30/10/2024
... সঙ্গীতবিলাসী গহরজান
---------------------------------------
তাঁর কবরের উপর শেষ গোলাপটা কে রেখেছিল সে কথা আজ কেই বা জানে। স্মৃতির অতলে কবেই বিলীন হয়েছে হিন্দুস্থানের সেই সঙ্গীত সম্রাজ্ঞীর কবরটা। অথচ সেখানে কোনও দিনও বসেনি একটা স্মৃতি ফলক। জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটা ‘মিথ’। তাঁর রেকর্ডে লেখা থাকত ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। মৃত্যুর চুরাশি বছর পরেও তিনি কিংবদন্তী। চলেছে তাঁকে নিয়ে নিত্য নতুন গবেষনা। আর তাঁর গাওয়া গানের পুরনো রেকর্ডগুলি আজও কালেক্টর্স আইটেম। তিনি মিস গহরজান, কলকাত্তাওয়ালি।
---------------------------------------
জীবদ্দশাতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটা ‘মিথ’। তাঁর রেকর্ডে লেখা থাকত ‘ফার্স্ট ডান্সিং গার্ল’। মৃত্যুর চুরাশি বছর পরেও তিনি কিংবদন্তী। তাঁকে নিয়ে চলে নিত্য নতুন গবেষণা। আর তাঁর গাওয়া গানের পুরনো রেকর্ডগুলি আজও কালেক্টর্স আইটেম।
-----------------------------------------
তিনি মিস গহরজান, কলকাত্তাওয়ালি।
-----------------------------------------
১৮৭৩ সালের ২৬ জুন উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে জন্ম অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োয়ার্ডের। পরবর্তী কালে তাঁরই নাম হয় গহরজান। জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ইহুদি। মায়ের নাম ভিক্টোরিয়া হেমিংস, আর বাবা রবার্ট উইলিয়াম ইয়োয়ার্ড। ভিক্টোরিয়ার মা রুক্মিণী ছিলেন জন্মসূত্রে ভারতীয়। ভিক্টোরিয়া ও রবার্টের সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পরে এক মুসলিম যুবক খুরশিদের সাহায্যে ভিক্টোরিয়া ও অ্যাঞ্জেলিনার ঠিকানা হয় বারাণসী শহরে। এখানেই মা ও মেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর ভিক্টোরিয়ার নাম হয় মালকাজান এবং ছোট্ট অ্যাঞ্জেলিনা হল গহরজান।
---------------------------------------
মালকাজান ভাল গান গাইতে পারতেন। লিখতেন উর্দু কবিতাও। এ বার শুরু হয় তাঁর সঙ্গীতের তালিম। কিছু বছরের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঈজিদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু এ সবের পাশাপাশি মালকা সর্বদা তৎপর থাকতেন গহরের তালিমের ব্যাপারে। ইতিমধ্যেই বিখ্যাত বেচু মিশ্রের কাছে গহরের তালিমের ব্যবস্থা করেছিলেন। চার বছর বারাণসীতে থাকার পরে খুরশিদ, মালকা ও গহর চলে আসেন কলকাতায়।
-----------------------------------
শুরু হল নতুন এক অধ্যায়। তাঁদের ঠিকানা হল এ শহরের কলুটোলা অঞ্চলে। ইতিমধ্যেই দেশের রাজা-মহারাজাদের দরবারে মালকাজানের ডাক পড়তে শুরু করে। ঠিক এমনই এক সময় মালকা নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন মেটিয়াবুরুজে, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের দরবার থেকে। সেখানেই কত্থকের প্রবাদপ্রতিম গুরু বিন্দাদিন মহারাজ গহরকে দেখে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর প্রতিভা। শুরু হয় গহরের নাচের তালিম। এর পাশাপাশি চলতে থআকে গহরের গানের তালিমও। তিনি বাংলা গান শিখেছিলেন বামাচরণ ভট্টাচার্যের কাছে। রমেশচন্দ্র দাস বাবাজির কাছে কীর্তন। শ্রীজান বাঈয়ের কাছে ধ্রুপদ-ধামার এবং মিসেস ডি’সিলভার কাছে কিছু ইংরেজি গানও শিখেছিলেন। তাঁর অন্যান্য গুরুদের মধ্যে ছিলেন রামকুমার মিশ্র, গ্বালিয়রের ভাইয়া গণপত রাও সাহেব প্রমুখ। গহর গাইতে পারতেন হিন্দি, বাংলা, উর্দু, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষায়। তবে তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য মেহেফিল দ্বারভাঙার মহারাজা লক্ষ্মেশ্বর সিংহের দরবারে। এর পর থেকেই গহরজানের নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
-------------------------------------
১৯০১ সালে কলকাতায় আসে গ্রামোফোন ও টাইপরাইটার লিমিটেড। উদ্দেশ্য, এ দেশের শিল্পীদের গান রেকর্ড করে বাণিজ্য করা। সেই থেকেই শুরু হয় এ দেশে রেকর্ডের প্রচলন। প্রথম যুগের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম গহরজান। কোম্পানির রেকর্ডিস্ট হিসেবে এসেছিলেন গেইসবার্গ সাহেব। রেকর্ডিং-এর সময় গহরজানকে দেখে অবাক হয়েছিলেন তিনি। রেকর্ডিং-এর প্রথম দিনই গেইসবার্গ বুঝেছিলেন এই শিল্পী হয়ে উঠবেন এ দেশের ‘গ্রামোফোন সেলিব্রিটি’। এমন আত্মবিশ্বাস এবং স্বতঃস্ফূর্ততা তিনি অন্য কোনও শিল্পীর মধ্যে লক্ষ করেননি। ১৯০২ থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী। আর সেই যুগে প্রতিটি রেকর্ডিং সেশনের জন্য তিনি নিতেন তিন হাজার টাকা ! সে সময় গহর থাকতেন নাখোদা মসজিদের পাশেই এক প্রাসাদসম বাড়িতে। নাম রেখেছিলেন ‘গহর বিল্ডিং’। তাঁর বিলাসী জীবনযাপনের কথা সে যুগে লোকের মুখে মুখে ফিরত। শোনা যায় পোষা বেড়ালের বিয়েতে তিনি খরচ করে ছিলেন কুড়ি হাজার টাকা।
-------------------------------------------
ইতিহাসে কান পাতলে আজও শোনা যায় এ শহরে গহরজানের বহু মেহফিলের স্মৃতি। জোড়াসাঁকোর মল্লিকবাড়ির এক অনুষ্ঠানে চমক দিয়েছিলেন গহর। আসরে ছিলেন বাঙালি, পঞ্জাবি, মাড়োয়াড়ি ও সাহেব অতিথিরা। গৃহকর্তাকে গহর অনুরোধ করলেন অতিথিদের ভাষা অনুযায়ী আলাদা আলাদা ভাগে বসাতে। এমন কথা শুনে গৃহকর্তা তো একে বারে হতবাক! তবে শিল্পীর অনুরোধ ফেলার নয়। তাই তিনি অতিথিদের আলাদা আলাদা দলে বসতে বললেন। বহুমূল্য অলঙ্কারে সুসজ্জিত গহর আসর থেকে প্রাঙ্গণে নেমে এলেন। যে দিকে সাহেবরা বসেছিলেন সেখানে গিয়ে একটা কুর্নিশ করে একটা ইংরেজি গান ধরলেন। এর পরেই পঞ্জাবি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে ধরলেন একটি পঞ্জাবি গান। মাড়োয়াড়ি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে ধরলেন একটি হিন্দি দাদরা ও ঠুমরি। সব শেষে বাঙালি শ্রোতাদের সামনে গিয়ে শুনিয়েছিলেন একাধিক বাংলা গান। সে দিন সকল শ্রোতাই মুগ্ধ হয়েছিলেন গহরের এই অভিনব পরিবেশনায়। এমনটাই ছিলেন গহরজান। তেমনই ইতিহাস হয়ে আছে স্টার থিয়েটারে গহরজানের নানা অনুষ্ঠান। তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য রাস্তায় ভিড় জমে যেত। এমনকী, দেশলাইয়ের বাক্সে থাকত তাঁর ছবি। সে যুগে পাওয়া যেত গহরজানের ছবিওয়ালা রঙিন পোস্টকার্ড। তাঁর গাওয়া বাংলা গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি’, ‘আজ কেন বঁধু’, ‘নিমেষেরই দেখা যদি’। আর মাইলস্টোন বলতে মূলতানী, মালকোষ, কিংবা ভূপালি রাগের খেয়ালগুলি। তবে হিন্দি গানগুলির মধ্যে ‘আনবান জিয়া মে লাগি’, ‘নহক লায়ে গবানবা’ আজও উল্লেখযোগ্য। তাঁকে বলা হত ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী। অথচ মাঝে মধ্যেই আসরে তিনি গাইতেন লঘু চালের সাধারণ গান। আসলে খেয়াল, ধ্রুপদ কিংবা ধামার যে সকল শ্রোতার মন ছুঁতে পারবে না তা তিনি বুঝতে পারতেন। তাই শ্রোতার মন বুঝে আসরে গান গাইতেন ।
----------------------------------------
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কেটেছিল নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে। ভালবেসে বার বার পেয়েছিলেন আঘাত। এক দিকে, দেশ জোড়া খ্যাতি, অর্থ, মান সম্মান। অন্য দিকে, সব কিছুর অলিন্দে ব্যক্তিগত জীবনে নিসঙ্গতা এবং একাকীত্ব। তাঁর ম্যানেজার পেশওয়ারি যুবক আব্বাস এক সময় খুব ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠেছিলেন। শোনা যায়, পরে সেই আব্বাসই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। তাঁর কারণেই গহর হারিয়ে ছিলেন প্রভূত ধনসম্পত্তি। চলেছিল দীর্ঘ মামলা মকদ্দমাও । ১৯২৮ সালে মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে মহীশূর দরবারে সভাগায়িকা নিযুক্ত হয়েছিলেন গহরজান। তাঁর প্রিয় কলকাতা ছেড়ে চির কালের মতো পাড়ি দিয়েছিলেন গহরজান। দু’বছর পরে, ১৭ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে মহীশূরে তাঁর মৃত্যু হয় ।
------------------------------------------
তিনি রয়ে গেলেন একটা ‘মিথ’ হয়ে। গানের শেষে আজও তাঁর রেকর্ডে শোনা যায় সেই ঘোষণা ‘মাই নেম ইজ গহরজান’ ... কপি পোস্ট