11/09/2025
আনোয়ার সাঈদ তিতু, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি:-
কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর প্রান্তিক উপজেলা ভূরুঙ্গামারী। সীমান্তঘেঁষা এ জনপদের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ধান, ভুট্টা, তামাক কিংবা সবজি চাষের ওপরই নির্ভরশীল ছিলেন। তবে সম্প্রতি এ জনপদে এক নতুন সম্ভাবনার আলো দেখা দিয়েছে- মাল্টা চাষ। গ্রামের গাছে ঝুলে থাকা থোকায় থোকায় সবুজ-কমলা মাল্টার দৃশ্য এখন মানুষের চোখে নতুন স্বপ্ন বুনছে। কিন্তু সেই স্বপ্নের আঙিনায় ভর করেছে শঙ্কা। কারণ, প্রচুর ফলন হলেও বাজারজাতকরণের অভিজ্ঞতার অভাব ও সরকারি উদ্যোগের ঘাটতিতে মাল্টা চাষিরা এখন পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।
পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি গ্রামের উদ্যোক্তা আতিকুর রহমান খোকনের স্বপ্নের বাগান আজ আলোচনার কেন্দ্রে। ২০২২ সালে তিনি স্ত্রী জুরাইরিয়ার সহায়তায় মাত্র ০.২৪ একর জমিতে গড়ে তোলেন মাল্টার বাগান। একসঙ্গে বারি-১, বারি-২, বারি-৩ ও বারি-৪ জাতের মাল্টা রোপণ করেন তিনি। তিন বছরের শ্রম আর প্রায় দুই লাখ টাকার বিনিয়োগে এবার বাগানে এসেছে আশাতীত ফলন। সবুজ ডালে ঝুলছে সোনালি মাল্টা, যা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু ফলনের আনন্দটা বেশি দিন টেকেনি। কারণ খোকনের কাছে নেই কোনো পাইকারি বাজারের যোগাযোগ কিংবা বিক্রির অভিজ্ঞতা।
খোকন বলেন, খুচরা বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকার মত পেয়েছি। অথচ সঠিক দামে বিক্রি করতে পারলে অন্তত এক লাখ বিশ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পাওয়া যেত। বাজার না থাকায় মাল্টা গাছে পেকে ঝরে পড়ছে। তখন মনে হয়, এত কষ্ট করে এই বাগান করলাম কেন? খোকনের স্ত্রী জুরাইরিয়া কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। স্বামীর এই বাগান তার কাছেও এক স্বপ্নের জায়গা। তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামী দিন-রাত খেটে এই বাগান গড়ে তুলেছেন। আমি পড়াশোনা শেষ করতে চাই, আর সেই পথে তিনি সবসময় উৎসাহ দেন। বাগানে গেলে মন ভরে যায়।
রাসায়নিকমুক্ত ফলের সুগন্ধে মনে হয়, সত্যিই আমরা কিছু করতে পেরেছি। কিন্তু বিক্রি ও রোগবালাই দমনে সরকারি সহযোগিতা না থাকলে এই স্বপ্নের বাগান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। বাঁশজানি গ্রামের মানুষ জানালেন, খোকনের বাগানের মাল্টা সুস্বাদু ও রাসায়নিকমুক্ত। তারা বিশ্বাস করেন, যদি বাজারজাতকরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়, তবে শুধু খোকনই নয়-এলাকার আরও অনেক যুবক এই চাষে ঝুঁকবেন।
এতে একদিকে যেমন বেকারত্ব কমবে, তেমনি নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। একজন স্থানীয় যুবক বলেন, আমরা শহরের দোকান থেকে যে মাল্টা কিনি, তার চেয়ে খোকনের মাল্টা অনেক মিষ্টি। অথচ বাজার না থাকায় তিনি ঠিকমতো বিক্রি করতে পারছেন না।
সরকার বা সংশ্লিষ্ট দপ্তর যদি সাহায্য করত, আমরা নিজেরাও মাল্টা চাষে আগ্রহী হতাম। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল জব্বার বলেন, এ বছর ভূরুঙ্গামারীতে ১৫ হেক্টরের বেশি জমিতে মাল্টা চাষ হয়েছে। পাথরডুবির মাল্টা বাগান সম্পর্কেও আমরা জানি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বাজারজাতকরণ বিষয়ে উদ্যোক্তাকে সহায়তা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও দ্রুত বাগানটি পরিদর্শনে যাব। তিনি আরও বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলতে পারে মাল্টা চাষ। তবে বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরকারি সহযোগিতার অভাব থাকলে সেই স্বপ্ন ব্যাহত হবে। এ কারণে আমরা উদ্যোক্তাদের পাশে থাকতে চাই।
ভূরুঙ্গামারীর মাল্টা চাষ এখন সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একজন যুবক ও তার পরিবারের স্বপ্ন আজ পুরো এলাকার মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে। কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে হলে দরকার সরকারি সহায়তা, বাজারসংযোগ ও সঠিক দিকনির্দেশনা। নইলে মাল্টার সোনালি স্বপ্ন অচলাবস্থার অন্ধকারেই হারিয়ে যাবে। Khabar News #