22/06/2025
সূর্যটা তখন ডুবুডুবু। পশ্চিমের আকাশ লালে লাল হলেও, জীর্ণ কুঁড়েঘরের ভেতরে সে আলোর ছোঁয়া লাগেনি তেমন। শুধু ভাঙা জানালা দিয়ে টিমটিম করে আসা আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছিলো ছেঁড়া কাঁথার ওপর বসা তিনটে প্রাণ। বাবা রহিম মিয়া হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছেন। তাঁর শরীরের কঙ্কালসার গঠন আর ফ্যাকাশে মুখ দেখে বোঝা যায়, বহু দিন ঠিকমতো মুখে অন্ন জোটেনি। মলিন, শতছিন্ন শার্টটা তাঁর শীর্ণ কাঁধে ঝুলে আছে।
সামনে চুপচাপ বসে আছে তার দুই সন্তান— ছোট মেয়ে মায়া আর তার চেয়ে দু'বছরের বড় ছেলে আকাশ। মায়ার ফ্রকটা কাঁধের কাছে ছেঁড়া, আর আকাশের প্যান্টের হাঁটুতে বড় একটা ফুটো। তাদের চোখগুলো বাবার দিকে নিবদ্ধ, নির্বাক বেদনায় ভরা। ক্ষুধায় তাদের পেট চিনচিন করছে, কিন্তু বাবার কান্না তাদের ক্ষুধাকেও যেন ছাপিয়ে গেছে।
রহিম মিয়ার চোখে জল, কারণ আজ সারাদিন খেটেও তিনি এক মুঠো চালও জোগাড় করতে পারেননি। তার মনে পড়ছিল গত রাতের কথা, যখন তাদের শেষ চালটুকুও ফুরিয়েছিল। তিনি বারবার চেষ্টা করেছেন, মানুষের কাছে হাত পেতেছেন, কিন্তু কেউ সামান্য খাবারটুকুও দিতে পারেনি। নিজের সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে না পারার এই অক্ষমতা তাঁকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল।
আকাশ ছোট হলেও বুঝতে পারছিল বাবার কষ্ট। সে ধীর পায়ে বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মলিন হাতটা বাবার পিঠে রাখল। "বাবা, কেঁদো না," তার ছোট্ট গলাটা ভয়ে জড়ানো। মায়া ভাইয়ের পিঠ ঘেঁষে বসে, তার ছোট্ট হাত দিয়ে বাবার ছেঁড়া শার্টের কোণাটা খামচে ধরল। তাদের নিষ্পাপ চোখে ছিল এক দৃঢ়তা— যেন তারা বলতে চাইছে, "আমরা আছি তো!"
রহিম মিয়া মুখ তুলে তাকালেন। তার চোখে জল, কিন্তু সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব করলেন। এই সন্তানরাই তো তার বাঁচার শেষ অবলম্বন। তাদের জন্য হলেও তাকে উঠে দাঁড়াতে হবে, আরেকবার চেষ্টা করতে হবে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু তাদের ছোট্ট কুঁড়েঘরের ভেতর ভালোবাসার আলো তখনও নিভে যায়নি। এই ভালোবাসা আর আশা নিয়েই হয়তো তারা আরও একটা নতুন দিনের অপেক্ষায় রইল।