14/10/2025
কথা বলার ক্ষুধা - সেক্সের চেয়েও আদিম যে চাহিদা
আপনার সঙ্গী কি আপনার সাথে শোয়, কিন্তু কথা বলে না? তাহলে অভিনন্দন, আপনি এক জীবন্ত লাশের সাথে বসবাস করছেন।
কী? statement টা শুনেই আপনার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো? মনে হচ্ছে, আপনার ব্যক্তিগত জীবনে কেউ নোংরাভাবে উঁকি মারছে? নিজের ভালোবাসার সম্পর্কটাকে এতটা কদর্যভাবে আক্রমণ করায় লেখকের গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করছে? করুন। আপনার সব ক্ষোভ, সব অপমান আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। কিন্তু এই লেখাটি যদি আপনার ভেতরের সেই ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরিটাকে জাগিয়ে তুলতে না পারে, যদি আপনার সাজানো-গোছানো সম্পর্কের মিথ্যার দেওয়ালটা কাঁপিয়ে দিতে না পারে, তবে বুঝবেন আমার কলম ধরাটাই বৃথা।
আমরা এক অদ্ভুত ডিজিটাল কসাইখানায় বাস করি, যেখানে আমরা সম্পর্কগুলোকে লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার দিয়ে ওজন করি। আমরা একে অপরের শরীর চিনি, কিন্তু আত্মাটাকে চিনি না। আমরা একসাথে ডিনার করি, কিন্তু কথা বলি ফোনের স্ক্রিনের সাথে। আমরা একসাথে বিছানায় যাই, কিন্তু আমাদের মন ঘুরে বেড়ায় ভার্চুয়াল দুনিয়ার অলিতে-গলিতে। এই যে নীরবতার মহামারী, এই যে কথা বলার জন্য আত্মার তীব্র হাহাকার—এটাই আজকের সভ্যতার সবচেয়ে বড় ক্যানসার।
এই লেখাটি কোনো পরকীয়াকে উস্কে দেওয়ার জন্য নয়। এই লেখাটি ডিভোর্সকে মহিমান্বিত করার জন্যও নয়। এই লেখাটি হলো সেই ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হওয়ার এক নির্মম প্রচেষ্টা, যা আপনার সুখী দাম্পত্যের মুখোশের আড়ালে থাকা কঙ্কালটাকে দেখিয়ে দেবে। এই লেখাটি হলো সেই 'কথার অক্সিজেন'-এর প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর চেষ্টা, যা ছাড়া প্রতিটি সম্পর্ক ভেতর থেকে পচে যেতে শুরু করে।
কথা বলার ক্ষুধা - সেক্সের চেয়েও আদিম যে চাহিদা
আসুন, আপনার শোবার ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক করি। না, আপনার শারীরিক সম্পর্কের গোপন দৃশ্য দেখার জন্য নয়। আপনার নীরবতার বীভৎস রূপটা দেখার জন্য। ভাবুন তো, আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। তার নিঃশ্বাস আপনার ঘাড়ে পড়ছে, তার শরীরের উত্তাপ আপনি পাচ্ছেন। বাহ্যিকভাবে সবকিছুই নিখুঁত। কিন্তু আপনারা দুজনই কথা বলছেন না। আপনাদের মাঝে শুয়ে আছে একটা জ্বলন্ত স্মার্টফোন অথবা সারাদিনের এক পাহাড় ক্লান্তি, যা আপনাদের ঠোঁট দুটোকে সেলাই করে দিয়েছে।
শারীরিক মিলন হয়তো আপনাদের হয়, কিন্তু সেই মিলনে কি আত্মার কোনো সংযোগ থাকে? নাকি সেটা নিছকই একঘেয়ে রুটিন, একটা যান্ত্রিক প্রক্রিয়া? যে মানুষটার সাথে আপনি আপনার শরীর ভাগ করে নিচ্ছেন, তার সাথে যদি নিজের মনের কথা, ভয়, স্বপ্ন বা সামান্যতম অনুভূতিও ভাগ করে নিতে না পারেন, তাহলে আপনার আর একজন যৌনকর্মীর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো 'social connection' বা সামাজিক সংযোগ। অক্সফোর্ডের মনোবিজ্ঞানী রবিন ডানবারের মতে, শারীরিক স্পর্শের মতোই 'কথোপকথন' আমাদের শরীরে এন্ডোরফিন (Endorphin) নিঃসরণ করে, যা আমাদের ভালো থাকার অনুভূতি দেয়। যখন আপনার সঙ্গী আপনার কথা মন দিয়ে শোনে, তখন আপনার মস্তিষ্কে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, তা সবচেয়ে তীব্র অর্গ্যাজমের চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
যে নারী তার স্বামীর কাছে দিনের ছোট ছোট গল্পগুলো করার জন্য ছটফট করে, সে আসলে 'কথা' চায় না, সে চায় 'মনোযোগ'। সে চায় তার স্বামী এটা বুঝুক যে, তার জগতে সে-ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর যে পুরুষ সারাদিনের যুদ্ধের পর বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সাথে দুটো কথা বলে হালকা হতে চায়, সে আসলে তার পৌরুষের স্বীকৃতি চায়। সে চায় তার স্ত্রী বুঝুক, এই সমস্ত লড়াইটা সে তাদের জন্যই লড়ছে।
এই 'কথার ক্ষুধা' যখন মেটে না, তখনই সম্পর্কগুলো জীবন্ত লাশে পরিণত হয়। শরীর দুটো একসাথে থাকে, কিন্তু আত্মা দুটো সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়।
আমাদের জীবনটা একটা লম্বা, বন্ধুর পথ। আর এই পথের প্রতিটি বাঁকে আমাদের একজন কথা বলার মানুষ দরকার হয়।
স্কুল-কলেজের সেই দিনগুলো: যখন পরীক্ষার চাপ, বাবা-মায়ের প্রত্যাশা আর প্রথম প্রেমের কাঁটায় মনটা ক্ষতবিক্ষত, তখন সেই বন্ধুটিই ছিল আমাদের অক্সিজেন, যার কাছে কোনো ফিল্টার ছাড়াই সব বমি করে দেওয়া যেত।
বেকারত্বের অভিশাপ: যখন চারদিক থেকে 'কী করছিস?' প্রশ্নটা তীরের মতো বিঁধতে থাকে, তখন একজন মানুষ দরকার হয় যে বলবে, "চিন্তা করিস না, আমি আছি তোর পাশে।"
বিশ্বাসঘাতকতার নরক: যখন প্রেমিক-প্রেমিকা, কাছের বন্ধু বা নিজের রক্ত সম্পর্কের কেউ আপনার পিঠে ছুরি মারে, তখন আপনার একটা কাঁধ দরকার হয়, যেখানে মাথা রেখে আপনি চিৎকার করে কাঁদতে পারবেন। আপনার কোনো সমাধান লাগবে না, শুধু একজন শ্রোতা লাগবে।
ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলার পর যখন আপনার সব সঞ্চয়, সব স্বপ্ন এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যায়, তখন আপনার এমন একজন মানুষ দরকার, যে আপনার ব্যর্থতাকে নিয়ে উপহাস করবে না, বরং আপনার হাতটা ধরে বলবে, "চলো, আবার শুরু করা যাক।"
আর ভাবুন সেই হাউসওয়াইফের কথা। সারাদিন চার দেওয়ালের মধ্যে একা একা কাজ করতে করতে তার মনটাও দেওয়ালের মতো বোবা হয়ে যায়। সে সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে, কখন তার স্বামী ফিরবে, আর সে তার জমানো কথাগুলো বলবে। কিন্তু স্বামী ফিরে ডুবে যায় মোবাইল বা টিভির জগতে। নারীর দিনের পর দিন জমে থাকা এই না বলা কথাগুলোই একসময় তার মনে বিষ হয়ে যায়, যা সম্পর্ককে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে।
একইভাবে, সেই পুরুষটির কথাও ভাবুন, যার স্ত্রী হয়তো খুব ভালো সংসারী, কিন্তু তার সাথে মনের কথা বলার কোনো তাগিদ অনুভব করে না। পুরুষটি অফিসের চাপ, সামাজিক চাপ নিয়ে কার সাথে কথা বলবে? তার ভেতরের শিশুটা কার কাছে আবদার করবে? এই একাকীত্বই অনেক পুরুষকে घराর বাইরে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য করে।
কথা বলার মানুষটা আসলে একটা সেফটি ভালভের মতো। যা আপনার ভেতরের অতিরিক্ত চাপটাকে বের করে দেয় এবং আপনাকে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়।
জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একাকীত্ব নেমে আসে মধ্যবয়স এবং বৃদ্ধ বয়সে।
যখন সন্তানরা বড় হয়ে নিজেদের জগৎ তৈরি করে নেয়, যখন বন্ধুরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন স্বামী-স্ত্রীর কাছে একে অপরকে ছাড়া আর কেউ থাকে না। এই সময়টাতেই 'কথা' হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বহু দম্পতি এই বয়সে এসে আবিষ্কার করে যে, সারাজীবন একসাথে থেকেও তারা আসলে কথা বলতে শেখেনি। তাদের সব আলোচনা সন্তান, সংসার আর দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নিজেদের নিয়ে কথা বলার মতো তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তারা একই ছাদের নিচে দুটো অচেনা দ্বীপের মতো বসবাস করে।
আর সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্যপট তৈরি হয় বৃদ্ধ বয়সে। ভাবুন আপনার বাবা-মায়ের কথা। তাদের আর কোনো কাজ নেই, কোনো ব্যস্ততা নেই। তাদের পুরো পৃথিবীটা ছোট হয়ে আপনাদের ফোনের অপেক্ষায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তারা আপনার কাছে টাকা-পয়সা, দামী উপহার কিছুই চায় না। তারা শুধু পাঁচ মিনিটের জন্য আপনার গলাটা শুনতে চায়। তারা তাদের পুরোনো দিনের গল্প শোনাতে চায়, তাদের শরীর খারাপের কথা জানাতে চায়, আপনার দিন কেমন কাটলো তা জানতে চায়।
আর আপনি? আপনি 'ব্যস্ত' আছেন। আপনি মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে বা দামী ডাক্তার দেখিয়েই আপনার দায়িত্ব শেষ করেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার এই নীরবতা তাদের জন্য স্লো পয়জনিং-এর মতো কাজ করছে? loneliness বা একাকীত্ব যে সরাসরি স্মৃতিভ্রংশ (Dementia), হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়, তা একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত। আপনি হয়তো অজান্তেই আপনার ব্যস্ততা দিয়ে আপনার বাবা-মায়ের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছেন। আপনি আসলে তাদের একজন নীরব হত্যাকারী।
কথা বলুন, নইলে ফুরিয়ে যাবেন
আমরা এমন এক প্রজন্ম, যারা হাজার হাজার ভার্চুয়াল বন্ধুর ভিড়েও মারাত্মকভাবে একা। আমাদের কন্টাক্ট লিস্ট ভর্তি, কিন্তু ডায়াল করার মতো একটা নম্বরও নেই।
থামুন। এই মুহূর্তে আপনার হাতের স্মার্টফোনটা নামিয়ে রাখুন। আপনার পাশে বসে থাকা মানুষটার চোখের দিকে তাকান। তাকে জিজ্ঞেস করুন, "কেমন আছো তুমি? সত্যিই কেমন আছো?" তার উত্তরটা মন দিয়ে শুনুন, অন্যমনস্ক হয়ে নয়। আপনার বাবা বা মা-কে ফোন করুন, কোনো কারণ ছাড়াই। শুধু বলুন, "এমনিই ফোন করলাম, তোমার গলাটা শুনতে ইচ্ছে করছিল।"
বিশ্বাস করুন, এর চেয়ে বড় 'আই লাভ ইউ' আর কিছু হতে পারে না।
কথা বলা কোনো বিলাসিতা নয়, এটা বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের মতোই জরুরি। এটা আত্মার খাবার। যে সম্পর্কে কথা নেই, সে সম্পর্কটা একটা সুন্দর কফিনের মতো, যার ভেতরে শুধুই একটা পচা-গলা লাশের বাস।
এখন নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কি একজন জীবন্ত মানুষের সাথে বাঁচতে চান, নাকি একটা লাশের সাথে ঘুমাতে চান? আপনি কি আপনার প্রিয়জনদের 'কথার অক্সিজেন' দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চান, নাকি নিজের নীরবতা দিয়ে তাদের তিলে তিলে খুন করতে চান?
সিদ্ধান্ত আপনার। কারণ আপনার জিহ্বা এবং আপনার কান, এই দুটোই পারে একটা সম্পর্ককে হয় স্বর্গ বানাতে, নয়তো জীবন্ত কবরস্থান।