10/07/2025
স্কিনার ছিলেন আধুনিক মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান মুখ। তিনি তার পুরো জীবন কাটিয়েছেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, ‘প্রাণীরা কেন নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ করে এবং কিভাবে তা বদলানো যায়?’
এরপর এক্সপেরিমেন্ট শুরু করা হল। শুরুতে একটি কবুতরকে এক নির্দিষ্ট বাক্সে রাখা হল। বাক্সটির ভেতরে ছিল একটি বড় বাটন। শুরুতে কবুতরটি কৌতূহলবশত চারপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ সে বাটনে চাপ দিল, আর সাথে সাথেই একটি দানার মতো খাবার বেরিয়ে এলো। কিন্তু কবুতর তখনও বোঝেনি যে, বাটনে চাপ দিলেই খাবার পাওয়া যায়!
প্রত্যাশা থেকে প্রশিক্ষণ : ডোপামিনের খেলা
এরপর বিজ্ঞানী স্কিনার কবুতরকে শিখিয়ে দিলেন বাটনটিতে ঠোকর দিলে বা তার কাছে গেলে খাবার পাওয়া যায়! এরপর কবুতরটি যখনই বাটনটির দিকে এগিয়ে যায়, তখনই খাবার পায়। এক পর্যায়ে কবুতরটি বুঝতে শিখল, এই জিনিসটি খিদে মেটায়!
এরপর সে খিদে পেলে বাটন চাপে। পেট ভর্তি থাকলে আর চাপে না।
প্রতারণার সূচনা : র্যান্ডম রিওয়ার্ড!
এরপর স্কিনার এক ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করলেন। তিনি ‘র্যান্ডমলি’ খাবার দেওয়া শুরু করলেন। কখনো একবার চাপ দিলে খাবার আসে। কখনো পাঁচবার চাপলেও কিছু আসে না। কখনো দশবার চাপার পর একটি দানা আসে!
এখানেই ঘটল চমক!
কবুতর তো বোঝে না, কীভাবে, কখন খাবার আসবে! সে শুধু জানে, ‘এই বাটনে চাপ দিলে খাবার আসে। সুতরাং একদিন তো খাবার পাবই!’ ফলে কবুতর ক্ষুধার্ত হোক বা না হোক, সে বাটন চেপেই যায়… বারবার… অবিরত…
এরপর?
বাটন চাপার কাজটিই হয়ে উঠেছে তার মানসিক পুরস্কার। যদিও খাবার পাওয়া নিশ্চিত না, তবুও প্রত্যাশা, উত্তেজনা, ও অজানা ফলাফল, এই তিনটি মিলে তৈরি করেছে এক আসক্তি।
এই আচরণটিকে চালিত করে মস্তিষ্কের ‘ডোপামিন’ নামের হরমোন, যা তৈরি হয় যখন আমরা প্রত্যাশা করি কিছু ভালো ঘটবে, ভালো ঘটনা ঘটুক বা না ঘটুক!
এই স্কিনার-বক্স এক্সপেরিমেন্টের রয়েছে বহু রূপ! এটি শুধু কবুতর নয়, পরবর্তীতে অনেক প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। আর ভয়ংকর সত্য হলো, এই এক্সপেরিমেন্ট মানুষের জীবনেও ভয়াবহভাবে প্রয়োগ হয়!
আপনিও এমন কিছু করছেন, যা অতিশয় একঘেয়ে, অপ্রয়োজনীয়, নিরর্থক। তবুও সেটাই আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে করেই যাচ্ছেন!
আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
তাহলে নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন, প্রতিদিন কত ঘণ্টা আপনি ফেসবুক স্ক্রল করেন? কতক্ষণ ইউটিউবে একটার পর একটা অর্থহীন ভিডিও দেখেন? একই ভিডিও গেমে কতবার আপনি একই কাজ বারবার করেন? আপনি জানেন না কেন করছেন? তবুও করছেন… অবিরতভাবে।
যখন আমরা এমন কোনো কাজ করি, যার শেষে বাস্তব উপকার থাকে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ডোপামিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে, যেটা আমাদের আনন্দিত করে এবং ভবিষ্যতে সেই কাজের প্রতি আগ্রহী রাখে।
কিন্তু যখন সেই কাজের উপকার শেষ হয়ে যায়, তখন ধীরে ধীরে সেই ডোপামিন কমে যায়, আমরা বিরক্ত হয়ে যাই, আর আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনই, যখন আপনি এমন কিছু ‘পুরস্কার’ পেতে থাকেন, যার কোনো বাস্তব মূল্য নেই, কিন্তু তবুও এগুলো ডোপামিন তৈরি করে যায় বারবার।
যেমন, আপনার ফেসবুক পোস্টে হঠাৎ লাইক-রিঅ্যাকশন পাচ্ছেন। অসংখ্য কমেন্ট পাচ্ছেন। স্ক্রল করতে গিয়ে কোনো ফানি ছবি বা ফানি রিলস ভিডিও পেলেন। ভিডিও গেমে কোনো ডিজিটাল অ্যাওয়ার্ড পেলেন। অনলাইন কেনাকাটায় বিভিন্ন ছাড়ের কুপন পেলেন। কিংবা ইউটিউবের রেকমেন্ডেড ভিডিওর নোটিফিকেশন পেলেন!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বিষয়গুলোতে সময় নষ্ট করেন, এমন মানুষের সংখ্যা নিছক কম নয়! বরং আশংকাজনকভাবে বেশি! এই কাজগুলো কেন করে মানুষ? আনন্দ পায়, তাই।
এগুলোর প্রত্যেকটিই হচ্ছে ছোট ছোট র্যান্ডম পুরস্কার, যার মধ্যে নেই স্থায়িত্ব, নেই কোনো গভীরতা, তবুও মস্তিষ্ক ‘আহা!’ বলে ওঠে আর ডোপামিন ছড়িয়ে দেয়।
ফলাফল, আপনি আটকা পড়েন মিথ্যা মায়ায়। আপনি আর বুঝতেই পারেন না যে, আপনি আনন্দ পাওয়ার কারণে এগুলো করছেন না। বরং আনন্দের এক মিথ্যা প্রতিশ্রুতির জন্যই এ কাজগুলোতে মগ্ন হয়ে থাকছেন!
আপনি কোনো অর্থবোধক সাফল্যের পেছনে ছুটছেন না, বরং ছুটছেন এক ভুয়া অনুভূতির পুনরাবৃত্তির দিকে।
যতই আপনি এই কাজগুলো করেন, ততই আপনার মস্তিষ্ক এই অবাস্তবতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আপনি এখন ডোপামিন-কোকেইন গ্রহণ করছেন! একটা র্যােন্ডম রিওয়ার্ড সিস্টেম-এর অঘোষিত দাস হয়ে যাচ্ছেন!
এখানেই শেষ নয়!
এই রিওয়ার্ড সিস্টেমের সবচেয়ে বড় ধোঁকা কী জানেন? আপনার ডোপামিন বাড়লেও জীবন বদলায় না। আনন্দ বাড়লেও আপনি লক্ষ্য পৌঁছান না। তৃপ্তি আসে না—শুধু চাহিদাই বেড়ে যায়!
ঠিক এটাই ঘটে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর, যখনই আমরা ভার্চুয়াল জগতের মোহে পড়ে যাই। তখন মূলত আমরা ডুবে যাই এমন এক বাস্তবতাবর্জিত পৃথিবীতে, যার সবকিছুই কৃত্রিম, সাজানো, প্রলুব্ধকর।
আমরা হয়ে যাই ‘ডোপামিন অ্যাডিক্ট’! এই মিথ্যা বাস্তবতার বারবার সংস্পর্শে আমাদের মস্তিষ্ক নিজেকে নতুনভাবে গঠিত করতে শুরু করে। তা এমনভাবে গঠিত হয়, যাতে শুধু ডোপামিনের ক্ষুধাটাই পূরণ হয়। না থাকে নিয়ন্ত্রণ, না থাকে বিবেক, না থাকে গভীরতা। ধীরে ধীরে আমরা হয়ে উঠি তীব্র অভ্যাসের দাস, যার নাম ‘অন্তহীন আনন্দের সন্ধান’।
ফলে মস্তিষ্ক তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আপনি যে কাজটা আগে ভালোবাসতেন, এখন তা আর ভালো লাগে না। সম্পর্ক, সংযোগ, শুদ্ধ চিন্তা—সব ফিকে হয়ে যায়। আপনি ছোট ছোট আনন্দে অভ্যস্ত হয়ে যান, কিন্তু স্থায়ী শান্তি হারিয়ে ফেলেন।