24/04/2024
🌼 #যুগপুরুষোত্তম_ও_আচার্য_পরম্পরা 🌼
"মানুষের জীবনে stay (স্থিতিভূমি) -র দরকার। যার উপর দাঁড়ায়, যে বয়, রাখে, পালে---- তার সব দিয়ে। যেমন আমি আছি, তোমরা আছ। তোমাদের কষ্ট হওয়া কঠিন, যতদিন আমি আছি। আবার বড়খোকা যেমন আছে, যেমন দেখছি ওকে। আমি যাওয়ার পর সে থাকলে কিংবা পরে তার মত আর কেউ যদি হয়ে ওঠে, তোমরা কষ্ট পাবে না বলে ভরসা হয়।"
('আলোচনা-প্রসঙ্গে', চতুর্দশ খণ্ড)।
পরমদয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর এই কথাগুলো বলেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর।
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে, দেওঘরে পুরুষোত্তম লীলা পর্ব্বের তখন সূচনা পর্ব্বই বলা যেতে পারে। ঠাকুর তখনই পুরুষোত্তম কেন্দ্রিক ও অনুশাসিত কৃষ্টি ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক ও চেতনার স্থিতিভূমি চিহ্নিত করে দেন। যে স্থিতিভূমিকে ভিত্তি ধরে ভবিষ্যৎ মানুষ ও তার পরবর্ত্তী প্রজন্মকে এক পরম নির্ভরতায় জীবন বৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেবে, সাহায্য করবে। ঠাকুর শুধু স্থিতিভূমির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হননি। সেই স্থিতিভূমির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য কেমনতর---- সেটা ঠাকুর নিজেই আমাদের সামনে নিজেকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরে বললেন, 'যেমন আমি আছি।' আবার পরমুহূর্ত্তে, একই সঙ্গে তাঁরই অবর্ত্তমানে, ভবিষ্যতের স্থিতিভূমি কে হবেন, সেটাও পরম ভরসায় সুনিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করলেন। বললেন, তাঁর আদরের বড়খোকার কথা। এরপরেও পরবর্ত্তী ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিলেন ঠাকুর। এটা শুধু একবার নয়, বহুবার ঠাকুর এভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং বলেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কারণ ঠাকুর এবার পুরুষোত্তম হিসাবে, খোদ স্রষ্টা-মানুষ রূপে নেমে এসেছেন। ঠাকুরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুদূরপ্রসারী। তিনি নিজেই বলেছেন, "আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আরো থেকে আরোতরভাবে---- finate to infinite."
('আলোচনা-প্রসঙ্গে')।
তাই পরমদয়াল সেই চল্লিশের দশক থেকে পুরুষোত্তম কেন্দ্রিক পরিপোষণী বিবর্ত্তনের দিশা ও দর্শন আমাদের সামনে তুলে ধরেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ মানুষের স্থিতিভূমি হিসাবে জ্বালিয়ে দেন পুরুষোত্তম পরবর্ত্তী ঈশী বোধনার জীয়ন্ত প্রদীপ। যে জীয়ন্ত প্রদীপ স্বরূপ পরিব্যক্ত পরমপুরুষের আদেশ নির্দেশ মেনে চলে বর্ত্তমান ও ভবিষ্যৎ-এর মানব সমাজ তাত্ত্বিক বিকৃতি ও বিভ্রান্তিকে এড়িয়ে সঠিক পথে চলতে অনুপ্রাণিত হবে। এই পুরুষোত্তম চেতন ধারার অনুক্রমণ ও অনুগমন-এর তাৎপর্য্যকে গুরুত্ব দিয়ে ঠাকুর অনেক সময় বলেছেন, "living continuity থাকা বিশেষ দরকার।"
('আলোচনা-প্রসঙ্গে', একাদশ খণ্ড)।
'জীবের তরে, নররূপ ধরে' ঠাকুর এবার পুরুষোত্তম রূপে এসেছেন। এর আগেও 'যুগ পুরুষোত্তম' এই আমাদের মত মানুষের কল্যাণের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছেন। কিন্তু ঠাকুর এবার এসেছেন সুদূরপ্রসারী চিন্তা-কর্ম ও লক্ষ্য নিয়ে। আর এই সমগ্র চিন্তা-কর্ম ও লক্ষ্যের মূল বা প্রধান উপজীব্যই হল মানুষ। কি ভাবে, কোন পথে মানুষের মঙ্গল সাধন করা যায়, একটি মানুষও যাতে দুর্দ্দশা-দুর্ব্বিপাক-বিপর্য্যয়ে পড়ে কষ্ট না পায়, এই নিয়েই ছিল ঠাকুরের সর্ব্বক্ষণের চিন্তা। আবার এই চিন্তা থেকে, ঐ বিপদগ্রস্ত মানুষের পরিস্থিতিকে আত্মবোধে বিশ্লেষণ করে ঠাকুর সমস্যা উত্তরণী বা সমাধানী পথও বাতলে দিয়েছেন। ঠাকুর একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, "এটা ঠিক জেনো external nature (বাইরের প্রকৃতি) মানুষের বাঁচার পথে যে দুঃখের সৃষ্টি করে, তার কিন্তু পার আছে। বিজ্ঞানের দৌলতে সে পথ আজ মানুষের অনেকখানি করায়ত্ত। কিন্তু স্বেচ্ছায় মানুষ নিজেই নিজের দুঃখ ডেকে নিয়ে আসলে, তা ঠেকাবে কে বল ? তা ঠেকাবার জন্যই তো পরমদয়াল দয়াপরবশ হয়ে মানুষের মূর্ত্তি ধরে মানুষের মধ্যে আসেন। কিন্তু মানুষ যদি তাঁকে না ধরে, তাঁর পথে না চলে, তাই বা তিনি কি করতে পারেন। কিন্তু, এটাও ঠিক, মানুষ হয়তো জেনেও জানে না, বুঝেও বোঝে না, তাই ভুল করে।"
(আলোচনা-প্রসঙ্গে, দশম খণ্ড, ২৮ জানুয়ারী, ১৯৪৮ ইং)।
তাই আমাদের জীবনের সব ধরণের বিপর্য্যয় থেকে বাঁচানোর জন্য ঠাকুর 'পুরুষোত্তম' হয়ে এসেছেন। তিনিই রক্ত মাংস সঙ্কুল আমান ঈশ্বর। আবার তিনি সর্ব্বপরিপূরণকারী। লোকজীবনের ধাতা ও ত্রাতা। তাঁকে ভালবেসে, তাঁর আদেশ-নির্দেশ জীবন চলনার প্রতিটি কাজে মূর্ত্ত করার মধ্য দিয়েই মানুষ শক্তি ও জীবনের ছন্দ খুঁজে পায়। কারণ, মানুষের জীবনের আত্মিক সম্বেগের উৎস-ই হচ্ছেন ঈশ্বর। যার মূর্ত্ত প্রতীক হলেন পুরুষোত্তম। তিনি যখন ধরাধামে অবতীর্ণ, তখন তিনিই ইষ্ট, তিনি আচার্য্য-সদ্গুরু। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন----
'পুরুষোত্তম আসেন যখন
ইষ্ট, আচার্য্য তিনিই গুরু
তিনিই সবার জীবন- দাঁড়া,
তিনিই সবার জীবন-মেরু।'
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে কোনও না কোনভাবে একজন জীবন্ত গুরু বা ইষ্ট অপরিহার্য্য। আমাদের সত্তার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে জীবন্ত কাউকে অবলম্বন করে ক্রমবিবর্ধনের পথে এগিয়ে যাওয়া। সত্তা এটিই চায়। জন্মের পর থেকেই শিশু তার মা-বাবাকে আশ্রয় ও অবলম্বন করে বড় হয়ে উঠে। সেই মা-বাবাকে ভিত্তি করেই পরবর্ত্তীকালে মানুষ তার ক্রমপরিণত চিন্তা ও চলনের প্রেক্ষিতে আরও উন্নত কোনও অবলম্বন চায়, যাকে আশ্রয় করে সে আরো এগিয়ে যেতে পারবে। সেই অবলম্বন বা আশ্রয় যত বেশি উন্নত, শুভদর্শী ও কল্যাণ শ্রোতা হবে, অবলম্বনকারীর সত্তা সম্পোষণী শক্তিও তত বেশি হবে। তাই ব্যক্ত প্রিয়পরম বা পুরুষোত্তম-ই সকলের উপাস্য ও আরাধ্য। তিনি বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ আচার্য্য।
কিন্তু বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মাণ আচার্য্য অর্থাৎ যিনি পুরুষোত্তম, তিনি আচরণশীল হলেও তাঁর আচার-আচরণ, অভিব্যক্তি, ইত্যাদি সব সময় সর্ব্ব জনসাধারণের সহজ বোধগম্য হয়ে ওঠে না। এর কারণ হল, তিনি যে স্তরে বা বোধের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, গ্রহীতারা সেই বোধের কাছাকাছি অবস্থান না করলে---- পুরুষোত্তমের ইচ্ছে বা অভিব্যক্তি সঠিক অনুধাবন করাও মুস্কিল। তাই পুরুষোত্তম যখন আসেন, তখন তিনি তাঁর সঙ্গে তেমনতর উত্তর সাধক, পাবক পুরুষ, ঈশ্বর কোটি স্তরের মানুষদের নিয়ে আসেন। ঠাকুর এবার তাই 'ভগবৎ প্রদত্ত প্রতিনিধি' শ্রীশ্রীবড়দাকে তাঁর ঔরসজাত ও কৃষ্টিজাত সন্তান হিসাবে নিয়ে এসেছেন। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁকে নিয়ে এসেছেন তাঁরই বাণীর বাস্তব উদাহরণ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য, ইষ্ট কেন্দ্রিক চলন কেমনতর হওয়া প্রয়োজন---- সেটা আচরণের মধ্য দিয়ে সহজ-সুন্দরভাবে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। শুধু তাই নয়, শ্রীশ্রীবড়দার জীবন চলনার গতি-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছা পরিপূরণী ও তৎগতিসম্পন্ন ছিল বলেই ঠাকুর বলতেন, "বড়খোকার সঙ্গে থাকা মানেই আমার সঙ্গে থাকা।"
এর মানে এই নয় যে, শ্রীশ্রীবড়দা পুরুষোত্তম হয়ে গেছেন। বরং শ্রীশ্রীবড়দা আচরণের মধ্য দিয়ে ঠাকুরত্ব অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। জীবন্ত সত্যানুসরণ হয়ে উঠেছেন।
ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, 'দেখ শুধু পড়াশোনাতে কিছু হয় না। বাজনার বোল লোকে মুখস্ত বেশ বলতে পারে, হাতে আনা বড় শক্ত'
('শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত', পৃষ্ঠা ৩১৯)।
ঠাকুর বা পুরুষোত্তমের বাণী এভাবে মুখস্থ বলা খুব সহজ। অনেক সময় এই সব বাণী ও মতাদর্শকে অনেকে জীবন-আরাধ্য হিসাবে গণ্য করে চলতে চায়। এটাকেই বলা হয়---- ঋষি বাদ দিয়ে ঋষিবাদের উপাসনা। ঠাকুর এমনতর মতবাদ বা মতাদর্শের পক্ষপাতী কোনও কালেই ছিলেন না, বরং কঠোর বিরোধী ছিলেন। অতীত ইতিহাসেও দেখা গেছে, যখনই মানুষ কোন মতাদর্শকে আরাধ্য বস্তু হিসাবে ধরে নিয়েছে---- তখনই বিরোধ, সংঘাত, অনৈক্য মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মূল আদর্শ পুরুষের ইচ্ছে পরিপূরণের বাসনার চাইতে নিজের বৃত্তি রঙিন চাহিদার পরিপূরণই তখন প্রধান হয়ে উঠেছে। এর প্রধান কারণ হল, কোন মতাদর্শের উপর মানুষের কোনদিন সত্যিকার ভালবাসা জন্মাতে পারে না। কোনও ধরণের কোনও প্রেরণা দিতে পারে না। সাময়িক কিছু উত্তেজনা আনতে পারে এবং প্রকৃত দিশা না থাকলে সেই উত্তেজনা ধ্বংস বা বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই যে কোন মতাদর্শ, সেটা ব্যক্তি জীবন হোক, অথবা সমষ্টি জীবন হোক---- সেটাকে বাস্তবায়িত করতে হলে একটি living guide-এর একান্ত প্রয়োজন। যাকে ভালবেসে সৃষ্টি হতে পারে প্রেরণা ও শক্তি। এই জন্যই বোধহয় বিশ্ববিশ্রুত বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক Dr. Alexis Carel বলেছেন, 'It is impossible to love an abstraction. One with sacrifice oneself for one's leader but not an idea. Man will never enthusiastically obey the laws of rational conduct, unless he considers the laws as the commands of a personal God. We need a God, who hears us, loves us and responds to us.'
ঠাকুর ছিলেন বৈশিষ্ট্যপালী আপূরয়মান---- সবার পরিপূরণকারী। ঠাকুর লোক কল্যাণে বর্ত্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে হাজার হাজার বাণী দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেছেন। ঠাকুর নিজেই বলেছেন, "আর কিছু বলার আছে বলে মনে হয় না।" এখন এই লক্ষাধিক প্রশ্নের জবাব অথবা তাঁর শ্রীমুখ নিঃসৃত বাণী অনুধাবন করে বিশ্লেষণ করে কি চলা সম্ভব? তাছাড়া অতীতে যেমন প্রেরিত পুরুষদের বাণীর বিকৃত ব্যাখ্যা হয়েছে, এখনও আমরা যদি প্রবৃত্তি রঞ্জিতভাবে ঠাকুরের বাণীর বিকৃত ব্যাখ্যা করে চলতে চাই, তাহলে তো আমাদের ফের বিপর্য্যস্ত হতে হবে। ঠাকুর সর্ব্বজ্ঞ, সর্ব্বকারণের কারণ। তাই দয়াল প্রভু এ ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন এবং আমাদের বললেন, "একটা নাটক পড়ে যা বোধ করা যায়, আর সুদক্ষ অভিনেতারা যখন তা অভিনয় করে---- তা দেখে যা বোধ হয়---- এই দুয়ের মধ্যে কিন্তু আসমান-জমিন ফারাক। সেই জন্য আচরণ সিদ্ধ আচার্য্যকে ধরতে হয়। শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর সঙ্গ ও সেবা করতে হয়। তাঁর প্রত্যেকটি চলা-বলা-করা ও অভিব্যক্তির ভিতর ধর্ম হাত-পা মেলে হেঁটে বেড়ায়।"
('আলোচনা-প্রসঙ্গে', ষষ্ঠ খণ্ড, ২৬/১২/১৯৪৫ ইং)। শ্রীশ্রীঠাকুর তাই এবার সৃষ্টি করলেন 'আচার্য্য-পরম্পরা' এবং স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, বললেন----
'পুরুষোত্তমের অবর্ত্তমানে
তঁন্নিষ্ঠ, তঁত্তপা আচার্য্যই স্মরণীয়
আবার, আচার্য্যও যখন না থাকেন
তখন পুরুষোত্তম-নিষ্ঠ স্বধ্যায়ী গুরুই আশ্রয়নীয়,
ফল কথা, আচার্য্য ও স্বাধ্যায়ী গুরুর
গুরুত্বের উৎসই হ'ল
পুরুষোত্তম-নিষ্ঠা ... ... ... ... ।'
('আদর্শ-বিনায়ক', ৬৪)
পরমদয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর লৌকিক দেহাবসানের অনেক পূর্ব্বেই এই আচার্য্য প্রথা ও পরম্পরা চালু করে দিয়ে যান এবং পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দাকে-ই সর্ব্বপ্রথম প্রধান আচার্য্য পদে অভিষিক্ত করেন শ্রীশ্রীঠাকুর। সঞ্চারিত করেন তাঁর সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তি। বলা বাহুল্য, এই আধ্যাত্মিক শক্তির সঞ্চারণ পর্ব্ব শ্রীশ্রীবড়দার উপর সমর্পিত হচ্ছিল ১৯৫৫ সালের আগে থেকে---- যখন ঠাকুর সম্পূর্ণ চলৎশীল অবস্থায় ছিলেন। আমাদের দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণের চিন্তা মাথায় রেখে ঠাকুর অনেক আগে থেকেই শ্রীশ্রীবড়দাকে সৎসঙ্গের পরবর্ত্তী সঙ্ঘাধীশ হিসাবে গড়ে তোলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের দিব্য জীবন-দর্শন এবং তাঁর লোক কল্যাণবাহী মিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপুরণে ----এই আচার্য্য প্রথা এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কারণ, গুরু পুরুষোত্তম যখন রক্ত মাংস সঙ্কুল দেহে ধরাধামে বর্ত্তমান থাকেন, তখন তিনি একাধারে ইষ্ট এবং আচার্য্য। তাঁর প্রণীত নীতি-বিধির আচরণ নিজের জীবনে সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা একমাত্র তাঁর সঙ্গ-সান্নিধ্যে গেলেই ধরা পড়া সম্ভব। কিন্তু পুরুষোত্তমের লৌকিক দেহাবসানের পর, পুরুষোত্তমের নির্দশিত নীতি-বিধি নিজের জীবনে সঠিক পালিত হচ্ছে কিনা, তা নিরূপণের জন্য তখন প্রয়োজন আচার্য্যের সঙ্গ-সান্নিধ্য ও নির্দেশ। কারণ, তখন আচার্য্যের মধ্যেই পুরুষোত্তম চেতন ধারা বর্ত্তমান থাকে। তিনিই ভ্রান্তি বিমোচনের একমাত্র উপায়। তখন আচার্য্য নিষ্ঠা না থাকলে ইষ্ট নিষ্ঠাও থাকে না। শ্রীশ্রীঠাকুর এই জন্যই বলেছেন----
'সব তপের-ই একটি পথ
আচার্য্যনিষ্ঠ অনুসরণ তেমনি করেই বোধটি গজায় ধরে ও বোধে করে যেমন।'
তাই পুরুষোত্তমের চেতন-প্রতীক আচার্য্যকে বাদ দিয়ে চলা মানে আপন খেয়াল ও বৃত্তিমাফিক চলা। এটা ধর্ম্ম পালনের নামে ধর্ম্মদ্রোহিতার সামিল। জীবনকে বৃদ্ধির পথে, ব্যাপ্তির পথে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্ত্তে বিকৃতি ও বিভ্রান্তির অভিযানে নিজেকে সমর্পণ করার সামিল। এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুরের একটি সতর্কীকরণ খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন----
'সৎ-আচার্য্যবিহীন
অর্থাৎ সৎ-আচার্য্যে
সক্রিয় নিষ্ঠাবিহীন যারা
এক কথায়, অযুক্ত যারা----
তারা উপযুক্ত সন্ধিৎসা ও বোধনার অভাবে
নিজেদের ভাল-মন্দ বুঝতে পারে না
অন্যের বেলায় তো কথাই নেই
তাই, তারা
নিজেকে সংস্কৃত করে তুলতে তো
পারেই না----
সার্থক সঙ্গত বিন্যাসে
বরং তাদের আত্ম-সংস্কার-বুদ্ধি
প্রায়শঃই ভালর ছদ্মবেশে
কু-এর সাংঘাতিক রূপকেই
আবাহন করে থাকে,
আর, লোকের ভিতর
চারিয়েও দিতে চায় তাই----
আত্মপ্রতিষ্ঠার দাম্ভিক গৌরব লোলুপতায় তারা,
ভালমন্দের জঙ্গলা-জঞ্জাল থেকে
ভালকে বেছে নিয়ে, চিনে
জীবনে প্রয়োগ করতে
একটা অনাসৃষ্টিরই আমদানী করে থাকে
খুব সাবধান থেকো, তাদের থেকে।'
('আচার-চর্য্যা', ১ম খণ্ড)
দ্বাপর যুগে যুগপুরুষোত্তম হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসেছিলেন। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর দাঁড়িয়ে তিনি মানুষের বাঁচার বিধান দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহাবসানের কিছুদিন পরই সমাজে ভয়াবহ বিপর্য্যয় নেমে আসে। খোদ যদু বংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ঠাকুর এবার এসেছেন মানুষের জীবনের মূল বুনিয়াদকে শক্ত করে আগামী কয়েক হাজার বছরব্যাপী তাঁর স্বস্তি অভিযানকে অক্ষত ও অবিকৃত রাখতে। শুধু একটি প্রজন্ম নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা যাতে আরো থেকে আরোতরভাবে পুরুষোত্তমের ভজনা করে ক্রমোন্নতির পথে ধাবিত হই, এইজন্য পুরুষোত্তম অনুশাসিত তন্নিষ্ঠ, তঁত্তপা কৃষ্টিজাত সন্তানদের 'লিভিং আইডিয়াল' হিসাবে বা মূর্ত্তমান আদর্শ হিসাবে আমাদের অনুসরণ করতে বলেছেন।
শ্রীশ্রীঠাকুর একদিন শরৎদার (হালদার) এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, "আদর্শ বিগ্রহ মানে বিশেষ রূপে গ্রহণ করে আছে যে, স্ববৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অচ্যুত নিষ্ঠায় তাঁকে পরিপূরণ করে চলেছে যে। আর সেটা তাঁর ইষ্টেরই সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে হলে ভাল হয়। কারণ ঐ ইষ্টের blood (রক্ত)-টা তাঁর সন্তান-সন্ততিরাই বহন করে। বিগ্রহ তাঁর পুত্র-প্রপৌত্রাদির মধ্যেও হতে পারে চলনা ঠিক থাকলে।"
('আলোচনা-প্রসঙ্গে', ১৮/৩/১৯৬২ ইং) ----অর্থাৎ ঐ আদর্শ বিগ্রহ-ই হলেন পুরুষোত্তম পরবর্ত্তীকালের মূর্ত্ত আদর্শ। আবার তিনিই আচার্য্য। এখন আমাদের লক্ষ্য ও করণীয় হল---- to obey and to follow the teacher (আচার্য্যকে মান্য করা এবং অনুসরণ করা), to follow (অনুসরণ) মানে---- to meterialise his wishes (তাঁর ইচ্ছেগুলিকে বাস্তবায়িত করা), ('আলোচনা' ---- আলোচনা-প্রসঙ্গে, চৈত্র- ১৩৭২ বাং)।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা তাই শ্রীশ্রীঠাকুরের এই ভাবাদর্শের অনুসরণে তাঁরই জ্যেষ্ঠাত্মজ পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীদাদাকে পরবর্ত্তী প্রধান আচার্য্য পদে মনোনীত করে যান এবং শ্রীশ্রীদাদাও একই রূপে তাঁর জ্যেষ্ঠ আত্মজ পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবাবাদা কে পরবর্তী প্রধান আচার্য্য পদে মনোনীত করে যান। শাস্ত্রে আছে বংশের বড় ছেলেই হয় ব্রহ্ম জ্ঞানের অধিকারী। শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীবড়দার ও শ্রীশ্রীদাদার আধ্যাত্মিক শক্তি এখন প্রধান আচার্য্যদেব শ্রীশ্রীবাবাই দাদার মধ্যে সর্ব্বদা সঞ্চারিত হচ্ছে। তিনিই বর্ত্তমানে পুরুষোত্তমের চেতন ধারা। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রধান আচার্য্যের ভিতরে সুপ্ত থেকেও চেতন প্রভাবে লীলা করছেন। তিনি সব সময় ঠাকুরময় অর্থাৎ শ্রীশ্রীঠাকুরের ইপ্সিত লক্ষ্য পূরণে সদা-জাগ্রত।
পরমপূজ্যপাদ আচার্য্যদেব শ্রীশ্রীবাবাই দাদার মধ্যে আমাদের প্রিয়পরম পুরুষোত্তমের ইচ্ছার মূর্চ্ছনা তাঁর সঙ্গ-সহচর্য্যে খুব সহজেই আমরা উপলব্ধি করতে পারছি প্রতিনিয়ত। বর্তমানে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে দীক্ষার যে প্লাবন উঠেছে, সৎসঙ্গের প্রচার ও প্রসার যে ভাবে দ্রুত ব্যাপ্তি লাভ করছে, এর পেছনে রয়েছে প্রধান আচার্য্যদেবের ঐকান্তিক ইচ্ছে। পরমদয়াল আচার্য্যদেবের মধ্য দিয়ে লীলা করছেন বলেই সেটা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ঠাকুরের সাথে যুক্ত থাকলে, ঠাকুর যে দয়া করেন, তাঁর মধ্যে জীবন্তভাবে ফুটে ওঠেন, সেটাও ঠাকুর ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন—
'দয়া পরিস্ফুটিত হয়
বা ফুটন্ত হয়ে ওঠে সেখানে
তেমনি ততই
দয়ী কর্ম্ম-নিরতি যেখানে
যতই নিখুঁতভাবে নিষ্পন্ন।'
('বিবিধ-সূক্ত', বিধি, বাণী-সংখ্যা ৩৭)
তাই তো আমরা যারা পরমদয়ালকে চর্ম-চক্ষু দিয়ে দর্শন করতে পারিনি, তাঁর সম্বন্ধে কোন বোধ ফুটে ওঠেনি, ভালবাসার কোন পরশ পাইনি— আচার্য্যদেব শ্রীশ্রীবাবাই দাদার স্বতঃউৎসারিত মিষ্টি কথার সুরে, আমরা যেন সেই প্রিয়পরমের সোহাগ ভরা কণ্ঠস্বরের সুর শুনতে পাই। কিছুদিন আগে পূজ্যপাদ দাদা রোগপীড়িত একটি মা'কে বলেছিলেন, "এত ভাবছিস্ কেন? আমি তো আছি।" শ্রীশ্রীবাবাই দাদার অদ্ভূত স্নেহ মাখানো কণ্ঠে এই কথা শুনে, আমাদের সেই দয়াল ঠাকুরের ইং-১৯৪৮ সালের কথা মনে পড়ে যায়, "এই আমি যেমন আছি— তোদের কোনও কষ্ট হবে না।" —সে কথা পড়েছিলাম বইতে— আর এবার সেই পরম সোহাগ ভরা স্বর শুনতে পেলাম, প্রধান আচার্য্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার কণ্ঠে। মনে হল, এতো সাত্ত্বিক পুরুষোত্তম ঘরানা। এটাই তো মানুষের প্রকৃত স্থিতিভূমি। তাই তো প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই পুরুষোত্তম লীলা নিকেতনে ছুটে আসে। ছুটে আসে আচার্য্য দর্শনে। খোঁজ পায় জীবনের দাঁড়া, জীবনের পথ, দিশা। জীবনের নতুন স্বাদ, গন্ধ, ও ঐশ্বর্য্য। এটাই তো প্রত্যেকের জীবনের বড় প্রাপ্তি। পরমদয়াল এই জন্যই বোধহয় বলেছেন—
'জীবন পথের একটি দাঁড়া
যে আচার্য্য উজান ধায়
সেই তো মোদের জীবন-মেরু
রাখেও সেমনি সদ্দীপনায়।'
(আলোচনা, জৈষ্ঠ-১৩৭৪)
ইষ্ট -গুরু পুরুষোত্তম
প্রতীক গুরু বংশধর
রেত- শরীরে সুপ্ত থেকে
জ্যান্ত তিনি নিরন্তর।
দীক্ষা নিয়ে শিক্ষা ধরিস
আচার্য্যকে করে সার,
আচরণে বোধ চয়নে
জ্ঞানের সাগর হ'না পার।"।১৭।
('অনুশ্রুতি' - ২য় খন্ড, অধ্যায়- শিক্ষা)
🙏জয়গুরু 🙏 বন্দে পুরুষোত্তমম্ 🌼