17/10/2025
রোদে না যাওয়া মানে শুধু ভিটামিন D-এর অভাব না, বরং পুরো শরীরের বায়োলজিক্যাল ব্যালান্সের ভাঙন!
রোদে না গেলে যেসব সমস্যা হয় তার লিস্ট করতে গেলে বহু পাতা বিশিষ্ট বই লিখতে হবে!
রোদ হলো ফ্রি মেডিসিন, ফ্রি ভ্যাকসিন, ফ্রি এনার্জি সোর্স।
তবুও আমরা একে ভয় পাই, কারণ আধুনিক প্রোপাগান্ডা আমাদের ব্রেইনওয়াশ করে প্রকৃতিবিরুদ্ধ জীবনযাপনে ঠেলে দিয়েছে।
অথচ ১৯২০-৩০ এর দিকে ইউরোপেই এমন ক্লিনিক ছিলো যেখানে মানুষকে ভর্তি করার পর রোদ পোহানোর জন্য বেড ছিলো! একে বলা হতো হেলিওথেরাপি।
সূর্যের আলো মানুষের সার্কাডিয়ান রিদমের সবচেয়ে শক্তিশালী জাইটগিবার (Zeitgeber)। জাইটগিবার বলতে বোঝায় এমনসব বাহ্যিক সংকেত যা আমাদের শরীরের biological clock বা circadian rhythm-কে সময়ের সঙ্গে সিংক বা রিসেট করে।
কখন ঘুমাতে হবে, কখন উঠতে হবে, কখন ক্ষুধা লাগবে -এ সবই নিয়ন্ত্রিত হয় অন্তর্নিহিত ঘড়ি দ্বারা, আর সেই ঘড়িকে সময়মতো চালাতে সাহায্য করে বাহ্যিক জাইটগিবার-রা।
সূর্যের আলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাইটগিবার! আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীর এই সূর্যালোক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার জন্য ডিজাইন করা।
সূর্যের আলো মস্তিষ্কের সুপ্রাচিয়াসমেটিক নিউক্লিয়াস (SCN)-এর উপর প্রভাব বিস্তার করে। SCN হলো সার্কাডিয়ান রিদমের প্রধান নিয়ন্ত্রক।
সূর্যের আলো যখন চোখের উপর পড়ে তখন একটি সংকেত SCN-এর অভ্যন্তরীণ ঘড়ির সময়সূচী সমন্বয় করে। এরই নাম- সার্কাডিয়ান রিদম সিনক্রোনাইজ। এর ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক কার্যকারিতা সঠিক ও সবচেয়ে উত্তম হয়, যার মধ্যে রয়েছে ঘুম-জাগরণ চক্র, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হরমোন নিঃসরণ, খাদ্যগ্রহণ ও বিপাক ইত্যাদি।
সার্কাডিয়ান রিদমের প্রকৃত দৈর্ঘ্য গড়ে ২৪ ঘন্টা ১১ মিনিট অর্থাৎ পৃথিবীর দিন থেকে কিছুটা বেশী। তাই এটি প্রতিদিন কিছুটা দেরিতে চলতে চায়। সকালে সূর্যের আলো এটিকে সঠিক ২৪ ঘণ্টার চক্রে ফিরিয়ে আনে।
কিন্তু যদি সকালে সূর্যের আলো না পাওয়া যায় তবে দেহঘড়ি তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দেরিতে চলতে শুরু করে। দিনের পর দিন এভাবে ঘটতে থাকলে একসময় সার্কাডিয়ান রিদমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়! যাকে বলে ‘সার্কাডিয়ান ডিসরাপশন’!
ধরুন, আপনার ঘড়ি দিনে ১১ মিনিট এগিয়ে বা পিছিয়ে যায়। অবশ্যই প্রতিদিন সকালে এই ঘড়িটিকে ১১ মিনিট পিছিয়ে বা এগিয়ে দিতে হবে। যদি সপ্তাহ বা মাস ধরে ঘড়িটিকে সিনক্রোনাইজ না করেন তবে আপনার সিডিউলের যে পরিণতি হবে— প্রতিদিন সকালে সূর্যের আলোতে যেয়ে দেহের সার্কাডিয়ান রিদম সিনক্রোনাইজ না করলে আপনার স্বাস্থ্যেরও একই অবস্থাই হবে!
আর বর্তমানে আমরা সেটাই দেখতে পাচ্ছি মানব জাতির সার্বিক হেলথ ম্যানেজমেন্টে! সামনে আরো দেখতে পাবো- যখন বিশ্বে প্রত্যেকটি পরিবারে অন্তত একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত সদস্য বা একজন ডিজএ্যাবল সদস্য থাকবে!
যেমন, বর্তমান বিশ্বে এমন পরিবার পাওয়া বিরল, যে পরিবারে অন্তত একজন ডায়াবেটিস বা হাইপারটেনশন বা কার্ডিও রোগী নেই!
সার্কাডিয়ান রিদম প্রতিদিন সঠিকভাবে সিনক্রোনাইজ হলে রাতের শুরুতেই ঘুম আসার প্রক্রিয়া সহজ হয় এবং ঘুমের মান উন্নত হয়। যারা বিভিন্ন ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য পিল বা সাপ্লিমেন্ট কোনো সমাধান নয়। বরং নিয়মিত সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় সূর্যের আলোতে এক্সপোজ হওয়া এবং রাতে সবধরনের কৃত্রিম আলো থেকে কঠোরভাবে দূরে থাকার মধ্যেই তাদের জন্য স্থায়ী সমাধান ও প্রকৃত উপকার রয়েছে।
রোদে যাওয়ার ব্যাপারটা মানুষ ফ্রিতেই পায়, তাই কঞ্জিউমার ক্যাপিটালিজম রোদকে ভিলেন বানিয়েছে। কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রি, স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড ও ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিং রোদকে ক্ষতিকর হিসেবে প্রচার করেছে, যেন মানুষ ভিটামিন D-এর জন্য বাইরে না যেয়ে সানস্ক্রিন, সাপ্লিমেন্ট ও ওষুধের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে!
এতে মানুষ নিত্যনতুন লাইফস্টাইল ডিজিজেও আক্রান্ত হচ্ছে!
রোদে না গেলে যা হয়—
- ভিটামিন D ঘাটতি
- ইনফ্লামেটরি ডিজিজ (যেমন আর্থ্রাইটিস, অটোইমিউন সমস্যা)
- ঘুমের ব্যাঘাত (কারণ মেলাটোনিন উৎপাদন ব্যাহত হয়)
- মেটাবলিক সিনড্রোম (ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা)
- চোখের দুর্বলতা
- মানসিক ক্লান্তি
- এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি
ভিটামিন D মূলত সূর্যের আলো থেকেই প্রাপ্ত হয়, খাদ্য থেকে নয়।দেহে ভিটামিন D তৈরি হয় UV-B রশ্মির মাধ্যমে। UV লাইট ছাড়া দেহে ভিটামিন D তৈরি হয় না।
যখন সূর্যের আলো ত্বকে পড়ে, তখন ত্বকের 7-ডিহাইড্রোকোলেস্টেরল রূপান্তরিত হয়ে প্রোভিটামিন D3 হয়, যা পরে লিভার ও কিডনিতে প্রসেস হয়ে ভিটামিন D-তে পরিণত হয়।
এই ভিটামিন D ছাড়া কোনো সুস্থ-সবল মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব না! এটি হাড়, ইমিউন সিস্টেম, হরমোন, মুড, মেটাবলিজম -সবকিছুর সঙ্গে জড়িত। যাদের ভিটামিন D ঘাটতি আছে তাদের শরীরটা হলো নানান রোগের বাসা!
এই ভিটামিন D ছাড়া—
- হাড় দুর্বল হয়ে যায়
- রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়
- মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়
- হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট হয়
- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।
বাজারের বেশিরভাগ কৃত্রিম সানস্ক্রিনে থাকে অক্সিবেনজোন (Oxybenzone), অ্যাভোবেনজোন (Avobenzone), অক্টিনক্সেট (Octinoxate) ইত্যাদি কেমিক্যাল! এগুলো ত্বকের মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করে, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, এন্ডোক্রাইন ডিসরাপ্টর হিসেবে কাজ করে! এই কেমিক্যালস জলজ প্রাণীর জন্যও বি/ষা/ক্ত। সবচেয়ে ভয়ংকর যেটা- এগুলো সূর্যের আলোতে অক্সিডাইজ হয়ে ত্বকেই ফ্রি র্যাডিকেল তৈরি করতে পারে! অর্থাৎ তথাকথিত যে সুরক্ষা দিতে এসেছে, সেটাই শেষমেশ ক্ষতি করে।
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে রোদের অপকার নেই বললেই চলে। এখানে রোদের তীব্রতা কখনোই ইউরোপ বা আমেরিকার মতো ক্ষতিকর হয় না। রোদের অপকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুষ্টি বা লাইফস্টাইলজনিত। সূর্যের আলো নিজে ক্ষতিকর নয়; অতিরিক্ত এক্সপোজার, পানিশূন্যতা এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ঘাটতির কারণে ক্ষতি হয়।
সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সূর্যস্নান করলে ভিটামিন D উৎপাদন হয় সর্বোচ্চ মাত্রায় এবং কোনো ক্ষতি ছাড়াই।
বাকী সময়ের রোদে না গেলে ভাল, কারণ কালো হয়ে যাবেন! তবে এটা ক্ষতিকর কিছু না।
রোদে গেলে ত্বক কালো হয়, কারণ যখন রোদের UV-B রশ্মি ত্বকে পড়ে, তখন ত্বকের মেলানোসাইটস কোষগুলো বেশি করে মেলানিন উৎপন্ন করে। এই ত্বক কালো হওয়া কোনো ক্ষতি না, বরং বডির ইন্টেলিজেন্ট সেল ডিফেন্স সিস্টেম!
মেলানিন হলো এক প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন, এটা সূর্যের ক্ষতিকর UV রশ্মি শোষণ করে ত্বককে পোড়া, ক্যান্সার ও ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
এদেশে যারা সারাদিন সারাজীবন মাঠের কড়া রোদে কাজ করে তাদের কি কখনো স্কিন ক্যান্সার হইতে শুনেছেন? স্কিন ক্যান্সার হয় কাদের সেটা একটু খোঁজ নেন।
বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলেরা বছরের পর বছর খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন। তাদের ত্বক প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তাদের মধ্যে ভিটামিন D লেভেল বেশি এবং ত্বকে মেলানিনের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় UV তাদের ক্ষতি করতে পারে না। তাদের মধ্যে স্কিন ক্যান্সারের হার প্রায় শূন্য! তারা সুস্থ, শক্তিশালী ও সাধারণত হাড়-গোড়ের রোগে কম ভোগেন!
গবেষণায় দেখা গেছে, স্কিন ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি হয় ফর্সা চামড়ার, ঠান্ডা আবহাওয়ার মানুষদের মধ্যে, যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার জনগোষ্ঠী।
এর কারণ তাদের মেলানিন কম, ফলে ত্বক UV রশ্মি প্রতিরোধ করতে পারে না। শীতের দেশে রোদের কোণ কম থাকে, তাই হঠাৎ করে গ্রীষ্মের রোদে গেলে ত্বক সহজে পুড়ে যায়।
বাংলাদেশ, ভারত, আফ্রিকার মতো দেশে, যেখানে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই রোদে থাকে এবং সবার ত্বক গাঢ় মেলানিনে সুরক্ষিত, সেখানে স্কিন ক্যান্সার অতি বিরল ঘটনা।
তবে এমনিতে অবশ্যই দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টার প্রখর রোদে দীর্ঘক্ষণ না থাকা ভালো। কারণ এই সময় অস্বস্তি, পানিশূন্যতা বা হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
মানুষের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই সানস্ক্রিন দেয়া আছে। কৃত্রিম বি/ষা/ক্ত কেমিক্যাল লাগানোর কোনো দরকার নেই। সেই প্রাকৃতিক সানস্ক্রিনটি হলো মেলানিন (Melanin)। মেলানিন হলো আমাদের শরীরের বিল্ট-ইন অ্যান্টি-ইউভি সিস্টেম!
ত্বকের মেলানোসাইট কোষগুলো মেলানিন তৈরি করে। UV রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে এটা ত্বক, চোখ, এমনকি মস্তিষ্ক পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। UV রশ্মি ত্বকে পড়লে মেলানিন তা শোষণ করে এবং এর ক্ষতিকর শক্তিকে তাপে রূপান্তরিত করে ছড়িয়ে দেয়। ফলে DNA ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, কোষে ক্যান্সার সৃষ্টির সম্ভাবনা কমে যায়।
UV রশ্মি ছাড়াও রোদের প্রায় ৫৪% হলো Near Infrared Light (NIR), যা চোখে দেখা যায়না, কিন্তু শরীরের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। এটি শরীরের ইনফ্লামেশন কমায়, মেলাটোনিন উৎপাদন বাড়ায়, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে, গাট মাইক্রোবায়োম ভাল রাখে, চোখ ও হাড়গোড় সুস্থ রাখে। এটি প্রকৃতির একটি বিনামূল্যের থেরাপি!
NIR রশ্মি ইমিউন সিস্টেমকে এমনভাবে শক্তিশালী করে যে, এটি সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক টিকার মতো কাজ করে!
এর উপকারিতাগুলো হলো—
- ইনফ্লামেশন (সোয়েলিং/জ্বালাভাব) কমায়
- সেলুলার মেলাটোনিন উৎপাদন বাড়ায়। যা ঘুম নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শরীরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে
- মাইটোকন্ড্রিয়ার কার্যক্ষমতা বাড়ায়, ফলে শক্তি উৎপাদন ভালো হয়
- ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়তা করে
- গাট মাইক্রোবায়োম সুস্থ রাখে। পরিপাকতন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে
- চোখ, ত্বক ও হাড়ের কোষ পুনর্গঠনে সহায়তা করে
- সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় করে।
- ডিপ্রেশন ও মানসিক চাপ কমায়
ক্যাপ্টেন গ্রিন