মাযার হচ্ছে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর রওজা মোবারক।
আল্লাহতা’য়ালা কোরআন মজীদে আসহাবে কাহাফ এর মাযার সম্পর্কে সুরা কাহাফে ঘোষণা করেছেন “যারা আপন কাজে বিজয়ী হয়েছে, তারা বললো - আমরা অবশ্যই আসহাবে কাহাফের মাযারের উপর একটি মসজিদ নির্মান করবো।”
উক্ত আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, অলীগণের মাযারের আশেপাশে ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদ নির্মাণ করা, তিলাওয়াত ও জিয়ারতের সুবিধার্থে মাযারের উপর ছাদ ও গম্বুজ নির্মাণ এবং চতুষ্পার্শে দেয়াল তৈরী করা যায়েজ ও বৈধ।
কেননা, আসহাবে কাহাফ ছিলেন আউলিয়া। মসজিদ বা ইবাদতখানা নির্মাণের পটভূমিকায় আসহাবে কাহাফের উল্লেখ থাকলেও এর আওতায় সমস্ত অলীগণই শামিল।
উসূলের বিধান অনুযায়ী শানে নুযুল খাস হলেও হুকুম আম বা সকলের বেলায় প্রয়োজ্য। মাযার সংলগ্ন মসজিদ বা ইমারত নির্মাণের বর্ণনাটি প্রশংসামূলক হিসেবে কোরআনে উল্লেখিত হয়েছে (তফসিরে রুহুল বয়ান)। ইরাক, ইরান, মিশর, লিবিয়া, জর্দান, সিরিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে অসংখ্য পাকা মাযার বিদ্যমান রয়েছে। এসব দেশের মুসলমানরা তুলনামূলকভাবে ইসলামী জজবায় উজ্জীবিত। বাগদাদে শীষ পয়গম্বর (আলাইহিস সালাম), হযরত ইউনুছ (আলাইহিস সালাম), হযরত আইয়ুব (আলাইহিস সালাম) এর মাযারসহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম ও অলী গাউছগণের মাযার এখনও বিদ্যমান রয়েছে।
পাকভারত উপমহাদেশের সর্বজনমান্য শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) স্বীয় গ্রন্থ ‘জজবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ এ উল্লেখ করেছেন “মাযারের উপর ইমারত নির্মাণ করা সাহাবায়ে কেরাম ও প্রথম যুগের বুজুর্গানে দ্বীনের কর্মের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। যেমন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর রওজা মোবারকের উপর সর্ব প্রথম হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এবং দ্বিতীয় বার হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) ইমারত ও আলীশ্বান গম্বুজ নির্মাণ করেছিলেন”।
বোখারী শরীফ ১ম খন্ড যানাজা অধ্যায়ে আছে “হযরত রাসুল করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), হযরত আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) ও হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর রওজা মোবারক সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, উমাইয়া খেলাফতের সময় ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের যুগে (৮৬ হিজরীতে) একবার রাসুলুুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর রওজা মোবারকের এক দিকের দেয়াল ধসে গেলে সাহাবায়ে কেরাম উহা মেরামত শুরু করে দিলেন। মেরামতের কাজের সময় হঠাৎ একখানা পবিত্র কদম দৃষ্টিগোচর হলো। উপস্থিত লোকজন মনে করলেন হযতোবা ইহা রাসুলুুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর কদম মোবারক। কিন্তু তথায় উপস্থিত হযরত ওরওয়া (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) (হযরত আয়েশার ভাগিনা) সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন ঃ “না, খোদার শপথ, ইহা নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর এর কদম মোবারক নহে। ইহা তো হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর কদম”। উক্ত ঘটনার দ্বারা প্রতাণিত হলো যে, সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কেরামগনই নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম), হযরত আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এবং হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর রওজা শরীফ পাকা করেছিলেন এবং চতুস্পার্শে দেয়াল দ্বারা আবৃত করেছিলেন। উক্ত ইমারতের মধ্যে একজন নবী এবং দুইজন সাহাবীর রওজা শরীফ অবস্থিত।
যদি অলিগণের মাযার পাকা করা ও গম্বুজ নির্মাণ করা অবৈধ হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম কখনো উহা করতেন না। অনেক সাহাবীগণই বিভিন্ন বুজর্গদের মাযার পাকা করেছেন। যেমন হযরত ওমর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) তাঁর খিলাফতকালে উম্মুল মুমিনীন হযরত জয়নব বিনতে জাহাশ (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর মাযারের উপর গম্বুজ নির্মাণ করেছিলেন। হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) মক্কা শরীফে অবস্থিত তাঁর ভাই হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর মাযারের উপর গম্বুজ নির্মাণ করেছিলেন। তায়েফে অবস্থিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাছ (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর কবরের উপর বিশিষ্ট তায়েবী মুহাম্মদ বিন হানফিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) গম্বুজ নির্মাণ করেছিলেন (মুনতাকা শরহে মুয়াত্তা ও বাদায়ে সানায়ে)। হযরত ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর পুত্র দ্বিতীয় হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) ইনতিকাল করলে তাঁর বিবি তাঁর মাজারে একটি কোব্বা তৈরী করেন এবং এক বৎসর পর্যন্ত তথায় অবস্থান করেন। কোন সাহাবী এতে বাঁধা দেন নি (বোখারী শরীফ ১ খন্ড কিতাবুল যানায়েজ)।
সুতরাং সাহাবীগণের আমল দ্বারাই মাযারের উপর ইমারত নির্মাণের বৈধতা প্রমাণিত। বর্তমানে সৌদী আরবে মসজিদে নববীতে সংরতি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীদ্বয়ের (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) রওজা মোবারক ব্যতীত অন্য কোন মাযারের চিহ্ন নেই।
ওহাবী পন্থী ওয়ায়েজীনরা বলে সৌদী আরবে কোন পাকা মাযার নেই। কাজেই এটা হারাম। এখন বন্ধ হলো কেন? কে বন্ধ করলো? প্রকৃত ঘটনা হলো ১৯২৪ সনে যখন গোটা আরবে সৌদী হুকমত প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বাদশাহ আবদুল আজিজের নির্দেশে সমস্ত মাজার শরীফ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। হযরত খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু, হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু, হযরত হালিমা রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু, উম্মুল মোমেনীন হযরত আশেয়া সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) সহ নবীবংশের ও হাসান-হোসাইন বংশের ইমামগণের মাযার ধূলিস্যাত করে দেয়া হয়েছে এবং মাজারসমূহের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।
ভারতের খিলাফত আন্দোলনের নেতা মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী বাদশাহ আবদুল আজিজের এ সমস্ত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ৬-সদস্য বিশিষ্ট একটি খিলাফত প্রতিনিধি দল ডাক্তার আনসারী ও মিঃ শোয়াইব এর নেতৃত্বে আরব দেশে প্রেরণ করেন। তারা ১৯২৫ ও ১৯২৬ সনে দু’ বার আরব গমন করে মাজার ভাঙ্গা ও পবিত্র স্থান সমূহের নিদর্শন ভাঙ্গার ছবি তুলে নিয়ে এসেছেন যার বিস্তারিত ঘটনা মাওলানা জিয়াউল্লাহ, আল কাদেরী (রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু) এর লিখিত ওহাবী মাযহাব এবং আল্লামা আরশাদুল কাদেরী (জমশেদপুর বিহার) এর লিখিত তাবলীগী জামায়াত গ্রন্থে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অতীত ইতিহাস অতি সহজে ভুলে যায়। এই সুযোগে ওহাবীপন্থী আলেমগণ বলে বেড়ায় যে, আরব দেশে কোন মাজার নেই এবং সেখানে কোন উরস শরীফও পালন করা হয় না। অথচ আসল ঘটনা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। উরস শরীফ ও মিলাদ শরীফ প্রথমে আরব দেশেই চালু হয়েছে। পরে বাংলাদেশে এসেছে। সৌদী আরবের সুন্নী মুসলমানরা এখনো গোপনে মিলাদ শরীফ কিয়াম সহকারে পাঠ করে থাকেন। সৌদী আরবের প্রাক্তন তৈলমন্ত্রী জাকি ইয়ামানী ছিলেন সুন্নী মুসলমান। তিনি প্রতি বৎসর ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপলে তাঁর মক্কা শরীফের বাড়ীতে বিরাট মিলাদ মাহফিল ও জিয়াফতের আয়োজন করে থাকেন। এ কারণেই তাঁকে সৌদী সরকার বরখাস্ত করেছেন।
মুসলমানকে দু’ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। (১) সাধারণ মুসলমান এবং
(২) উলামা, পীর মাশায়েখ আওলিয়াকেরাম যাদের তাযীম আসলে ইসলামের তাযীম। সাধারণ মুসলমানদের কবরকে পাকা করা বা এর উপর গম্বুজ তৈরী করা যেহেতু অনর্থক, সেহেতু নিষেধ। তবে তাদের কবরের নিশানা ঠিক রাখার অভিপ্রায়ে মাটি ইত্যাদি দেয়া ও ফাতিহা ইত্যাদি পাঠ করা জায়েয। উলামা, পীর মাশায়িখ ও আওলিয়া কেরামের মধ্যে যাদের মাযার সমূহে জনগণের ভীর থাকে এবং লোকেরা ওখানে বসে কুরআনখানি, ফাতিহা, মিলাদ শরীফ ইত্যাদি পাঠ করে, আগতদের আরামের জন্য এবং অলীর মাযারের শানমান প্রকাশ করার জন্য এবং আশেপাশে ছায়ার জন্য গম্বুজ বিশিষ্ট ঘর, ইত্যাদি তৈরী করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয বরং সুন্নাতে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত।
“আল অলিও লায়ামুতু” আল্লাহর অলিগণের মৃত্যু নাই। কোরান মজীদে আল্লাহতায়ালা ফরমায়েছেন “এবং বলিও না যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে, তারা মারা গেছে। না, কখনোই নয় বরং তারা জীবিত” সুরা বাকারা, আয়াত ১৫৪) ও “এবং না, চিস্তা করোনা, যারা আল্লাহর রাস্তায় কতল হয়েছে তারা মৃত, না, কখনোই নয় বরং তারা জীবন্ত। তারা তাদের রবের নিকট হতে রিজিক পাচ্ছে” (সুরা আল এমরান, আয়াত ১৬৯)। আল্লাহর অলীগণ ইহজগতেও যেমন সম্মানের অধিকারী তেমনি ওফাতের পরও তাঁরা সম্মানের অধিকারী। তাঁদের মাযারের উপর ইমারত তৈরী করা হচ্ছে সেই সম্মান প্রকাশের মাধ্যম বিশেষ। যাতে লোকেরা অনায়াসে সেগুলোকে খুঁজে বের করে উপকৃত হতে পারে। অলি আওলিয়াদের বেশভুষা ও পোষাক পরিচ্ছদ জ্ঞানী সুলভ হওয়া চাই যাতে লোকেরা তাদেরকে সনাক্ত করে ধর্মীয় বিষয়াদি জিজ্ঞাসা করতে পারেন। অলি আওলিয়াদের মাযার সাধারণ কবরবাসীদের থেকে উন্নতর হওয়া উচিত যেন লোকেরা সনাক্ত করে ফয়েজ হাসিল করতে পারেন। আল্লাহর অলিগণের মাযার আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ। আল্লাহর নিদর্শন সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন আল্লাহর হুকুম (সুরা হজ্জ্ব, আয়াত ৩০)। কাজেই অলি আওলিয়াদের স্মৃতি নিদর্শন সমূহ ধ্বংস না করে রা করাই ঈমানী দায়িত্ব।
আল্লাহর অলিগণ ও তাঁদের মাযার সমূহ আল্লাহর নিদর্শন এবং আল্লাহর নিদর্শন সমূহ অর্থাৎ ধর্মের নিশান সমূহের সম্মান করার জন্য কোরআনী নির্দেশ রয়েছে।
“অ-মাই ইয়্যুযেম শায়েরাল্লাহি ফাইন্নাহা মেন তাকওয়াল কুলুবে” অর্থ “কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করলে, এ তো তার হৃদয়ের তাকওয়া সজ্ঞাত” (সুরা হাজ্ব, আয়াত ৩২)।
কোরআন মজীদে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন “অলা তাকুলু লিমাই ইয়ূখ্তালু ফি সাবি লিল্লাহে আমওয়াত, বাল আহ্ইয়া উঁ অলা কিল্লা তাশউরুন অর্থাৎ “এবং বলিওনা যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে, তারা মারা গেছে। না, কখনোই নয় বরং তারা জীবিত” (সুরা বাকারা, আয়াত ১৫৪)।
“অলা তাহ্সাবান্নল লাজিনা কুতেলু ফি সাবিলিল্লাহে আমোয়াতান্, বাল আহইয়াউঁ .......... রাব্বিহিত ইউর জাকুন” অর্থাৎ “এবং না, চিন্তাও করোনা, যারা আল্লাহর রাস্তায় কতল হয়েছে তারা মৃত, না, কখনোই নয় বরং তারা জীবন্ত। তারা তাদের রবের নিকট হতে রিজিক পাচ্ছে” (সুরা আল এমরান, আয়াত ১৬৯)।
তিরমিজি শরীফের উল্লেখ করা হয়েছে “রাজানা মিনাল জেহাদে সাগিরা ইলাল জেহাদে কাবিরা” অর্থাৎ আমরা ছোট জেহাদ হতে বড় (আকবর) জেহাদের দিকে ফিরে এসেছি। তাবুকের যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর মহানবী এ উপদেশ সাহাবাদের দিয়েছিলেন। ইমাম গাজ্জালী (রাহঃ) এর “মোকাশেফাতুল কুলুব” নামক বিখ্যাত বইটির ২১৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, একবার জেহাদ হতে একদল মুসলমান সবে মাত্র ফিরে আসায় মহানবী বললেন,“মারহাবা” এবং সেই সঙ্গে এটাও বলে দিলেন যে, ছোট জেহাদ হতে তোমরা বড় জেহাদের দিকে এসেছো। তখন মহানবীকে প্রশ্ন করা হল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! “জেহাদে আকবর” বলতে কি বুঝায়? মহানবী বললেন, “নিজের নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করাকেই বলা হয় “জেহাদে আকবর”। তাই যারা আল্লাহর জন্য কতল হয়েছেন, যারা ফানাফিল্লাহ হয়েছেন, যারা মরার আগেই মারা গেছেন তাদেরকে সবচাইতে সাংঘাতিক উপাধি এবং সম্মানের মুকুট পরিয়ে দিয়েছেন এ বলে যে, তারাই হলো “বাল আহইয়া” “বরং তারা জীবিত”। এত বড় সম্মান পাওয়ার অর্থই হল কোরআনের বর্ণিত সবচাইতে বড় সম্মানটি পাওয়া। কারণ আপেকি অর্থে নয়, কিছুদিনের জন্য নয় বরং সার্বিক অর্থে, সবসময়ের জন্য তথা চিরন্তন জীবন লাভ করেছেন। কোরআনে যেমন আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন তেমনি আবার মহানবীও ঘোষণা করেছেন এ বলে যে “অলিআল্লাহ লা ইয়া মুতু” অর্থাৎ অলীরা কখনোই মারা যায় না”। সুরা কাহাফে সাতজন অলী তিনশত নয় বছর না খেয়ে পর্বতের একটি গুহায় শুয়ে থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ কতদিন না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে? তিনশত নয় বছর পাহাড়ের গুহাতে ঘুমিয়ে ছিলেন, কিন্তু এতটি বছরে তো মাটি দেহগুলোকে খেয়ে ফেলার কথা। মাটিও তো এত শত বছরে দেহগুলো খেতে পারলো না। এতশত বছর পর ঘুম হতে চট করে উঠেই বাজারে গেল কেমন করে? মাত্র হাতে গোনা ক’টা দিন আধ পেট খেয়ে শুয়ে থাকার পর উঠে হাটতে গেলে দু’তিন জনকে ধরে উঠাতে হয় তারপর কত কোকানীর আওয়াজ শুনতে হয়। আর এ সাতজন অলী তিনশত নয় বছর একটানা ঘুমিয়ে থাকার পর যখন ঘুম ভাংলো, সংগে সংগে উঠেই কিছু কথা বলাবলি করে একদম সুস্থ শরীরে বাজারে দিব্য হেটে চললো। এটা স্বয়ং কোরআনের কথা। যাদেরকে কোরআনের ভাষায় মৃত বলো না এবং মৃত বলে চিন্তাও করো না, সেই জীবিতদের জীবিত অবস্থায় যে সব কবরে রাখা হয়েছে সে সমস্ত কবরগুলোকে অন্য দশজন আমাদের মত মানুষদের কবরের সঙ্গে যাতে মিলিয়ে না ফেলি, যাতে ভুলেও তুলনা না করি, যাতে এক রকম মনে না করি, তার জন্য কবর নাম না দিয়ে, বিশেষ সম্মানের সহিত রওজা অথবা মাজার খেতাবখানা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সব রওজা শরীফ ও মাযার শরীফের উপর অবশ্যই দামী গিলাপ বিছিয়ে দেয়া অবশ্য কর্তব্য। আগরবাতি, গোলাপজল, ফুল, সুগন্ধি, খাট ইত্যাদি নানা রকম সাজে সাজানো অবশ্য কর্তব্য। কারণ তারা যে জীবিত শুয়ে আছেন। মৃত বলে চিন্তা করার অধিকার কোরআনে দেয় নি। মৃত বলে চিন্তা করলেই মহাপাপ। তাতে কোরআনকে অস্বীকার করা হচ্ছে। আর কোরআন অস্বীকার করার অর্থ হল কাফের।
ফতোয়ায়ে শামী, ৫ম খন্ড, কিতাবুল কারাহিয়্যাৎ, বাবুল লুব্স্ এর মধ্যে উল্লেখ করা হয়ছে “আল্লামা শামী বলেন, ফতোয়া-ই-হাজ্জাহ্ তে বুযর্গানে দ্বীনের কবরের উপর গিলাফ চড়ানো মাকরূহ বলেও কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু আমাদের অভিমত হচ্ছে বর্তমান যুগে যদি এতদুদ্দেশ্যে গিলাফ চড়ানো হয় যে, এগুলোকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করবে না, বরং এর দ্বারা আউলিয়া কেরামের মর্যাদা সম্পর্কে সাধারণ লোকের অন্তরে বিনয় ও আদব অর্জিত হবে, তবে জায়েয। কারণ পবিত্র হাদীসের ভাষায়, আমলের মূল্যায়ন করা হবে নিয়ম দ্বারা”। তাফসীরে রূহুল বয়ানেও সুরা তাওবায় এ প্রসঙ্গে একই অভিমত “অনুরূপভাবে, আউলিয়া ও সালেহীনের কবরসমূহের পার্শ্বে বাতি জ্বালানো যদি তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে হয়, যেহেতু তার উদ্দেশ্য ভালো সেহেতু জায়েয। আর যদি আউলিয়া কেরামের জন্য তৈল ও মোমবাতি মান্নত করা হয় এবং তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে, তাঁদের কবরের পার্শ্বে সেগুলো জ্বালানো হয়, তবে তাতে নিষেধ করা উচিত নয়। তাছাড়া, হাদিক্বাতুন্নাদিয়্যাহ শরতে তরীকায়ে মুহাম্মদিয়া (মিশর থেকে প্রকাশিত) ২য় খন্ড, ৪২৯ পৃষ্ঠা এবং আল্লামা আবদুল গণি নাবলুসী (রাহঃ) রেসালা-ই-কাশফুন নূর-এও এ অভিমত প্রকাশ করেন।
আল্লাহর ঘরের চারদিকে কেন দামী গিলাপ চড়ানো হয়েছে? গিলাপ যদি কাবা ঘরে না দেয়া হয় তা হলেও কাবার কিছুই যায় আসে না। গিলাপ থাকলেও কাবা আল্লাহর ঘর, আবার গিলাপ না থাকলেও কাবা আল্লাহর ঘর। কিন্তু কাবা ঘরে এ জন্যই গিলাপ চড়ানো হয় যে, কাবা হল মসজিদুল হারাম অর্থাৎ কাবা এবং মসজিদ দুটোকেই বুঝানো হয়। আমরা যাতে দুনিয়ার অন্যান্য মসজিদের মত একই মনে করে না বসি তার জন্য কাবা ঘরে গিলাপ চড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কাবা ঘরের এ গিলাপ চোখে দেখলেই যাতে আমাদের বিবেক ও মন বুঝতে পারে যে, ইহা মসজিদও এবং কাবাও। আমরা যাতে দুনিয়ার অন্যান্য মসজিদের মত মনে করে বিরাট ভুল না করে বসি তার জন্য কাবা ঘরের চারদিকে দামী গিলাপ চড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কাবার এ গিলাপ কিন্তু কাবার জন্য দেয়া হয় নি। দেয়া হয়েছে আমাদের জন্য। এ গিলাপ দেখতে পেলেই আমাদের মন ও বিবেক বুঝতে পারবে যে এটা কাবা ঘর। কাবা ঘরে গিলাপ দেয়া হয় আমাদের মন ও বিবেককে মনে করিয়ে দেবার জন্য। কোরআন শরীফ গিলাপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় এ জন্যই যাতে তা দেখলেই আমাদের মন ও বিবেক সাবধান হয়ে যায়। কোরআন নাপাক অবস্থায় স্পর্শ করা যাবে না।
তাজা ফুলে যেহতেু এক প্রকার জীবন আছে, সেহেতু ওটা তসবীহ তাহলীল করে। ফলে মৃত ব্যক্তির কবরে ফুল দেয়া হলে মৃত ব্যক্তি ছওয়াব পেয়ে থাকে অথবা শাস্তি হ্রাস পায় এবং জিয়ারতকারীগণ এর থেকে সুঘ্রাণ লাভ করে। তাই এটা প্রত্যেক মুসলমানের কবরের উপর অর্পণ করা জায়েয।
মিশরের প্রসিদ্ধ হানাফী মুফতী আল্লামা আবদুল কাদের (রাহঃ) রচিত তাহরীরুল মুখতার গ্রন্থের ১ম কন্ড ১২৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে অনুরূপভাবে সম্মানার্থে ও মর্যাদা প্রদর্শনার্থে আওলিয়ায়ে কেরাম ও বুজুর্গানে দ্বীনের মাজারের উপর ঝালট লটকানো ও মোমবাতি জ্বালানো জায়েজ। কেননা, এ কাজের উদ্দেশ্য মহৎ। আওলিয়া কেরামের মাযারে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে মোমবাতি ও তৈলের মান্নত করাও জায়েয। কেননা এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মাযারের অলীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাঁদের প্রতি ভালবাসার নিদর্শন। এ কাজে নিষেধ করা বা বাধা দেয়া অনুচিত।
আরবের লোকেরা হযরত ছাইয়েদ আহমদ বদভী (রাহঃ) এর উরস শরীফ খুব ধুমধামের সাথে পালন করতেন। বিশেষ করে মদিনা মোনাওয়ারার আলিমগণ হযরত আমির হামযা (রাঃ) এর উরস মোবারক পালন করতেন যাঁর মাজার শরীফ ওহোদ পাড়ারে অবস্থিত। অলি আল্লাহগণ ছাড়াও সাহাবীগণের উরস শরীফ মদিনা শরীফে প্রচলিত ছিল।
“ওলামা, আউলিয়া ও সালেহীন বান্দাদের কবরের উপর মাযার নির্মাণ করা জায়েজ কাজ, যদি এটা মানুষের চোখে তাঁদের মর্যাদাকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে হয়, যাতে করে তারা কবরবাসী ওলীকে তুচ্ছ জ্ঞান না করে” (তাফসীর-ই-রূহুল বয়ান, ৩য় খন্ড)।
হযরত মোল্লা আলী ক্বারী (রাহঃ) ‘মিরকাত শরতে মিশকাত’ এ লিখেছেন “সলফে সালেহীন (পূর্ববর্তী যুগের ইমামগণ) ওলামায়ে হাক্কানী, পীর মাশাইখ প্রমুখ এর কবরের উপর মাযার নির্মাণ করাকে জায়েয বলেছেন, যাতে করে লোকেরা তাঁদের মাযার যিয়ারত করতে পারে এবং সেখানে বসে আরাম পায়”।
ফতোয়াতে শামী, ১ম খন্ডে আছে “ফক্বীহগণের একটা দল বলেছে, “মাযার নির্মান করা বৈধ, যদি ওফাতপ্রাপ্ত পীর মাশাইখ, ওলামা কিংবা সৈয়দ বংশীয়দের থেকে হন”