
09/08/2025
দ্য র্যাটস রিভিউ-
©তা রা
বই : দ্য র্যাটস
জনরা : হরর স্ল্যাশার
লেখক : জেমস হার্বার্ট
অনুবাদক : লুৎফুল কায়সার
সম্পাদক : ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশনী : অনির্বাণ প্রকাশনী
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ২০৮
মুদ্রিত মূল্য : ৪০০
এক.
'কারমিল্লা' নামক উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা হয়েছিল 'ড্রাকুলা'; আর 'ড্রাকুলা' থেকে...? কখনো ভেবে দেখেছেন? একটু ভেবে দেখার আগে ঘুরিয়ে আনা যাক জেমস রবার্টের লেখা প্রথম বই 'দ্য র্যাটস' এর ইতিহাস থেকে। প্রথম শুনেই কিছুটা ভ্রু কুঁচকে উঠতে পারেন। স্বাভাবিকভাবে প্রথম লেখাকে কেউ ই অতোটা গুরুতর হিসেবে নেয় না। তবে যদি শুনেন জেমস রবার্ট আধুনিক ব্রিটিশ হরর লেখকদের একজন তখন?
এবার আসি অনুপ্রেরণা থেকে সৃষ্ট 'দ্য র্যাটস' এর মূল নিয়ে। 'ড্রাকুলা'য় দেখা সেই আধাপাগল রেনফিল্ডের কথা মনে আছে তো? রেনফিল্ড কিছু অদ্ভুত প্রজাতির ইঁদুরের দেখা পেয়েছিল। যদিও তা অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয়। তবে এই তুচ্ছ বিষয় ই হয়ে উঠেছিল 'দ্য র্যাটস' লেখার অনুপ্রেরণা। বলতে গেলে এটিকে একটি সূচনা হিসেবে ধরা যেতে পারে যা ছিল অনেকটা এক্সপেরিমেন্টাল।
দুই.
ধরুন রোজকার মতো আপনি ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনা করতে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন আপনার উপর কেউ হা/ম/লা চালিয়ে বসেছে। কিংবা আপনি আপনার অফিস শেষে নির্জন একটি রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছেন। কেমন হবে যদি কেউ পেছন থেকে আপনার শরীরে তার ধারালো দাঁতের কামড় বসিয়ে দেয়? ভয় পাচ্ছেন? ভাবছেন ধারালো দাঁত মানে বুঝি এখানেও ড্রাকুলা এসে উপস্থিত হবে? না; ড্রাকুলা নয় তবে দেখা মিলবে এক অদ্ভুত আকৃতির জন্তুর। যাকে আমরা ইঁদুর বলেই আখ্যায়িত করি। ইঁদুরের পক্ষে কেটে ফেলা সম্ভব জামা কাপড়, ব্ইখাতা এমনকি শস্যাদিও। কিন্তু যদি সেই ইঁদুর হয়ে উঠে মানুষখেকো? যদি খেয়ে ফেলে আপনাকেই তখন? টনক নড়েছে তো!
আর এভাবেই টনক নড়ে উঠেছিল লন্ডনবাসীর। যখন তাদের উপর নেমে আসে একদল রাক্ষুসে ইঁদুর। কোথা থেকে এসেছে তারা? কি চায় কেউ ই জানে না। শুধু জানে এদের ভয় তাদের তাড়া করে চলেছে প্রতিটা মূহুর্ত। একটা শহরের ভেতরে মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে কোনো মানুষের ভয়ে নয় বরং ইঁদুরের ভয়ে। ইঁদুরের আক্রমন থেকে বাঁচলেও বাঁচানো যাচ্ছে না জীবন। কারণ কোনো এক অদ্ভুত রোগ তাদের আক্রমণ করে চলেছে। এক নাগাড়ে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে জনে জনে। কিন্তু কেন? এটা কি কোনো মহামারীর পূর্বাভাস নাকি মহাপ্রলয়ের?
তিন.
সাদামাটা একটা গল্প, একটা শহরকে ঘিরে। তারপরও একটা ভীতি। শুধুই কি ইঁদুরের ভয়? নাকি জীবন বাঁচাতে ছুটে চলা একদল মানুষের সংগ্রাম! এই গল্পের আড়ালে বসে লেখক দেখিয়েছেন একদলের উদাসীনতার প্রভাব। কাদের? দ্বিতীয় বিশ্বযু/দ্ধের পরের কয়েক দশক ধরে চলে আসা ইউরোপের পরিবর্তনের ও। দ্বিতীয় বিশ্বযু/দ্ধের পর পশ্চিমা সমাজের কাহিনীর কিছুটা অংশ। রাজনীতিবীদদের ক্ষমতায় আসার পর তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার। অপব্যবহার ই তো বটে। কারণ তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, তাদের মতে নিম্ন আয়ের মানুষদের আজ যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে সেটাও আগে ছিল না অথচ ঘটনা ঠিক তার উল্টো। তাদের অবহেলায় অন্ধকার গলি গুলোতে বেড়ে উঠেছিল একদল হিংস্র প্রাণী। কিন্তু ফল ভুগতে হয়েছে পুরো শহরকে। ঠিক যেন ওই বাগধারার মতো,'ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।'
চার.
টার্নিং পয়েন্ট বা টানটান উত্তেজনা অনুভব হয়েছে প্রতিটা মূহুর্ত। এমন একটা ভাব যেন আপনি ব্ইটা এক বসায় পড়তেও পারছেন না আবার ছেড়ে যেতেও পারছেন না। সামনের ঘটনা জানতে আপনি ভেতরে ভেতরে উদ্বেগ অনুভব করছেন। অথচ সেই উদ্বেগকে দমন করতে ব্ইটা হাতে নিয়েও এগুতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ বর্ণনাগুলো খুব ভয়াবহ রকমের ভয় সৃষ্টি করে। মনের উপর একটা চাপ যা ভয়কে বাড়িয়ে দেয়; এখানে কোনো ভূত নেই তবে ভয় আছে।
এই ব্ইটিকে আরো সহজে ব্যাখ্যা করতে চাইলে আমি বলব 'ট্রেইন টু বুসান' মুভির কথা। মুভিটিতে একদল মৃত মানুষকে দেখানো হয় যারা জম্বি হয়ে ফিরে আসে। তাদের ভয়টা সেখানে জীবিতরা টের পাচ্ছিল। ঠিক তেমনটাই 'দ্য র্যাটস' এ। এখানেও শহরের পাশাপাশি এক জায়গায় দেখা যায় যখন এক ট্রেন ভর্তি মানুষ শিকারে পরিণত হয় ইঁদুরের। কি বিভৎস সেই বর্ণনা! পুরো শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃত মানুষের হাড়গোড়। শুনতেই গা গুলিয়ে আসার উপক্রম। আর লেখনীর ধারাবাহিকতার কৃতিত্ব এখানেই যে এই বইটি পড়লে কিছুটা মুভির মতোই মনে হতে পারে। হঠাৎ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে চলা মানুষগুলোর বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছাটুকু চোখের সামনে দেখা সম্ভব। তাইতো বইয়ের ঘটনার উপর ১৯৮২ সালে 'ডেডলি আইস' নামে মুভি নির্মিত হয়েছিল।
পাঁচ.
জনরা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। জনরা হিসেবে বইটিকে রাখা হয়েছে স্ল্যাশার হররের মধ্যে।
স্ল্যাশার হরর কী জানেন তো? এর মানে বইতে ভয়ের এলিমেন্টস থাকবে তবে তা কেবল মৃত মানুষ বা ভূত-প্রেত কেন্দ্রীয় নয়; বরং প্রাকৃতিক শক্তি। অনেকটা ন্যাচারাল হররের মতোই। মূলত এখানে অতিপ্রাকৃত কোনো সত্তা, প্রাণী বা বিকৃতি কিছু উপস্থাপন করা হয় যার ভয় সবাইকে তাড়া করে বেড়ায়। রেহাই পাবে না কোনো পশুপাখিও। কিছুটা হিংস্রতাপূর্ণ। যদিও গল্পের গভীরতা তেমন দেখা যায় না। যেমন 'দ্য র্যাটস' ব্ইটিতে খুব বেশি চরিত্রের আগমন দেখা যায় নি। ঘটনার সাপেক্ষে চরিত্রের সমাগম দেখা গিয়েছে এবং কিছু মূল চরিত্র নিয়েই ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন ছিল হ্যারিস। হ্যারিস চরিত্রটি আমার কাছে অনেকটা 'ড্রাকুলা'র জোনাথনের মতোন ই মনে হয়েছে। হয়ত অনুপ্রেরণা নিয়ে লেখার সাইড এফেক্ট। তবে জেমস হারবার্টের লেখা 'দ্য র্যাটস' অনেকের মতে স্ল্যাশার জনরার একদম পার্ফেক্ট উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম।
ছয়.
লুৎফুল কায়সার ভাইয়ার অনুবাদের সাথে প্রথম পরিচয় হয় 'কারমিল্লা'র মাধ্যমে। এরপর ভাইয়ার বেশ কয়েকটি বইয়ের অনুবাদ পড়েছি। সবগুলো পড়তে গিয়েই আমার মাথায় এসেছে এটা মৌলিক না তো! সত্যি বলতে অনুবাদ বাজে হলে পড়তে ভালো লাগে না। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠা সম্ভবপর হয় না। কারণ যে পড়তে সে শুধু রিডিং পড়ে যায় না বরং লেখাটাকে নিজের মনের ভেতর কল্পনা করে সাজিয়ে নেয়। আর এই ক্ষেত্রে অনুবাদক সফল। তিনি শব্দচয়নে বরাবরের মতোই এবারো আমায় মুগ্ধ করেছেন।
আর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ইফতেখারুল ইসলাম। আমি বলব সম্পাদনার অংশটুকু বেশ ভালোভাবেই করেছেন তিনি। লাইনের ধারাবাহিকতা, বর্ণনা আর বানানে তেমন কোনো অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়েনি। আর প্রচ্ছদটাও বেশ নজরকাড়া। কথায় আছে আগে 'দর্শনধারী পরে গুন বিচারী'; 'দ্য র্যাটস' এর প্রচ্ছদকার লেখার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই মূল প্রচ্ছদে বিশালাকৃতির ইঁদুরকে রেখেছেন। আমি মনে করি প্রচ্ছদ দেখলেও গল্পটার অনেকাংশ আন্দাজ লাগানো সম্ভব। এতে করে পাঠক তার পছন্দের উপর ভিত্তি করে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে যদিও সকলে সব ধরনের বর্ণনা নিতে অভ্যস্ত নন।
পার্সোনাল রেটিং : ৪.১/৫
ছবি ক্রেডিট : মাহরীন হক মোহো