25/10/2025
সকাল থেকে রান্নাঘরে হিমশিম খাচ্ছে শ্রমণা। সারা সপ্তাহ অফিসের চাপ , বুবুনের পড়াশোনা , সার্থকের খুঁটিনাটি জিনিস হাতে হাতে জোগানো , শ্বশুর - শাশুড়ির বদমেজাজ আর হুকুম সহ্য করা - গত দশ বছর ধরে তার জীবন ঘড়ির কাঁটার মতো একই পথে ঘুরে যাচ্ছে। সার্থক বাড়ির একমাত্র ছেলে - তাই একই সাথে লৌকিকতা সামলানোর দায়িত্বটাও শ্রমণার ঘাড়ে এসেই পড়ে ! রবিবার এলেই তাই তার আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। প্রত্যেক রবিবারেই কোনো না কোনো অতিথি সমাগম ঘটে এই বাড়িতে । সার্থক আর তার জন্য কোনো নিজস্ব সময় বাঁচে না। ছোট্ট বুবুন সংসারের রাজনীতি এখনও বোঝে না - মা বাবা কেন ছুটির দিনেও তাকে নিয়ে একটু বেরোতে পারে না, এই নিয়ে তার অনুযোগের অন্ত নেই ! মাঝে মাঝে বড্ডো অসহায় লাগে নিজেকে - এই সংসার করার জন্যই কি মানুষ ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখে , লালায়িত হয় ! অফিসটাই তার কাছে মরুদ্যান এখন ! তাই নিয়েও তার শাশুড়ির অনুযোগের অন্ত নেই। তাঁর মতে , মেয়েমানুষ সংসার না সামলে রাতদিন ধ্যাতাং ধ্যাতাং করে নাচলে সেই সংসারে অলক্ষ্মী লাগে ! এঁরা অন্য কোনো দুনিয়ার মানুষ কিনা - মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় তার !
আজ শ্রমণার দুই ননদ তাদের পরিবার নিয়ে আসছে। এরা প্রত্যেক মাসেই দু - একবার আসে। শাশুড়ির এরাই চোখের মণি। আর, ওরা এলে পান থেকে চুন খসার জো নেই ! শ্রমণা ভেবেছিল , এই সপ্তাহে তার বৃদ্ধ বাবাকে একবার দেখে আসবে - বড়ো একা তিনি ! কিন্তু , এখন এদের ফেলে কিভাবে যায় ! এই সকালেই সার্থক বাজার সেরে ফিরলো । শাশুড়ির হুকুম মত চিংড়ি , পাবদা আর মাংস - সবই এনেছে। রান্নাঘরের দরজায় ব্যাগটা নামিয়ে রেখে সে শ্রমণাকে বললো - " চটপট রান্নাটা সেরে নাও দেখি - তোমাকে তারপরে একটা কথা বলবো ! "
-" বৌমা , চিংড়িমাছটা কিন্তু ফুলকপি দিয়ে করবে ! মিলি আর বিনয় - দুজনেই খুব ভালোবাসে !" শাশুড়ি - মা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
ময়দা মাখতে মাখতে বাঁহাত দিয়ে অবাধ্য চুলের গোছা পেছনে ঠেলে দিলো শ্রমণা - মাথা হেলিয়ে শাশুড়ির কথার জবাব দিলো। বুবুনের দুধের গ্লাসটা পড়েই আছে , ছেলেটাকে সেটা দিয়ে আসার সময়ও পাচ্ছে না সে !
-" জলখাবারটা একটু হাত চালিয়ে করো - অমনি বাবার চা - টাও দিয়ে এসো ! জানোই তো , খবরের কাগজ আর চায়ের কাপ, এই দুটো না হলে তোমার বাবার সকালটাই মাটি! সুমতির কি হলো আবার - বাসি ঘরেই মেয়ে - জামাই বসবে নাকি !" গজগজ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে চললেন তিনি । সত্যি , সুমতি রোজ এতো দেরি করে ! কখনই বা ঘরদোর পরিষ্কার করবে আর কখনই বা কুটে - বেটে তাকে রান্নার কাজে একটু সাহায্য করবে !
শ্বশুরকে চা দিয়ে এসে এতক্ষণে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দেয় শ্রমণা । সার্থকের বিশেষ চায়ের নেশা নেই - এই এক বাঁচোয়া ! আলু - চচ্চড়ি হয়ে এলো। একদিকের বার্নারে ভাত আর অন্যদিকে একটা নিরামিষ তরকারি বসালো সে। নীচে গাড়ির শব্দ হলো না ! এসে গেছে সব - গোটা বাড়ি কোলাহলমুখরিত ! গদগদমুখে শাশুড়ি বাইরে এসে দাঁড়ালেন।
-" বৌমা , ওরা এসে গেছে , জল - মিষ্টি দাও ওদের ! বিনয় - অনল, তোমরা জলখাবার খেয়ে চা খাবে তো !"
পাবদা মাছটায় নুন - হলুদ মাখাচ্ছিল সুমতি । চাপা গলায় দাঁত চিপে বলে উঠলো -" ন্যাকা ! প্রতি সপ্তাহেই প্রায় আসছে , তবু আদিখ্যেতা দ্যাখো না ! বউটাকে একটু দম নিতে দেয় না !" " চুপ , চুপ !" ঠোঁটে আঙ্গুল চাপা দেয় শ্রমণা ।
-" ও বৌদি ! কি মেনু গো আজ ? ও বাবা ! চিংড়িও করছো ? ফুলকপি দিয়ে করো না ! জলখাবারটা এবার সার্ভ করে দাও , পেটে ছুঁচো দৌড়চ্ছে ! আমরা সবাই মায়ের ঘরে আছি !" মিলি একবার রান্নাঘর জরিপ করে আবার মায়ের ঘরে ফিরে গেলো। শ্রমণার বিয়ের পরে বছর দুয়েক এই বাড়িতে ছিলো ওই মেয়ে । সেই দু বছরেই শ্রমণা শ্বশুরবাড়ির আসল চেহারা বুঝে গিয়েছিলো। গোটা বাড়িটাই যেন ওর সম্পত্তি ! কলেজ যাওয়ার সময় তার সব ভালো শাড়ীগুলোই তার পরা চাই । বাড়ির বড়ো মাছের পিস, মাংসের বেশি ভাগ , সব কিছুতেই সার্থকেরও ওপরে তার দাবি। কেউ কিছু বললেই শাশুড়ি রে রে করে তেড়ে আসতেন - ও তো বাড়ির ছোটো মেয়ে , একটু আবদার করবে না ! শ্রমণার তুলনায় গায়ের রঙ একটু বেশি চকচকে বলে সব উজ্জ্বল রঙের শাড়ি আলমারি থেকে টেনে নিয়ে সে পরতো - বলতো এ রঙ বউদিকে ঠিক মানায় না ! শ্রমণা আর সার্থক - লজ্জায় দুজনের কেউই কোনোদিন প্রতিবাদ করে নি।
বারোটার মধ্যেই দুপুরের রান্না শেষ হয়ে গেলো। এরই মধ্যে শ্বশুর - শাশুড়িকে খেতে দেওয়ার পালাও শেষ। ক্লান্ত , ঘর্মাক্ত মুখে একবার নিজের ঘরে এলো শ্রমণা । স্নান সেরে একেবারে নীচে যাবে। ননদদের ছেলেমেয়ে দুটোর সাথে বুবুনকে খেতে দিতে হবে। ছেলেটা আজ নিজেই স্নান করেছে। তার সময় কোথায় !
সার্থক ঘরে বসে টিভি দেখছিল , শ্রমণাকে দেখে হাত ধরে নিজের কাছে টানলো।
-" শোনো , তাড়াতাড়ি একটার মধ্যে খাওয়া - দাওয়ার ঝামেলা মিটিয়ে নাও। তিনটের মধ্যে রেডি হয়ে নেবে , বুবুনকেও রেডি করবে !"
বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে যায় শ্রমণার ।
-" আজ ! মিলিরা এসেছে তো ! বিকেলের চা !"
-" এ বাড়ির রান্নাঘর ওদের অপরিচিত নয় । তুমি অফিস সামলে যদি এতসব করতে পারো - ওরা হাউজ ওয়াইফ , এটুকু করা ওদের পক্ষে মোটেই অসম্ভব না । অনেক প্রশ্রয় দিয়েছি - এটা ওদেরও বাড়ি , ওরা নিশ্চয়ই আসবে , কিন্তু আমাদেরও তো একটা নিজস্ব জীবন আছে ! সবাইকে সবার জন্য ফিল করতে হয় সুমি - তবেই সংসার টেকে। মা - বাবা যদি এটা বুঝতে না পারেন , এবার তাঁদের বোঝার সময় এসেছে। যা উত্তর দেবার , আমি তাঁদের দেবো - তুমি একটা কথাও বলবে না।"
বুবুন এর মধ্যেই কি একটা কারণে ঘরে ঢুকেছে , বাবার কথাগুলো কানে গেছে তারও। আনন্দের আতিশয্যে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো সে।
-" তাহলে বাবা , ডিনার সেরেই ফিরবো তো ? আমি কিন্তু আজ হাক্কা নুডল খাবই , সবাই স্কুলে মাঝে মাঝেই খাওয়ার গল্প শোনায় , আমিই শুধু চুপ করে থাকি !"
-" হ্যাঁ বাবা , তোমার ফেভারিট আইসক্রিমও খাবো আমরা সবাই মিলে !"
-" মা , বাবা রাতে কি খাবেন ?" উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে শ্রমণা ।
-" মা তো এতো অথর্ব হয়ে যাননি - একটা দিন নাহয় নিজেদের মত করে নেবেন ! না হলে , পাড়ায় হোম সার্ভিসের তো অভাব নেই !"
খাওয়া - দাওয়া মিটতেই বেলা দুটো ! আনন্দের চোটে তারপরেই সাজগোজ হয়ে গেলো বুবুনের । শ্রমণাও এবার ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে বসলো।
-" বৌমা , আজ মিলি - শেলীরা একটু সকাল সকাল বেরোবে । কি একটা সিনেমার টিকিট কাটা আছে ওদের ! তিনটে বাজলেই চা দিয়ে দিও !" দরজায় শাশুড়ির মুখ !
সার্থক তখনও বিছানায় বসে । ভুরু কুঁচকে উঠলো তার !
-" মা , আমরা আজ একটু বেরোবো। ফিরতে রাত হবে । চা আজ তুমিই ওদের করে দাও না ! মায়ের হাতের চা তো অনেকদিন খায় না ওরা ! ওদেরও তো ইচ্ছে করে ! আর , ' সুস্বাদু ' তে তোমাদের রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি - রুটি আর চিলি পনীর ! নটার মধ্যেই দিয়ে যাবে!"
-" আজই তোদের বেরোবার দরকার পড়লো খোকন ! বোন - ভগ্নিপোত এসেছে ! বৌমা , তোমাকেও বলিহারি যাই মা !"
শ্রমণার মুখখানা পাংশু হয়ে উঠলো । সেদিকে একবার অপাঙ্গে তাকিয়ে সার্থক বলে উঠলো -" অক্সিজেন শুধু মিলি - শেলীদেরই লাগে না মা , আমাদেরও লাগে ! ওরা ওদের বাবা - মাকে দেখতে আসে , শ্রমণার কি ওর বাবার জন্য মন কেমন করে না ! ওকেও নিজের মেয়ে ভাবতে শেখো মা , নিজের নাতিটার কথাও একটু ভাবো - দেখবে সব কিছু সহজ সরল হয়ে যাবে। মেয়েরা যে বাড়িতে জীবনের বেশিরভাগটা কাটায়, সেখানে তারা একটু সহানুভূতির আশা তো রাখতেই পারে !"
ছেলের দিকে বিরস মুখে একবার তাকিয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে যেতে যেতে শ্রমণার শাশুড়ী মন্তব্য করলেন -" আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি নে!"
অক্সিজেন
লিখেছেন: অপালা_মুখার্জী
゚viralシviralシfypシ゚viralシalシ
গল্প ও ছবি কালেক্টেড।