
12/08/2025
ভাল ঘুম যেভাবে আপনাকে সুস্থ রাখে
আমাদের শরীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করে থাকে, যখন আমরা ঘুমাই। আপনি কি জানেন সেই কাজগুলি কী কী?
ঘুমকে আমরা যত হালকাভাবে দেখি, বিষয়টা আসলে তা না। ঘুমের সময় আমাদের শরীর শুধু বিশ্রামই নেয় না—বরং ভেতর থেকে নিজেকে মেরামত ও শক্তিশালী করে তোলে। এটা একাধিক পর্যায়ে সম্পন্ন হয়।
অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত ঘুম পরবর্তীতে আলঝাইমারের মত রোগের ঝুঁকিও বাড়ায়। তাই শুধু বর্তমানের কথা ভেবে নয়, ভবিষ্যতে সুস্থ থাকতে চাইলেও ভাল ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। তার আগে জেনে নেওয়া যাক, ঘুম কীভাবে কাজ করে।
ঘুম কীভাবে কাজ করে
ঘুমের মূল দুটি ধাপ হল—REM (Rapid Eye Movement) এবং non-REM ঘুম।
non-REM ঘুমে শরীরের কোষ মেরামত হয়, টিস্যু পুনর্গঠিত হয় এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
REM ঘুম মনে রাখার ক্ষমতা, শেখার গতি এবং আবেগের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
গভীর ঘুমে শরীর পেশি, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং কোষ মেরামতের কাজে মনোযোগ দেয়। এই সময় শরীরে গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়, যা কোষ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইসাথে, প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে এমন সাইটোকাইন নামের প্রোটিন তৈরি হয়, যা সংক্রমণ ও প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
ঘুমের সময় শরীর গুরুত্বপূর্ণ হরমোন যেমন মেলাটোনিন নিঃসরণ করে, যা আমাদের ঘুম-জাগরণের ছন্দ ঠিক রাখে। এ ছাড়া ঘুমের সময় উৎপন্ন হওয়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি ক্ষতিকর ‘ফ্রি র্যাডিক্যাল’ নিঃশেষ করে, যা কোষ ধ্বংস ও বয়স বাড়ার পেছনে দায়ী। ঘুমের সময় মেটাবোলিজম বা বিপাকক্রিয়া প্রায় ১০% কমে যায়, ফলে শরীর সেই শক্তি মেরামতের কাজে ব্যয় করতে পারে।
ঘুমে শুধু আমাদের শরীর নয়—মস্তিষ্কও সক্রিয়ভাবে কাজ করে। বিশেষ করে REM ঘুমে (যেখানে আমরা স্বপ্ন দেখি), স্মৃতি গঠিত হয় এবং শেখার প্রক্রিয়া দৃঢ় হয়। মস্তিষ্ক এসময় নিজেকে ‘পরিষ্কার’ করে—বর্জ্য ও বিষাক্ত উপাদান দূর করে দেয়, যেগুলি স্নায়ুর রোগের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। REM ঘুম আবেগ প্রক্রিয়াকরণেও সাহায্য করে, মানসিক চাপ ও ট্রমা সামলাতে মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করে।
অর্থাৎ, ঘুম কোনো নিষ্ক্রিয় সময় নয়। এটা এমন এক জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে শরীর নিজেকে সারায়, প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, আর মস্তিষ্ক স্মৃতি ও আবেগ সংগঠিত করে।
ভাল ঘুমের উপকারিতা
আসলে ঘুম কী কী উপকার করে আমাদের সেটা বুঝতে পারলে বাকি অংশটুকুও সহজ হয়ে যায়। তাই আপনি যখন ভাল ঘুমের জন্য চেষ্টা করছেন, নিজের স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় উপকারটি করছেন।
ঘুম যা যা করে:
১. কর্মশক্তি ও মনোযোগ বাড়ায়
ভাল ঘুমের পরদিন আপনি বেশি চাঙা, মনোযোগী ও সক্রিয় থাকেন। অন্যদিকে, ঘুম কম হলে সারাদিন ক্লান্ত লাগে, দিনের বেলা ঝিমুনি হয়, যা কাজের গতি কমিয়ে দেয় এবং মনোযোগের অভাবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ায়।
২. মানসিক স্বাস্থ্যে সহায়তা করে
যথেষ্ট ঘুম মানে মনের শান্তি। ঘুম কম হলে আপনি সহজে রেগে যেতে পারেন বা দুশ্চিন্তা ও অবসাদে ভুগতে পারেন।
৩. শরীর মেরামতে সাহায্য করে
ঘুমের সময় শরীর তার ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলি মেরামত করে। এই সময় শরীর থেকে হিউম্যান গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয়, যা কোষ পুনর্গঠন ও পেশি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
৪. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
ঘুমের সময় শরীরের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়, যা হৃদযন্ত্রের উপর চাপ কমায়। ঘুম কম হলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বেড়ে যায়।
৫. রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে
ঘুম ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। ঘুমের ঘাটতি ইনসুলিন প্রতিরোধ বাড়িয়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
৬. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়
ঘুমের সময় মস্তিষ্ক থেকে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য দূর হয়, যা মনোযোগ, শেখার ক্ষমতা ও যুক্তিপূর্ণ চিন্তায় সহায়তা করে। ঘুম কম হলে বিভ্রান্তি, ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া ও মনোযোগ হারানোর সম্ভাবনা থাকে।
৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে
ভাল ঘুম শরীরকে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্ষম করে তোলে। ঘুমের ঘাটতি টিকা নেওয়ার কার্যকারিতাও কমিয়ে দিতে পারে।
৮. মানসিক চাপ কমায়
ঘুমের সময় স্নায়ু ও মস্তিষ্ক চাপমুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। ফলে ঘুম থেকে উঠে মন ফুরফুরে লাগে এবং উদ্বেগও কিছুটা কমে যায়।
৯. শরীরচর্চা ও পারফরম্যান্স উন্নত করে
আপনি যদি ক্রীড়াবিদ হন বা শরীরচর্চা করেন, তবে ঘুম আপনার স্ট্যামিনা, শক্তি ও রিকভারি বাড়ায়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন, আঘাত পাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
১০. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে
ঘুম ক্ষুধা ও তৃপ্তির হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করে। ঘুমের অভাবে এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, যার ফলে ক্ষুধা বেড়ে যেতে পারে ও ওজন বাড়তে পারে।
আপনার কতটুকু ঘুম প্রয়োজন?
প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণভাবে প্রতিদিন ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন হয়। তবে সবার ঘুমের চাহিদা একরকম হয় না—কারও হয়ত একটু বেশি লাগে, কারও কম প্রয়োজন হয়।
কম ঘুমানো নিয়ে অনেক সময় অনেকেই গর্ব করে থাকেন, আসলে বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদে আপনার শরীরের ক্ষতি করছে। অন্যদের চাইতে যদি আপনার বেশি ঘুমের প্রয়োজন হয়, তা নিয়ে লজ্জা পাবার কিছু নেয়। সুস্থতাই এখানে মূল লক্ষ্য।
যদি দেখেন দিনের বেলা নিয়মিত ক্লান্ত বা অমনোযোগী অনুভব করছেন, সেটার কারণ হতে পারে আপনার আরও ঘুম দরকার।
ঘুমের চাহিদা বয়স অনুযায়ী কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। যেমন ১৮–৬৪ বছরে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুম আদর্শ ধরা হয়। ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সে: সাধারণত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। তবে যেমনটা আগেই বলা হয়েছে ব্যক্তিভেদে কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবেই কম ঘুমিয়ে ভাল থাকেন, কেউ আবার একটু বেশি ঘুম না হলে দিনের স্বাভাবিক কাজগুলি ব্যাহত হয়।
বয়স, দৈহিক পরিশ্রম, প্রয়োজন, স্বাস্থ্য সমস্যা বা গর্ভাবস্থার মত বিষয়গুলি বিবেচনা করে ঘুমের দৈর্ঘ্য বাড়তে বা কমতে পারে।
তাছাড়া আলাদাভাবেই অনেক সময় নারীদের ঘুমের চাহিদা পুরুষদের তুলনায় সামান্য বেশি হতে পারে। কারণ, মাসিক চক্র, গর্ভাবস্থা বা মেনোপজের মত সময়গুলিতে হরমোনের পরিবর্তন ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, অনেক নারী একসাথে পরিবার, কাজ ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব সামলান—যার প্রভাব ঘুমের মান ও সময়—দুটোর ওপরই পড়ে।
ভালো ঘুমের জন্য কিছু সহজ অভ্যাস
১. প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমান ও উঠুন
একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা শরীরের অভ্যন্তরীণ ছন্দ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এতে ঘুম সহজে আসে এবং ঘুমের মানও ভাল হয়।
২. দুপুরে হালকা বিশ্রাম নিতে পারেন, তবে বেশি নয়
দুপুরে ১৫-২০ মিনিট চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিলে কাজে মনোযোগ বাড়ে। তবে দীর্ঘ সময় ঘুমালে মাথা ভার লাগতে পারে, আর বিকালে ঘুমালে রাতে ঘুম আসতে দেরি হয়।
৩. ঘুমানোর ঘর শান্ত ও আরামদায়ক রাখুন
ঘর যেন থাকে হালকা ঠাণ্ডা, নিঃশব্দ ও আলোহীন। দরকার হলে ব্যবহার করুন ভারি পর্দা, চোখ ঢাকার মাস্ক বা শব্দ কমানোর জন্য ইয়ারপ্লাগ।
৪. বিছানা হোক শরীরের জন্য আরামদায়ক
যদি গদি নরম বা বেশি শক্ত হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সঠিক বালিশ বেছে নিন, যাতে শরীর সঠিকভাবে বিশ্রাম নিতে পারে।
৫. সন্ধ্যার পর চা-কফি পান থেকে বিরত থাকুন
এই উপাদানগুলি স্নায়ুকে উদ্দীপিত করে, ফলে ঘুম আসতে দেরি হয় বা মাঝরাতে ঘন ঘন জেগে উঠতে হয়।
৬. ব্যায়ামের সময় ঠিক করুন
ব্যায়াম শরীরে ফিল গুড হরমোন নিঃসরণ করে। যা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই সকালে বা বিকালে শরীরচর্চা করুন, সন্ধ্যা বা রাতে না করে।
৭. ঘুমানোর আগে মোবাইল বা স্ক্রিন থেকে দূরে থাকুন
শোওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে ফোন, ট্যাব বা টিভি বন্ধ রাখুন। তার বদলে হালকা বই পড়া, ধীর গতির গল্প শোনা বা হালকা গরম পানিতে গোসল করা ঘুমের জন্য সহায়ক।
৮. নিজের ঘুম সম্পর্কে সচেতন থাকুন
কতক্ষণ ঘুমাচ্ছেন, কেমন ঘুম হচ্ছে—এসব বুঝতে চাইলে ঘুমের রেকর্ড রাখা যেতে পারে। প্রতিদিন সকালে ভাবুন—ঘুম থেকে উঠে ফুরফুরে লাগছে কিনা। যদি না লাগে, তবে হয়ত ঘুমের অভ্যাসে কিছু বদল আনা দরকার।
চিকিৎসকের সঙ্গে কখন কথা বলবেন?
• ঘুমের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চললে
• চেষ্টা করেও লাভ না হলে
• ঘুমের ঘাটতির প্রভাব কাজ, পড়াশোনা বা দৈনন্দিন জীবনে পড়লে
• আপনার কতটুকু ঘুম প্রয়োজন না বুঝতে পারলে
ঘুম শুধু বিশ্রামের ব্যাপার নয়—এটা জীবনের অপরিহার্য ভিত্তি। প্রতিদিন ভাল ঘুম মানেই শারীরিক শক্তি, মানসিক স্থিতি ও দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা। নিজের ঘুমের যত্ন নিন, এই অভ্যাসটাই হতে পারে আপনার সুস্থ জীবনের সবচেয়ে সহজ শুরুর পথ।
@ City Bank