07/08/2025
🟧 মা আমেনার জীবনী
এজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন প্রসব করে নিজকে সবার উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত সেরা গৌরবে ভূষিত করেছেন যিনি তিনিই হলেন মা আমেনা। সারাজাহানের শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সমস্ত মাখলুকাত সৃষ্টির উছিলা সৃষ্টিকুলের শান্তি ও রহমত, নবী রাসূলগণের মাথার মুকুট মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পবিত্র উদরে ধারণ করে বিশ্ব মানবকুলের সামনে তুলে দিয়ে যে কৃতিত্ব সাধন করেছেন, তার তুলনা নেই। এই ক্ষেত্রে বিবি আমেনার গৌরব সকল নারীর উর্ধ্বে। মক্কার কোরায়েশগণ ছিল, ইব্রাহীম (আঃ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর। তারা পিতা-পুত্র দুইজনেই পবিত্র কাবাগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। এই গৌরবজনক কাজ যাহাদের দ্বারা হয়েছিল, আরবরা তাহাদের বংশধারার লোকগণকে ভক্তি শ্রদ্ধা করা কর্তব্য হিসাবে ধরে নিয়েছিল। মা আমেনার পিতার নাম ওয়াহাব, তিনিও কোরায়েশ বংশের লোক ছিলেন। খোযাআ কবিলা যখন কোরায়েশদের উপরে হামলা চালায়, সেই সময় তার পূর্ব পুরুষ মদীনায় গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল। ওয়াহাবের স্ত্রী গর্ভবতী হলেন। তখন ওয়াহাব একদা স্বপ্নে দেখেন, এক দরবেশ এসে তাকে লক্ষ্য করে বলেন, ওয়াহাব! তুমি বড় ভাগ্যবান ভবিষ্যতে এমন এক মহাপুরুষ দুনিয়াতে আগমন করবেন, যিনি হবেন বিশ্বমানব কুলের জন্য রহমত স্বরূপ মুক্তিদূত। সেই মহা পুরুষেরই গর্ভধারিনী হবেন তোমার ঔরসজাত কন্যা, তার নাম রাখিও আমেনা। যথা সময়ে তাহাদের গৃহ আলো করে ফুটফুটে চন্দ্রের মত একটি কন্যা সন্তান আগমন করল স্বপ্নের নির্দেশ অনুযায়ী তার নাম রাখলেন, আমেনা। ইহার পূর্বে মক্কা মদীনায় কোন লোকই কোন দিন তাদের কন্যার নাম আমেনা রাখে নাই। এই নামটি ছিল সমগ্র আরবে সম্পূর্ণ নতুন নাম। শৈশব কাল হইতেই আমেনা শান্ত মিষ্টভাষিণীও সত্যবাদিনী। বালিকা আমেনাকে আত্মীয় পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই স্নেহ করতো। বিবি আমেনা যখন ছয় কি সাত বৎসরের বালিকা, তখন একদা এক বান্ধবীর বাড়ী বেড়াইতে যাওয়ার পথে, একটি স্বর্ণমুদ্রা দেখে তুলে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন, উহা হাতে লওয়া আমার ঠিক হয় নাই। তবে ঐখানে রেখে দিলে হয়ত উহা মালিকের হাতে না পড়ে অন্যের হাতেও পড়ে যেতে পারে। তার চেয়ে অনুসন্ধান করে দেখা উত্তম, অতঃপর আমেনা দীনারটি হাতের মুঠায় করে তার বান্ধবীর নিকট গিয়ে বলেন, দেখতো বোন! আমি পথে এই দীনারটি পেয়েছি, এখন কিভাবে ইহার প্রকৃত মালিককে দিতে পারি? ইহা শুনে তার বান্ধবী বললো, আরে তুমি ইহা নিয়ে এত ব্যস্ত কেন, চলো আমরা উহা দিয়া কতগুলি খেলনা কিনি। আমেনা বললেন, না বোন আমি উহার মালিককে খুজে বের করে তাকে উহা ফিরায়ে দিব। এই বলে পথে বের হয়ে যেই জায়গায় দিনারটি পেয়েছেন, সেই জায়গায় দাঁড়ায়ে রহিলেন। এর মধ্যে দেখেন এক বৃদ্ধ লাঠি ভর দিয়ে এসে পথের উপরে কি যেন খুঁজতেছে। আমেনা বললেন, চাচাজী! আপনি কি খুঁজছেন? বৃদ্ধ লোকটি বললো মা, আমার একটি স্বর্ণদীনার কোনখানে যেন পড়ে গিয়েছে। তা না পেলে আমার গৃহের সবাইকে অনাহারে মরতে হবে। আমেনা বলেন দেখুন তো এই দীনারটি আপনার কিনা? এই বলে দীনারটি তার হাতে দিলেন। বৃদ্ধ বলে উঠলো, হাঁ মা, এই দীনারটিই আমার। এই বলে কেঁদে কেঁদে প্রাণ ভরে আমেনার জন্য দোয়া করলেন।
আস্তে আস্তে আমেনা যুবতী হলেন। আমেনা তার পিতাকে বলেন, আব্বাজান আমি যখন কোন নির্জন স্থানে যাই, তখন আওয়াজ শুনি হে আবদুল্লাহর স্ত্রী তোমাকে ধন্যবাদ। হে রাসূলের জননী, তোমাকে সালাম। হে নবীদের সরদারের জননী! তোমাকে সুসংবাদ। ইহা শুনে তার পিতা মনে করলেন, ইহা জ্বিনের আছর, তাই তিনি ওঝা-ফকির এনে ঝার ফুঁক করাইলেন, তাহাতে কোন কাজ হলো না। আবদুল মুত্তালিব আর ওয়াহাব এর মধ্যে পূর্ব হতেই পরিচয় ছিল। যদিও তাহাদের একজন মক্কা আর অন্যজন মদীনার অধিবাসী তবু তাহারা উভয়ে একই বংশীয় ছিলেন। ওয়াহাব হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় গিয়ে আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। বহুদিন পর দুই বন্ধুর সাক্ষাৎ হওয়ায় অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা হলো। ওয়াহাব বললেন, আমার কন্যা আমেনার জন্য একটা যোগ্যপাত্র পাওয়া যাইতেছে না, যে সব প্রস্তাব আসছে, উহার কোনটাই আমার মনমত হয় নাই। ইহা শুনে আবদুল মুত্তালিব বললেন, তবে তোমার কন্যাকে আমার পুত্র আবদুল্লাহর কাছেই বিবাহ দাও। ওয়াহাব এই কথা শুনে মনে করলেন, নিশ্চয়ই এই স্থানেই আমেনার বিবাহ হইবে। ইহাতে সন্দেহ নেই। কেননা আমেনা বলেছিল, আব্বা আমি যখন কোন নির্জন স্থানে যাই তখন শুনি কে যেন সবাই আমাকে বলে, হে আবদুল্লাহর স্ত্রী! আবদুল্লাহ এত সুন্দর পুরুষ ছিল, যে তাকে আরবের শ্রেষ্ঠ যুবক বলা হতো, কেননা তার কপালে নূরে মোহাম্মদী চমকাইতেছিল। তিনি যখন রাস্তায় বের হতেন তখন দেশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীগণ তাকে দেখার জন্য নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, মূল্যবান পোষাক অলংকার পরে রাস্তার পার্শ্বে পায়চারি করত, তিনি ফিরেও তাকাতেন না। শতাধিক শ্রেষ্ঠ রূপসী যুবতী তার সহিত বিবাহ বসতে ব্যাকুল হয়েছিল। তাহাদের আশা ব্যর্থ হওয়ায় হৃদয়ের জ্বালায় তাহারা সকলেই আত্মহত্যা করেছিল। ওয়াহাব আবদুল মুত্তালিবের প্রস্তাব আনন্দে গ্রহণ করলেন। বিবাহের তারিখ ঠিক হলো। উভয় পক্ষের অভিভাবকগণ আনন্দের সাথে পাত্র-পাত্রী নিয়ে খানায়ে কা'বায় উপস্থিত হয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান সমাধা করলেন। আমেনা ও আবদুল্লাহ উভয়ে ছিলেন রূপবান ও রূপবতী, বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিমতি। তাহারা উভয়ে মধুময় জীবন যাপন করে যাইতেছিলেন। বিবি আমেনা বৃদ্ধ শ্বশুড়-শাশুড়ীকে পিতামাতার ন্যায় ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। তাহারাও আমেনাকে কন্যার মত স্নেহ আদর করতেন। কয়েক মাস পর আমেনা অন্তঃস্বত্তা হলেন আবদুল মুত্তালিব ইহা শুনে আনন্দিত হলেন। নূরে মোহাম্মদী আবদুল্লাহর কপাল হইতে আমেনার উদরে স্থান লাভ করল। মহানবী আমেনার গর্ভে আসার সাথে সাথেই আবদুল্লাহর রূপ সৌন্দর্য্য কমে গেল। আর বিবি আমেনার রূপ সৌন্দর্য্য শতগুণে বৃদ্ধি পেল। হঠাৎ মরুভূমির বাগানগুলি তরু তাজা হয়ে তার মাঝে ফুল ফুটে উঠিল। ভূমিগুলি ঘাসে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। মেষগুলি বেশী দুধ দিতে লাগলো। ঠাণ্ডা শীতল বাতাস বহিতে লাগলো। চারিদিকে এক নতুন আনন্দের ঢেউ আমেনার চোখে ভেসে উঠলো। এক রাত্রে বিবি আমেনা স্বপ্নে দেখলেন, কে যেন তাকে বলছে- হে আমেনা! তোমার গর্ভে যে মহা মানব আশ্রয় নিয়েছেন, তিনি সারা জাহানের নবীকূল শিরমণি। আর এক রাত্রে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, একটি বৃক্ষ ছায়ায় তিনি বসে আছেন, এমন সময় তার কোল হতে একটি নূরের ঝলক উঠে চারিদিকে ছড়াইয়া উহার আলোকে সমগ্র বিশ্বজগত আলোকিত হয়ে উঠেছে। গর্ভ অবস্থায় তিনি যখন একাকী গৃহে শায়িত থাকতেন, তখন জাগ্রত অবস্থায় তিনি হঠাৎ এইরূপ আওয়াজ শুনতেন, হে জগতের শ্রেষ্ঠ জননী, হে মহানবীর জননী! সালাম গ্রহণ করুন। বিবি আমেনার গর্ভ হওয়ার পর আল্লাহ পাক তার পবিত্র অঙ্গে এমন এক খোশবু প্রদান করেছিলেন, সব সময়ই তার অঙ্গ হতে সুঘ্রাণ বের হতো। তিনি নিজেও নিজের অঙ্গ হতে সুঘ্রাণ পেতেন। তিনি আর একদিন স্বপ্নে দেখলেন, এক বুযুর্গ পুরুষ তাকে বললেন, হে আমেনা! তোমার গর্ভে যে সন্তান অবস্থান করতেছে, তিনি হবেন রাসূল গণের সরদার, সারা দুনিয়ার রহমত স্বরূপ। ভূমিষ্ট হওয়ার পর তুমি তার নাম রাখিও মোহাম্মদ। বিবি আমেনা বলেন, আমার গর্ভ কালীন সময় আমি প্রায় প্রতি রাত্রেই এইরূপ একটা না একটা অদ্ভুত আশ্চর্য্য স্বপ্ন দেখে বুঝতে পারলাম যে, আমার সন্তানের জন্মের ফলে ভবিষ্যতে সারা দুনিয়ার একটা বিরাট পরিবর্তন হবে। বিবাহের বার মাস পরে আবদুল্লাহ ব্যবসার উপলক্ষ্যে সিরিয়া গমন করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কেননা, আমেনার স্বপ্নগুলো শুনে তিনি মনে করলেন। যেই মহা মানব আমার ঘরে আসতেছেন, তার জন্য কিছু রোজগার করা দরকার। ঐ সময় বিবি আমেনা ছিলেন ছয় মাসের অন্তঃস্বত্তা। আবদুল্লাহ আমেনার কাছ হতে বিদায় নিয়ে সিরিয়া রওয়ানা হলেন। হায় কে জানিত যে, আবদুল্লাহ আমেনার কাছ হতে চির বিদায় হয়ে যাইতেছেন। আবদুল্লাহ কয়েকদিন ব্যবসার কাজ শেষ করে আসার সময় মদিনায় (ইয়াসরেবে) তার মামার বাড়ী উঠেছিলেন। সেখানে তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হলেন। এই ইয়াসরেবেই ছিল তার শ্বশুড় ওয়াহাবের বাড়ী তাই তার মামা এবং শ্বশুড় তার চিকিৎসায় ত্রুটি করলেন না, ঠিক মত চিকিৎসা করালেন। তবু তিনি মক্কায় আসিবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। এই সংবাদ শুনে আবদুল মুত্তালিব ও বিবি আমেনা চিন্তায় অস্থির হয়ে আবদুল্লাহর বড় ভাই হারিসকে মদীনায় পাঠায়ে দিলেন। কিন্তু কে জানিত যে, আবদুল্লাহ তার পিতৃ ভূমি হতে এবার চিরবিদায় নিয়ে এসেছিল। মামার গৃহেই তিনি ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন) সে সময় তার বয়স হয়েছিল ২৫ বৎসর।
(২নং পর্ব আসিতেছে ইনশাআল্লাহ)