07/08/2025
‘আপা তোরা কালকে ভোরে যাবি?'
‘হ্যাঁ।’
‘এক কাজ করিস? আমাদের বাসা থেকে নিয়ে যাস কেমন? একসাথে গেলাম।'
‘আচ্ছা নিয়ে যাবো তৈরি হয়ে থাকিস। বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে আসবো।'
‘আপা শোন, আসবার সময় তোর একটা শাড়ি নিয়ে আসবি? আমার অবশ্য একটা ভালো শাড়ি আছে। কিন্তু শাড়িটার একপাশ থেকে ছিঁড়ে গেছে। রাফির বাবা বলেছে এখন শাড়ি কিনতে, তবে একদিনের জন্যে এতো দাম দিয়ে শাড়ি কিনে কি হবে বল। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করবার কোনো মানে নেই। আমি না করে দিয়েছি। ভাবলাম তোর তো অনেক শাড়ি আছে, একটা শাড়ি নিয়ে আসতে বলবো।'
‘আচ্ছা নিয়ে আসবো।’
মা বড় খালার সাথে কথা বলে ফোন রাখে। আমি এবং বড় আপা দুজনেই খুশি। অবশ্য খুশির কারণ আছে। খালার সাথে মা যখন কথা বলছে মায়ের দুইপাশে আমরা দুজন কান পেতে ছিলাম, কি বলে এটা শুনতে।
আগামীকাল বড় মামার মেয়ে রাজিয়া আপার বিয়ে। মামা বলেছেন সবাইকে নিয়ে যেতে। বিয়ে নিয়ে আমাদের বাসায় একটা উৎসব শুরু হয়েছে।
আমাকে নতুন জুতা কিনে দিয়েছে, আপাকে নতুন একটা সেলোয়ার-কামিজ দেওয়া হয়েছে।
খালার সাথে কথা বলবার সময় মা একটা মিথ্যা বলেছে, বাবা মাকে শাড়ি কিনে দেবার কথা বলেনি। আমাদের দুই ভাই বোনকে যা কিনে দেওয়া হয়েছে এই টাকাই বাবা ধার করেছেন।
বড় খালাদের গাড়ি আছে, একটা লাল রঙের গাড়ি। যেহেতু খালা যাবে, আমাদের সাথে নিয়ে গেলে আমরাও লাল রঙের গাড়িতে যেতে পারবো। গাড়িতে চড়তে আমাদের বেশ ভালো লাগে। খালাদের গাড়িটা অনেক সুন্দর।
বাবা অফিস থেকে আসলেই, মা বলে শুনেছো সাবিনার সাথে আমার কথা হয়েছে। ওরা যখন যাবে তখন আমাদের নিয়ে যাবে। বাবা বলেন, তাহলে ভালো হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ যাওয়া আসবার গাড়ি ভাড়া বেঁচে যাবে। মা বলেন, হ্যাঁ কতোগুলো টাকা গাড়ি ভাড়া যেতো।
বাবাও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
রাতে আমার ঘুম হয়না। অপেক্ষা করতে থাকি কখন ভোর হবে, ভোর হলেই খালা লাল রঙের গাড়ি নিয়ে আসবে, তারপর গাড়িতে মামার বাসায় যাবো। কিছু স্বপ্ন দেখি, সেই স্বপ্নে দেখি লাল গাড়িতে বসে আছি, গাড়ি চলছে, আর জানালা দিয়ে আসা বাতাস শরীর শীতল করে দিচ্ছে।
ফজরের আজান দিলেই বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরে হাঁটতে থাকি। মা বলেন, এতো তাড়াতাড়ি উঠে গেলি? আমি বলি হ্যাঁ ঘুম আসে না কি করবো? মা নামাজে বসে যায়। আমিও ওজু করে এসে নামাজ পড়ি।
সকালের রোদ জানালা দিয়ে ঘরে আসে, আমি আর বড় আপা দুজনেই তৈরি হয়ে নেই। বাবা গোসলে গেছেন, মা গোসল করে ঘরে পরবার একটা কাপড় পরে। বড় খালা আসলেই শাড়িটা পরবেন।
সকালের রোদের তাপ বাড়তে থাকে, মা বড় খালার বাসায় ফোন করেন তবে কেউ ফোন তুলে না। বেশ কয়েকবার কল দেয়, তবে কেউ ফোন ধরে না। ঘন্টাখানেক চলে যায়, মা ভাবেন হয়তো খালা কোনো কাজ করছে কিংবা পথে আছে।
আমি আর আপা বেশ কয়েকবার গেটের কাছে যেয়ে দেখে আসি গাড়ি এসেছে কিনা। গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনলেই মনে হয় খালা এসেছে গাড়ি নিয়ে। একটা লাল গাড়িও দেখি, তবে কাছে আসবার পরে বুঝতে পারি এটা খালাদের লাল গাড়ি না।
মা একটু পরপর ফোন করেন, ঘরের ভিতরে যায় কিছুসময় পরে আবার ফোনের কাছে এসে কল করে। কিছুসময় পরেই ফোনটা রিসিভ হয়।
মা এক শ্বাসে বলে ‘হ্যালো আপা শুনছিস? তোর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? ওরাতো সবাই তৈরি হয়ে বসে আছে। রাফি ভোরে উঠেছে। তোর আসতে কতক্ষণ লাগবে? কখন বের হবি? অনেক বেলা হয়ে গেলো যে।'
ওইপাশ থেকে কলটা বড় খালা ধরেনি, ধরেছে খালার বাসায় কাজের মেয়ে চুমকি। চুমকি জানায় খালা বের হয়ে গেছে সেই ভোরেই, এখন হয়তো পৌছে গেছে তারা।
মা এবার মামার কাছে ফোন করে, মামা জানায় বড় খালা পৌছে গেছে। মামা বলে, তোরা কখন আসবি? তাড়াতাড়ি চলে আয়। মা বলে, আচ্ছা ভাইয়া আসছি। আপার তো আমাদের এখান থেকে যাবার কথা ছিলো, হয়তো ভুলে গেছে।
মা শীতল গলায় মামার সাথে কথা বলে ফোন রাখে। মায়ের চোখে দেখি টলমল করা পানি।
মা বাবাকে বলে, শুনো তুমি ওদের দুজনকে নিয়ে চলে যাও। আর ভাইয়া কিছু বললে, বলবে আমার শরীরটা খুব খারাপ। বাবা বলে, সে কি তুমিও চলো। গেলে সবাই যাবো না হয় কেউ যাবো না।
‘কেউ যদি না যাও ভাইয়া খুব রাগ করবে। তুমি ওদের নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো।’
আমাদের বাসায় যে উচ্ছ্বাস ছিলো সবকিছু থেমে যায়। যেমন ঝড়ের পরে সবকিছু শান্ত হয়ে যায় তেমনই শান্ত একটা পরিবেশ।
তখনই দরজায় কে যেনো ধাক্কা দেয়। বাবা দরজা খুলে দেখে আমাদের বাড়িওয়ালা আন্টি এসেছে। আন্টি বলে, কিরে তোমরা নাকি তোমার ভাইয়ের বাসায় যাবে, এখনো বের হওনি।
মা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নেয়, এমনভাবে চোখ মুছে যেনো কপালের ঘাম মুছতে যেয়ে গোপনে চোখ মুছে নেওয়া।
মা বলে, ভাবি আমি যাবো না। বাবুর বাবা যাবে ওদের নিয়ে।
‘সে কি তুমি যাবে না কেন?’
‘ভাবি আমার একটা শাড়ি ছিলো। কেবল আলমারি থেকে বের করতে যেয়ে দেখি উইপোকায় কেটে ফেলেছে।'
‘সেই কারণে যাবে না? তুমি আমার কাছে গেলেই তো হতো।'
আপার দিকে তাকিয়ে বলে, অনামিকা তুমি আমার সাথে এসো। একটা শাড়ি নিয়ে যাবে।
বাড়িওয়ালা আন্টির সাথে আপা তাদের ঘরে যায়। কিছুক্ষণ পরেই একটা শাড়ি নিয়ে আসে।
বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, এবার বসে না থেকে তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নেও। বের হতে হবে এখনি।
মা শাড়িটা পরে নেয়। আমরা লেগুনায় উঠে বসি, তারপর বাস ধরি। মামাদের বাসায় আসতে আসতে প্রায় দুপুর হয়ে যায়।
মামাদের বাসায় একদিন থেকে ঠিক পরদিন ভোরে আমরা আবার ঢাকা আসি।
মা অভিমান করে এরপর আর খালাকে ফোন দেয়নি। মায়ের অভিমান আসলে তুচ্ছ অভিমান। যে অভিমান খালা কোনোদিন আর ভাঙানোর প্রয়োজন মনে করেনি।
বাবার বদলি হয় কুমিল্লা। আমরা ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লা চলে আসি। কুমিল্লা শহরে আসবার পরে খরচটা একটু কমে। এখানে শহর থেকে একটু দূরে বাসা ভাড়া কম, শান্ত শীতল শহর। বাবার বেতন বাড়ে।
মাকে এরপর বাবা একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলো। যদিও সে শাড়ি সবসময় আলমারিতেই থাকে।
আমি স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে ভর্তি হই। কলেজে ভালো একটা রেজাল্ট আসে। কুমিল্লা শহরেই কোচিং করি, প্রথমবার কোথাও ভর্তির সুযোগ পাইনি। বাবার কতোগুলো টাকা নষ্ট করেছি এসব ভেবেই আপসোস হতো। আমার বন্ধুরা সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, যারা পায়নি ওরা প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছে। তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো টাকা আমার বাবার নেই।
এর ভিতরে আমি একটা সাইকেল কিনি, সাইকেল কিনবার টাকা আপা দিয়েছে। আপা তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ফুড ডেলিভারির কাজ করতাম। সেই টাকায় কোচিং করি, এবার মনে একটা শান্তি পাই। কোথাও চান্স না হলে আপসোস হবে না, নিজের টাকা খরচ হয়েছে এটা ভেবে নিবো।
সেকেন্ড টাইমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়। যাক অবশেষে নিজের শখ কিংবা ইচ্ছে যাই বলি পূর্ণতা পেয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই বছর যেতেই আমার স্কলারশিপ হয়ে যায়। দেশের বাহিরে চলে আসি। দেশ ছাড়বার ঠিক ছয়মাস পরেই আপার বিয়ে হয়, আপার বিয়েতে থাকতে না পেরে মন খারাপ হয়। সেদিন ক্লাস ছিলো, ক্লাসে বসেই দেখি চোখ টলমল করে পানি এসে গেছে। আপাও সে রাতে কল দিয়ে অনেক কেঁদেছে।
পড়াশোনার পাশাপাশি আমি এখানে এসে একটা লাইব্রেরিতে কাজ করতাম। কিছু টাকা থেকে যেতো মাস শেষে।
একা একা থাকতে খুব মন খারাপ হতো, মায়ের কথা মনে উঠতো অনেক তবু মানিয়ে নিয়েছি। মায়ের সাথে কথা বলতে গেলে মা বেশিরভাগ সময় কেঁদে ফেলতো কথা বলতে বলতেই।
পড়াশোনা শেষ হবার পরে একবছর লাইব্রেরিতেই কাজ করতে হয়। কোথাও থেকে তেমন ভালো চাকরির কোনো অফার পাইনি। এর ভিতরে এখানকার একটা কোম্পানিতে চাকরি হয়। বেতন বেশ ভালোই, বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে পারি।
দেশেও কয়েক জায়গায় সিভি দিয়ে রেখেছি। আমার ইচ্ছে বাংলাদেশেই থাকবো।
সেদিন অফিস থেকে এসে গোসল থেকে বের হয়েছি তখনই একটা মেইল আসে। বাংলাদেশের একটা কোম্পানি থেকে আসে সে মেইল, তারা সব কাগজপত্র দেখবার পরে আমাকে ওখানে ডেকেছে।
আমি তাদের সাথে কথা বলে দশ দিনের সময় নেই। দশদিন পরে দেশে আসি। আপা আর দুলাভাই ঢাকা থাকে ওরা দুজনেই এয়ারপোর্টে এসেছে। এয়ারপোর্ট থেকে আপার বাসাতেই যাই। পরদিন ঢাকার সেই কোম্পানিতে কথা বলে বিকালে কুমিল্লা যাই বাবা মায়ের কাছে।
কুমিল্লা দুদিন থেকে ঢাকা এসে চাকরিতে যোগ দেই। বেশ ভালোই চলছে নতুন চাকরি। ভালো অংকের একটা বেতন।
দেখতে দেখতে চাকরির একবছর চলে যায়, আমার নিজের একটা ছোটো কোম্পানিও হয়েছে। বাবা আর মাকে সেবার খবর দিয়ে ঢাকা নিয়ে আসি। আপার বাসায় বেড়ানোর কথা বলেই তাদের নিয়ে এসেছে আপা৷ বাবা মা আপার বাসাতেই উঠে। গতরাতে তারা এসেছে।
আমি একটা ঠিকানা দেই, আপা পরদিন সকালে বাবা মাকে নিয়ে সেখানে চলে আসে।
বাহিরে সকালের রোদের তাপ বাড়ছে, একটা শোরুমের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি কখন বাবা মা আর আপা আসবে। আজকে অপেক্ষা করতে খারাপ লাগছে না। কিছুক্ষণ পরেই আপা বাবা মাকে সাথে নিয়ে আসে।
একটা লাল রঙের গাড়ি কিনি। বাবা, মা, আপা, দুলাভাই বসে আছে একসাথে গাড়িতে। মা বারবার চোখ মুছে নিচ্ছেন, বাবা শক্ত মানুষ। তবে দেখি বাবার চোখেও পানি। আপা কথা বলতে পারছে না, গলা ধরে আসছে। আপার মুখে হাসি সাথে চোখে পানি। একটা লাল রঙের গাড়িতে সবাই কাঁদছে তবে আমার হাসি আসছে খুব, আমি আড়চোখে সবার চোখ দেখছি। কাঁদুক না হয় কিছুসময়।
আমাদের লাল গাড়ি
©