02/07/2025
জিপসীদের নিয়ে শ্রীপান্থের এই বইটি পড়ে আমার ভেতর দু’রকম অনুভূতির জন্ম হয়েছে—একদিকে ঈর্ষা, অন্যদিকে অশেষ মায়া। এই বোহেমিয়ান নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দুটো দুর্ভেদ্য ঢাল ছিল—তাদের রোমানি ভাষা আর অননুমেয় দারিদ্র্যতা। আজ দুটোই বিলুপ্তপ্রায়।
জিপসীরা পরকালীন স্বর্গের প্রতি চরম উদাসীন, এজন্যই তারা স্বর্গকে নামিয়ে এনেছে এই পৃথিবীতে—নাচ, গান, রঙ, রূপ আর আদিমতার মাঝে। তারা উচ্চাশাহীন, ভূমিহীন, পদাতিক। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল কেবল একটিই—শান্তি। জিপসীরা নিজেদের পরিচয় দেয় "রোম" নামে—অর্থাৎ শুদ্ধ মানুষ। বিপরীতে তারা "গাজো"দের—অর্থাৎ গৃহস্থদের প্রতি রাখে চরম উদাসীনতা।
এই পৃথিবীতে যত ধরনের অন্যায়, দোষ আর পাপের ইতিহাস আছে, জিপসীরা তার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিতে প্রস্তুত থেকেছে সবসময়। কেন?
কারণ গাজোরা জিপসীদের পরিচয় জানতে ব্যাকুল।
আর সেই জানার চাপে পড়ে জিপসীরা বানিয়ে গেছে আজগুবি গল্প—ইহুদি বংশ, ইজিপশিয়ান রাজকুমারী কিংবা বাইবেলিক পৌরাণিক ইতিহাসের জাল। তারা ছিল দুর্দান্ত গল্পকার, আর সেই গল্পগুলোর মাধ্যমে গাজোদের চোখে ধুলা দিয়ে তারা বারবার পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে চেয়েছে—দূরে কোথাও, যেখানে শান্তি এখনো নিখাদ।
জিপসীদের ওপর যুগে যুগে নেমে এসেছে নিষ্ঠুরতার খড়গ। তাদের বলা হয়েছে—যাদুকর, দস্যু, তস্কর, গুপ্তচর। জিপসী নারীরা হয়ে উঠেছে লোককথার ডাইনি। তাদের বলা হয়েছে—বিদেশি, অস্থিরতা আর বিশৃঙ্খলার প্রতীক। কিন্তু সত্যি তো এই: তারা ছিল বিশুদ্ধ রোম—সৃষ্টিশীল, স্বাধীন, নৃত্য-সংগীত আর সম্পর্কের বন্ধনে গড়া এক স্বর্গীয় ভবঘুরে সম্প্রদায়।
তারা কখনো নিজেদের পরিচয় দিয়েছে ইহুদি, কখনো প্রাচীন মিশরীয় বলে; অথচ ইতিহাস বলে—তারা ভারতের সন্তান। তাদের ভাষা রোমানি—যা ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত৷ এক হাজার খ্রিস্টাব্দের দিকে মধ্যভারত থেকে আফগানিস্তান হয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে তারপর আফ্রিকা আর আমেরিকায়। তবে তাদের সঙ্গে সাধারণ বেদে বা যাযাবরদের পার্থক্য বিশাল; তারা ছিল একেবারে আলাদা, একেবারে স্বতন্ত্র।
আজকের আধুনিক সভ্যতার কাঁটাতারে জিপসীরা বন্দি। যারা ছিল পদাতিক ভবঘুরে, তারাই আজ ভূমিদাস, বাধ্য হয়ে গৃহস্থ হয়ে উঠছে। তারা চাকরি করছে, ব্যবসা করছে, কেউ কেউ শিল্পী, সাহিত্যিক, এমনকি বিজ্ঞানীও হচ্ছে। তবু তাদের বোহেমিয়ান জীবনে যে আত্মার মুক্তি ছিল, তা কি সত্যিই মুছে গেছে?
না, থেকে গেছে—মনের গহীনে জমে থাকা এক রকম দীর্ঘশ্বাস হয়ে। শুদ্ধ রোমেরা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে গাজোয়—অশুদ্ধ, পরাধীন, আটকে পড়া মানুষে।
“কেন তুমি ঘুরে বেড়াও?
জানতে চায় ওরা!
আমি জানি না,
উড়ে যাচ্ছে যে পাখি—
উত্তর দিক সে।
উত্তর দিক—বনের হরিণ।
যাদের আত্মায় ছিল জন্মগত ভবঘুরে হাওয়ার টান, মাঠি ছিল যাদের বিছানা আর আকাশ ছিল ছাদ, তাদের একমাত্র পরিচয় ছিল—অস্থায়ী আশ্রয়, দারিদ্র্যতা, শান্তি আর স্বাধীন জীবন। আজকের এই কৃত্রিম সমাজে তারাই পরিণত হয়েছে গৃহস্থে, হারিয়ে ফেলেছে সেই অবাধ্য, অদম্য রোমান আত্মাকে।
জিপসীদের নিয়ে লেখা এমন ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ বই বাংলা ভাষায় এককথায় অনন্য। সবারই এই বইটি পড়া উচিত। আর বিস্ময়করভাবে এই অসাধারণ গ্রন্থের লেখক শ্রীপান্থের জন্মস্থানও আমার জন্মস্থানের খুব কাছাকাছি। তার লেখা ঠগী, হারেম, দেবদাসী—এই বইগুলোও আমার পড়ার তালিকায় যুক্ত হয়ে গেল।
এই লেখাটি এক গৃহস্থের পক্ষ থেকে ভবঘুরে জিপসীদের প্রতি নিঃশব্দ শ্রদ্ধাঞ্জলি। যারা একদিন ছিল পৃথিবীর শেষ সত্যিকারের স্বাধীন মানুষ।