30/10/2025
বেস্ট সেলার::
বইয়ের দুনিয়ায় ‘বেস্ট সেলার’ একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। কিন্তু কেউ সুনির্দিষ্টভাবে জানেন না, কীভাবে একটি বেস্টসেলার বই লেখা হয়। তবু কিছু তরিকা তো আছেই। সেসব তরিকা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার আগে নিতে হবে মার্কিন লেখক ড্যানিয়েল স্টিলের নাম।
ড্যানিয়েল স্টিল এ পর্যন্ত ২০০টির বেশি বই লিখেছেন। সর্বশেষ বইটি বেরিয়েছে গত অক্টোবরে, নাম—সেকেন্ড অ্যাক্ট। তাঁর বই বিক্রির পরিমাণ বিস্ময়কর। সারা বিশ্বে এই লেখকের বই বিক্রি হয় প্রায় ১০০ কোটি। প্রকাশকদের দাবি, তিনি এখন বিশ্বের সেরা জীবন্ত বেস্টসেলার লেখকদের একজন। মার্কিনদের ঘরে ঘরে বইয়ের তাকে জায়গা করে নিয়েছে ড্যানিয়েল স্টিলের উপন্যাস। তিনি মূলত নিজেই একটি ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে উঠেছেন। এমন কাউকে কাউকে হয়তো এখনো পাওয়া যাবে, যারা তাঁর উপন্যাস পড়েননি, কিন্তু তাঁর নাম জানেন না, এমন মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে খুঁজে পাওয়া দুর্লভ।
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার সাহিত্য সমাজে তিনি অচ্ছুত! সারা পৃথিবীতেই বেস্ট সেলারদের সম্পর্কে ধারণা একই—তাঁরা ‘বাজারি লেখক’। তাঁদের ঠিক সাহিত্যিক বা আরও স্পষ্টভাবে বললে বলতে হয় ‘সুসাহিত্যিক কিংবা কালজয়ী সাহিত্যিক’ বলা হয় না।
ড্যানিয়েল বলেছেন, ‘আমার লেখায় কালজয়ী হওয়ার মতো উপাদান থাকে কি না, আমি জানি না। আমি এমন সব ঘটনাই লিখি, যা সচরাচর আমাদের সবার সঙ্গে কমবেশি ঘটে। আমার লেখার উপাদান হচ্ছে পরিবার, সম্পর্ক, প্রেম, ভালোবাসা, ভয়, ক্রোধ, প্রতিশোধ, সম্পদের লড়াই—এসবই।
এমন বিষয় নিয়ে তো আরও অনেকেই লিখছেন। কিন্তু সবাই তো আর স্টিলের মতো ব্যবসা জমাতে পারছেন না। এর অর্থ হচ্ছে, শুধু লেখার উপাদান বা বিষয়বস্তুর ওপর বইয়ের ব্যবসা নির্ভর করে না। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু দরকার হয়।
লন্ডনভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা সুইফট প্রেসের স্বত্বাধিকারী মার্ক রিচার্ড বলেছেন, বইয়ের ব্যবসা খানিকটা অদ্ভুত রকমের। শুধু ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ৩৭০ কোটি ডলারের বইয়ের বাজার রয়েছে। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন, এই বিশাল বইয়ের বাজারে শেক্সপিয়ারের মতো কালজয়ী সাহিত্যিকের অবদান খুবই সামান্য। এতে বরং ড্যানিয়েল স্টিলের মতো ‘বাজারি লেখক’দের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এমন সব বই লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়, যার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
মার্ক রিচার্ড জানান, একটি বইয়ের প্রথম মুদ্রণ সম্পন্ন (ছাপা ও বাঁধাই থেকে প্রচারণা) করতে কমপক্ষে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার পাউন্ড খরচ হয়। এই পরিমাণ অর্থ উশুল করতে বইটির অন্তত পাঁচ হাজার কপি বিক্রি করা লাগে। বেশির ভাগ তথাকথিত ‘সুসাহিত্য’ই পাঁচ হাজার কপি বিক্রি হয় না। কিন্তু ড্যানিয়েল স্টিলের বই শুধু ব্রিটেনেই এক বছরে বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার।
কখন-কোন বই বেস্টসেলার হয়ে উঠবে, তা আগে থেকে প্রকাশকেরা কখনোই বলতে পারেন না। পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউসের প্রকাশক মার্কাস ডহলে বলেন, সাফল্যের যেমন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, তেমনি বেস্ট সেলারেরও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। বেস্টসেলার সম্পর্কে কখনোই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না।
তারপরও বেস্টসেলার নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এ নিয়ে গবেষণাও চলছে বিস্তর। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্টসেলার তালিকা নিয়ে দীর্ঘ আট বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে ২০১৮ সালে ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। সেই গবেষক দলের প্রধান বুরকু ইউসেসয় বলেন, ‘আমরা বেস্টসেলার বইগুলোর মধ্যে কিছু “কমন ব্যাপার” লক্ষ করেছি। যেমন সেক্স ও সেলিব্রেটি। যেসব বইয়ে যৌনতার উপাদান রয়েছে, সেসব বইয়ের বিক্রি বেশি। এ ছাড়া জনপ্রিয় তারকাদের লেখা বই, বিশেষ করে আত্মজীবনী প্রচুর বিক্রি হয়। গত বছর ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স হ্যারির ননফিকশন বই স্পেয়ার প্রকাশ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই অতীতের বিক্রির সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।’
গবেষকদের আরেকটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বেস্টসেলার লেখকেরা প্রচুর লেখেন। এটিই বেস্টসেলার লেখকদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গুণ। মার্কিন থ্রিলার লেখক জেমস প্যাটার্সন এ পর্যন্ত ৩৪০টি বই লিখেছেন। ড্যানিলের স্টিল বলেন, তাঁর হাতের আঙুল থেকে রক্ত না ঝরা পর্যন্ত তিনি কি-বোর্ডে টাইপ করা থামান না। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর তিনটি করে উপন্যাস লেখেন তিনি, যদিও ১৯৭৩ সাল থেকে বই প্রকাশ করতে শুরু করেছেন ড্যানিয়েল স্টিল। গবেষক ফ্লেমিং বলেছেন, একজন বেস্টসেলার লেখক প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার শব্দ লেখেন। তাঁরা থ্রিলার ও রোমান্স উপন্যাস বেশি লিখে থাকেন। কারণ, এ ঘরানার বইই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়।
তবে এ কথাও সত্য, লেখকেরা নিজেও জানেন না যে তাঁর কোন বইটি বেস্টসেলার হবে। জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং ১৯৫৬ সালে ‘কীভাবে বেস্টসেলার বই লিখতে হয়’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, বেস্টসেলার বই লেখার খুব সহজ একটা রেসিপি আছে। সেটি হচ্ছে পৃষ্ঠা ওলটানোর কৌশল। অর্থাৎ গল্পটি এমনভাবে বলতে হবে, যাতে পাঠক পরের পৃষ্ঠা ওলটাতে বাধ্য হয়।
নরওয়ের জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক জো নেসবো বলেন, ভালো গদ্য হচ্ছে ভালো খাবারের মতো। কী কী উপাদান দিয়ে খাবারটা তৈরি করছেন, সেটি বড় বিষয়; খাবারটা সুস্বাদু কি না, সেটিই বড় বিষয়।
মার্কিন লেখক লিওনেল শ্রিভার বলেন, বেস্টসেলার লেখার যদি কোনো গাণিতিক সূত্র থাকত, তবে সবাই সেই সূত্র মেনেই লিখত। কারণ, সব লেখকই চান, তাঁর লেখা সর্বাধিক পাঠক পড়ুক।
গাণিতিক সূত্রের মতো সূত্র বা নিয়ম না থাকলেও বেস্টসেলার বইয়ের কিছু সর্বজনীন তরিকা তো আছেই। যেমন ঘরানা একটি বিষয়। এখন বেস্টসেলার তালিকায় অবধারিতভাবেই থাকে থ্রিলার, রোমান্স ও গোয়েন্দা ঘরানার বই। গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার তালিকায় ১০টির মধ্যে ৪টি বইই ছিল কুলিন হুভারের। তিনি মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস লেখেন।
গবেষকদের মতে, বেস্টসেলার বই লেখার আরও কয়েকটি তরিকা হচ্ছে, প্রধান চরিত্রকে ভ্রমণ করানো, অর্থাৎ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া, এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে যাওয়া এবং যাত্রাপথে তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা, হেমিংওয়ের মতো ছোট ছোট বাক্যে লেখা, আবেগের পুরনাবৃত্তি করা ইত্যাদি।
এসবের বাইরেও বেস্টসেলার লেখক হওয়ার আরেকটি তরিকা রয়েছে। সেটি হচ্ছে শিশুতোষ বই লেখা। শিশুদের বই বছরজুড়ে বিক্রি হয় এবং প্রজন্মজুড়ে ভক্ত তৈরি করে।
এখন সিদ্ধান্ত আপনার, আপনি কোন পথে হাঁটবেন।
প্রথম আলো