25/02/2024
স্যার ফজলে হাসান আবেদঃ
-----------------------------------------------------
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর ফজলে হাসান আবেদ। যে কয়েকজন বাংলাদেশি তাঁদের কর্মগুণে বিশ্বজুড়ে পরিচিত, স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁদের অন্যতম।
১৯৭২ সালে তাঁর হাত ধরে যাত্রা শুরু করা ব্র্যাক এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও। গরিবের বাতিঘর হয়ে ওঠা এই মানুষটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ব্র্যাক’-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ।
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এরপর তিনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হয়েছিলেন। সেটা বাদ দিয়ে তিনি লন্ডনের চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউনট্যান্টসে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি তাঁর প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে এসে ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানিতে যোগ দেন এবং দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
শেল অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এরফলে অসংখ্য মানুষ মারা যায়, আহত হয় আরও অধিকতর মানুষ।
এ সময় তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত মনপুরা দ্বীপের অধিবাসীদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানে তাঁরা ব্যাপক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ডে চলে যান। সেখানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ফজলে হাসান আবেদ সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি তাঁর লন্ডনের ফ্ল্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে দেশে এসে ত্রাণকাজ শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা এলাকায় কাজ শুরু করেন। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায়ই তিনি ব্র্যাক গড়ে তোলেন।
গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে তাঁর দীর্ঘ অভিযাত্রার সূচনা ঘটে। দরিদ্র মানুষ যাতে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারে, সেই লক্ষ্যে তিনি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে সেই ভিত্তিতে তাঁর কর্মসূচি পরিচালনা করেন।
চার দশকের মধ্যে তিনি তাঁর অভূতপূর্ব নেতৃত্বের মাধ্যমে ব্রাকের কর্মকাণ্ডের এতোটাই বিস্তার ঘটান। যার কারণে ব্র্যাক পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহত্ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।
বর্তমানে বিশ্বের ১২টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তেরো কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে নিরলস কাজ কাজ করে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের সুযোগ্য নেতৃত্বই অজস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের অনন্য সাধারণ এই অর্জনকে সম্ভব করে তুলেছে।
বস্তুত প্রতিষ্ঠাতার স্বাপ্নিক দূরদৃষ্টি, অদম্য সাহস এবং গতিশীলতা ব্র্যাকের ক্রম অগ্রযাত্রা, নব নব নিরীক্ষা ও সম্প্রসারণের নিরন্তর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে গেছে। ফলে দেশ-বিদেশে পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
ফজলে হাসান আবেদ সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য সাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ ২০১৬ সালে ‘টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ’ পদক লাভ করেন।
খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৫ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১৩ সালে তিনি হাঙ্গেরির ‘সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি’ (সিইইউ) থেকে ‘ওপেন সোসাইটি প্রাইজ’ লাভ করেন।
২০১১ সালে তিনি কাতার ফাউন্ডেশন প্রবর্তিত শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ওয়াইজ প্রাইজ’ লাভ করেন। ২০১০ সালে দারিদ্র্য-বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি যুক্তরাজ্যের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মানজনক উপাধি ‘নাইটহুড’ লাভ করেন।
এ ছাড়া তিনি ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড , ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড, হেনরি আর ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশিপ, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) প্রদত্ত আজীবন সম্মাননা গেটস্ অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ।
তাছাড়া মানব উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য ইউএনডিপি মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড , গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার , দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল এনট্রাপ্রেনিওরশিপ অ্যাওয়ার্ড, ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড।
এছাড়া আরও পেয়েছেন, ইউনিসেফ মরিস পেট অ্যাওয়ার্ড, অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার, ইউনেসকো নোমা পুরস্কার এবং র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফর কমিউনিটি লিডারশিপ লাভ করেন।
মানবিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য ব্র্যাক বিশ্বের সর্ববৃহত্ পুরস্কার কনরাড এন হিলটন হিউম্যানিট্যারিয়ান অ্যাওয়ার্ড এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ (২০০৭) লাভ করেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর ফজলে হাসান আবেদ এর আজ জন্মদিন। আজকের এই দিনে উনাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।