08/10/2025
‘শুনো তুমি যখন এরপর রাতে বিছানায় আসবে গোসল করে আসবে। সারাদিন পরে অফিস থেকে এসে মশলার ঘ্রাণ নিতে ভালো লাগে না।’
‘মশলার ঘ্রাণ আসবে কোথা থেকে? কি হয়েছে বলোতো৷ আর আমি দুপুরে তো গোসল করি।’
কিছু হয়নি তোমার শরীর থেকে মশলার ঘ্রাণ আসে। যদি পারো পারফিউম দিয়ে শোবার ঘরে আসবে।
দোলা গা ঘেষে বসে ছিলো এবার নিজেকে মোরশেদের থেকে সরিয়ে নেয়। এক কোনায় যেয়ে বসে। নিজেই নিজের শরীরের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করে। না মশলার কোনো ঘ্রাণ আসছে না। তবে এখন যে আসছে না বলে মশলার ঘ্রাণ নেই তেমন না, মাঝেমধ্যে রাতে রান্না করতে হয় তখন কাপড়ের কোথাও রান্নাঘর থেকে কিছু একটা লেগে যায়, ধুয়ে নিলেও ঘ্রাণ থাকে। তবে সবসময় এমন হয় না.
দোলা বিছানা থেকে উঠে বড় মেয়ে সাবার ঘরে যায়, সবার আগামীকাল পরীক্ষা তাই এখনো রাত জেগে পড়ছে। চেয়ারের কাছে দাঁড়াতেই সাবা মাকে জড়িয়ে ধরে, দোলা বলে এখন আর পড়তে হবে না ঘুমিয়ে যা। সাবা বলে, মা আর কিছু পড়া বাকি আছে তারপর ঘুম। তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।
সাবা দোলাকে জড়িয়ে ধরেই নিঃশ্বাস নেয়।
দোলা বলে, আচ্ছা বলতো আমার শরীর থেকে কি মশলার ঘ্রাণ আসে?
‘মা তোমার শরীর থেকে মশলার ঘ্রাণ আসবে কেন? আমাদের স্কুলের পাশে একটা শিউলি ফুল গাছ আছে। আমরা বন্ধুরা প্রতিদিন সেখানে যেয়ে ফুল কুড়াই। তুমি দেখবে আমার ব্যাগেও আছে। তোমাকে যখন জড়িয়ে ধরি তেমনই ফুলের ঘ্রাণ নাকে লাগে, তাইতো জড়িয়ে ধরে ঘ্রাণ নেই, দীর্ঘ করে শ্বাস নেই।’
মেয়ের কথা শুনে দোলার চোখ থেকে টুপটাপ দু ফোঁটা জল গড়িয়ে নামে। চোখে পানি আসবার মতো কিছু হয়নি তারপরও দোলা কেন কাঁদছে বুঝতে পারে না। মেয়ে টের পাবার আগেই চোখ মুছে নেয়।
মেয়ের বিছানার পাশেই কিছু সময় বসে থাকে। ওর বাকি পড়া শেষ হয় তারপর সাবার ঘরের বাতি অফ করে নিজের ঘরে যায়৷ মোরশেদ ঘুমিয়ে গেছে। দোলাও চুপচাপ একপাশে যেয়ে শুয়ে পড়ে। রাত অনেক হয়ে গেছে, সকালে উঠে সবার জন্যে নাস্তা বানাতে হবে। মোরশেদ খুব ভোরে অফিসে যায়, তাই দোলাকে ফজরের নামাজ পড়েই রান্নাঘরে যেতে হয়। নয়তো নাস্তা করে যেতে পারে না, ছেলের প্রাইভেট থাকে ভোরে। সাবার অবশ্য পরীক্ষা চলছে, এখন মায়ের সাথে সাথেই ফজরের দিকে উঠে, তারপর নামাজ পড়ে পড়বার টেবিলে বসে যায়।
দোলা কতো সব চিন্তা করে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে গলির মুখের মসজিদের আজানের শব্দ শুনে। বিছানা থেকে উঠেই নামাজ পড়ে কাজে লেগে যায়, রান্নাঘরে সবার পছন্দের খাবার তৈরি করে তারপর নিজে খেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায়।
গতরাত থেকে দোলার মন খারাপ, অবশ্য মোরশেদের এই সামান্য কথায় মন খারাপ করবার মতো কিছু নেই। তবে বেশ কিছুদিন থেকে দেখেছে দোলার থেকে মোরশেদ কেমন দূরত্ব রাখে, দোলার কোনোকিছুতে মোরশেদ মুগ্ধ হয় না, অল্পতে রেগে যায়। দোলার মা একসময় বলতেন, একসাথে দীর্ঘদিন থাকবার পরে ভালোবাসা বলতে সংসারে কিছু থাকে না, ঝগড়া রাগ অভিমান এতটুকুই বেঁচে থাকে; কিছু মানুষ কেবল সন্তানের জন্যে তখন একসাথে থেকে যায়। তবে কি মোরশেদের ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। মায়ের মতো জীবন কাটাতে হবে তাকে?
দোলার মায়ের জীবন সুখের ছিলো না, তারা তিন ভাই বোন। বাবা মায়ের ভিতরে সবসময় ঝগড়া লেগেই থাকতো। তখন গ্রীষ্মকালের তীব্র গরম, দোলার বাবা সেই দুপুরে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। নয়দিন নিখোঁজ ছিলেন, মা কতো খুঁজেছে বাবাকে তবে পায়নি। নয়দিন পরে জানতে পারে বাবা আবার বিয়ে করে দেশের বাইরে চলে গেছে। দোলার মা তিন সন্তান নিয়ে উঠে ভাইয়ের বাসায়। ভাইয়ের বাসাতেও তার জায়গা হয়নি, সেখানে চারদিন থাকবার পরে চলে আসতে হয়। দোলার মা একটা স্কুলে চাকরি নেয়, তিন সন্তানকে নিয়ে থাকে একটা ছোটো রুমের ভিতরে। যেখানে এরকম চারটা রুমের জন্যে একটা রান্নাঘর। দোলাদের বাসার কিছু ফার্নিচার বিক্রি করে কিছু টাকা পেয়েছিলো সেই টাকা দিয়ে মা বড় ভাইয়াকে ফুটপাতে একটা চায়ের দোকান বসিয়ে দেয়। ভাইয়া বিকাল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চা বিক্রি করতো। এভাবেই দোলাদের জীবন চলে, একসময় মা ভালো একটা কলেজে চাকরি পায়। ভাইয়ার পড়াশোনা শেষে চাকরি হয়, শহরে চারটা মিষ্টির দোকান হয় ভাইয়ার। দোলাদের জীবনে টাকা পয়সা নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়নি।
মোরশেদের সাথে ভালোবাসা নিয়েই সংসারে শুরু হয়েছে। তবে সেই ভালোবাসা কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? দোলার মনের ভিতরে অদ্ভুত সব চিন্তা খেলা করে। যদিও চাচ্ছে এসব চিন্তা করবে না তারপরও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, টিভির মতো মস্তিষ্কের ভিতরের কিছু চিন্তা মিউট করে রাখতে পারলে ভালো হতো।
মোরশেদোর কাছে দোলা স্বাভাবিক হতে পারে না। একটু দূরে দূরেই থাকে। মনে হয় মোরশেদ এখনি বলবে, তোমার শরীর থেকে মশলার ঘ্রাণ আসছে।
সেদিন রাতে মোরশেদ বলে, দোলা আমি দেখলাম আজকাল তুমি দূরে থাকছো। কোনো সমস্যা?
দোলা মৃদু হেসে বলে, মশলার ঘ্রাণ যেনো তোমার নাকে না লাগে তাই দূরে থাকছি।
‘তুমি সামান্য একটা বিষয় নিয়ে বেশি করছো না?’
‘সামান্য বিষয়? দেখো আমাকে সেই ভোরে উঠে দিনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরে থাকতে হয়। মানছি আমার শরীর সেই আগের মতো আকর্ষণীয় নেই। যা তোমায় এখন টানে না। বুঝতে পারি। তোমার চোখে এখন আমি নিখুঁত না, তুমি মুগ্ধতা খুঁজে পাওনা। তবে আমি এসব কেন করি সংসারের জন্যে না? রান্নাঘরে দিনের বেশিরভাগ সময় থাকতে হয় সবার পছন্দের খাবার তৈরি করতেই। কখনো হয়তো সত্যি সত্যি আমার শরীর থেকে মশলার ঘ্রাণ আসে৷ তবে সেদিনের ঘটনা আমাকে সত্যি কষ্ট দিয়েছে৷’
মোরশেদ চুপচাপ দোলার কথা শুনে৷ কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না।
দুজনে এক ছাদের নিচে এক ঘরে এক বিছানায় থাকলে মনের ভিতরে দূরত্ব হয়ে যায়। দুজনের ভিতরে এক হাত দূরত তবে মনে হয় কোটি কোটি মাইল দূরে দুজন শুয়ে আছে।
মোরশেদ আর দোলার ভিতরে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। দোলা সেই ভোরে উঠে রান্নাঘরে যায় সবার জন্যে খাবার তৈরি করে, তারপর বারান্দায় গাছে পানি দেয়, বিড়ালকে খাবার খাওয়ায়। এর ভিতরে দুপুর হয়ে আসে আবার রান্নাঘরে যেতে হয়।
দুপুরবেলা কলিং বেল বেজে উঠে, পরপর দুবার শব্দ হয়। দোলা রান্নাঘরে, গরম তেলের উপরে মাছ ছেড়ে দিয়েছে৷ এই অসময়ে কে আসলো বুঝতে পারে না। চুলার তাপ কমিয়ে দিয়ে হাতটা ধুয়ে নেয়। শাড়ির আঁচলেই ভেজা হাত মুছে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলে দেখে মোরশেদ দাঁড়িয়ে আছে।
মোরশেদ ইচ্ছে করেই আজকে দুপুরে বাসায় এসেছে, এই সময়ে ছেলেমেয়ে কেউ বাসাতে থাকে না, স্কুলে থাকে৷ বাসায় দোলা একা থাকে।
দোলা দরজা খুলে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। মোরশেদ নিজের ঘরে যায় তারপর কিছুসময় পরেই রান্নাঘরে চলে আসে। রান্নঘরে এসে দোলাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমার উপর রেগে আছো তাই না? এই যে কানে ধরছি, এমন কখনো হবে না। আমি তোমার দিকটা বুঝতে পারেনি, বুঝতে পারিনি তুমি আঘাত পাবে।
দোলা নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে, মোরশেদ একইভাবে ধরে রাখে। রান্নাঘরে চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় দোলার কপালে ঘাম জমে গেছে, মোরশেদ দোলার চুল সরিয়ে দিয়ে সেই কপালেই চুমু খেয়ে বলে, আমাদের বড় সাবা সত্যি বলে তার মায়ের শরীর থেকে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ আসে, আমিও তাই বলি তোমার শরীর থেকে সবসময় ফুলের ঘ্রাণ আসে। তুমি যখন রান্নাঘর থেকে এলোমেলো চুলে, ক্লান্ত মুখে বের হও তখনও আমি তোমার প্রতি মুগ্ধতা খুঁজে পাই।
দোলার দুই চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরে, হাতে মরিচ মাখা, চোখ মুছবে সে উপায় নেই। মোরশেদই দোলার চোখ মুছে দিয়ে বলে, অভিমান করলেও তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে। তখন মনে হয় তুমি অভিমানী ফুল। দোলা মৃদু হেসে বলে, এখন ছাড়ো। মোরশেদ ফিসফিস করে বলে, ছাড়বো না এখানে এখন কেউ আসবে না। পাশের বাড়ির একটা লোক তাকিয়ে আছে রান্নঘরের দিকে, মোরশেদ দোলাকে ছেড়ে দেয়, দোলাও লজ্জা পায়, মুচকি হাসে।
মোরশেদ এই দুপুরবেলা দোলার জন্যে লেবুর শরবত নিয়ে এসেছে। দোলা শরবত খাবে সে সুযোগ নেই৷ মোরশেদ এক হাত দিয়ে শরবতের গ্লাস ধরে আছে, দোলা চুমুক দিচ্ছে সেই গ্লাসে৷ চোখ দিয়ে মোরশেদকে দেখছে, কিছু মানুষের ভালোবাসা মুগ্ধতা কখনো কমে যায় না, অভিমানে ভালোবাসা আর গাঢ় হয়ে দেখা দেয়, আরো বেশি মুগ্ধতা নিয়ে বুকে টানে। তখন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকা মশলার ঘ্রাণ থাকা শরীর, ঘামে ভেজা মানুষটাকে জড়িয়ে নিয়ে চুমু খেতে পারে।
মশলার ঘ্রাণ এবং মুগ্ধতা
লেখা-মুস্তাকিম বিল্লাহ
#পরিমার্জিত...