09/06/2025
রানওয়েতে নয়, সোজা পরিত্যক্ত ঘাসের মাঠে নেমে পড়েছিল বোয়িং ৭৩৭ এর মত একটি সুবিশাল বিমান। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের সিদ্ধান্তের বদৌলতে বেঁচে যায় ৪৫টি তাজা প্রাণ। যে বিমানটি খন্ড খন্ড করে টুকরো করে ফেলার কথা ছিল সেটিই আবার ঘাসের মাঠ থেকেই উড়ে যায় আকাশে। এমনই এক চমকপ্রদ গল্প শোনাবো আজ আপনাদের।
১৯৮৮ সালের ২৪ মে, তৎকালীন নতুন বোয়িং ৭৩৭-৩০০ মডেলের বিমানটি সান সালভাদর থেকে লুইজিয়ানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে TACA Flight 110। মধ্যবর্তী বিরতি ছিল বেলিজ সিটিতে। সেখান থেকে এটি যাত্রা করে লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। ককপিটে ছিলেন ক্যাপ্টেন কার্লোস দার্দানো, এক চোখ হারিয়েও অসাধারণ দক্ষতায় উড়োজাহাজ চালানো এক কিংবদন্তি পাইলট। তাঁর সহকারী পাইলট ছিলেন অভিজ্ঞ ফার্স্ট অফিসার দিয়োনিসিও লোপেজ। এ ছাড়াও ককপিটে ছিলেন প্রশিক্ষক পাইলট ক্যাপ্টেন আর্তুরো সোলেই।
সব কিছুই ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী। তবে লুইজিয়ানা উপকূলের কাছে আসতেই আকাশের রূপ বদলাতে শুরু করে। দূরে গর্জে উঠছে মেঘ। পাইলটদের রাডারে ধরা পড়ে বিভিন্ন রঙের ঝড়-মেঘ — সবুজ, হলুদ, আর ভয়ংকর লাল, যার অর্থ প্রবল বৃষ্টিপাত ও বজ্রঝড়। কিন্তু তারা ভেবেছিলেন, দুইটি শক্তিশালী ঝড়ের মাঝ দিয়ে উড়ে গেলে নিরাপদে যাওয়া যাবে।
ফ্লাইটটি যখন ৩০,০০০ ফুট উচ্চতায়, তখন তারা প্রবেশ করে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে। পাইলটরা তখনই "কনটিনিউয়াস ইগনিশন" চালু করেন, সাথে ইঞ্জিন অ্যান্টি-আইসিং ব্যবস্থা। এটাই ছিল নিয়মিত পূর্ব প্রস্তুতি, কারণ বৃষ্টি বা বরফ জমে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
কিন্তু তাদের সকল প্রস্তুতি সত্ত্বেও, প্রকৃতি এক কঠিন পরীক্ষা নেয়। প্রচণ্ড বৃষ্টি, তীব্র তুষারধারা ও বজ্রঝড়ের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বিমানটির দুইটি ইঞ্জিনেই একসাথে "ফ্লেইমআউট" ঘটে — অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ১৬,৫০০ ফুট উচ্চতায় থাকা অবস্থায় হঠাৎই দুই ইঞ্জিন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।
ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতেই বিমানের বৈদ্যুতিক সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। পুরো বিমানটা তখন নিছক একটি গ্লাইডার — যেটি কোনো রকম ইঞ্জিন শক্তি ছাড়া কেবল বাতাসের উপর ভর করে নিচে নামছিল। পাইলটরা অবিলম্বে APU (অক্সিলারি পাওয়ার ইউনিট) চালু করেন, যাতে অন্তত ন্যূনতম বৈদ্যুতিক শক্তি ফিরে আসে। সেই APU দিয়েই চেষ্টা করা হয় ইঞ্জিন পুনরায় চালু করার।
প্রথমে "উইন্ডমিল রিস্টার্ট" — অর্থাৎ শুধু বাতাসের প্রবাহে ইঞ্জিন ঘুরিয়ে পুনরায় চালু করার চেষ্টা — ব্যর্থ হয়। এরপর APU-এর মাধ্যমে ইঞ্জিন স্টার্টার চালিয়ে আবার ইঞ্জিন চালু করতে পারলেও, দুটো ইঞ্জিনই কেবল ‘আইডল পাওয়ার’ পর্যায়ে থাকে। তাদের গতি বাড়াতে গেলেই তা অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। পাইলটরা সিদ্ধান্ত নেন, ইঞ্জিন বন্ধ করাই উত্তম — আগুন লেগে যেতে পারে। তখনও ১০,০০০ ফুট উপরে।
ফার্স্ট অফিসার লোপেজ তখন মেইডে মানে জীবন-মরণ সমস্যা এমন একটি কল দেন। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে নিকটবর্তী লেকফ্রন্ট বিমানবন্দরের নির্দেশ আসে। কিন্তু ততক্ষণে সেই এয়ারপোর্ট ছিল পৌঁছানোর জন্য খুব দূর। গতি ও উচ্চতা দুটোই কমে আসছিল দ্রুত।
এমন অবস্থায় পাইলটরা খুঁজতে থাকেন সম্ভাব্য জরুরি অবতরণের স্থান। তখনই চোখে পড়ে Gulf Intracoastal Waterway — একটি খাল যা দক্ষিণ নিউ অরলিন্স দিয়ে বয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন দার্দানো ঠিক করেন, খালেই ‘ডিচিং’ বা পানিতে জরুরী অবতরণ করবেন।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফার্স্ট অফিসার খেয়াল করেন খালের ডান পাশে একটা ঘাসে ঢাকা নাসা মিশুড অ্যাসেম্বলি ফ্যাসিলিটির লেভি, যেখানে হয়ত চেষ্টা করলে অবতরণ করা সম্ভব হলেও হতে পারে। ক্যাপ্টেন দার্দানো তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত বদলান।
শুধু চোখের ও অভিজ্ঞতায় ভর করে, কোনো প্রকার নেভিগেশন বা কোনো ইঞ্জিন শক্তি ছাড়া, দার্দানো বিমানটিকে নিঁখুতভাবে লেভির উপর নামিয়ে আনেন। ১৪৩,০০০ পাউন্ডের বোয়িং ৭৩৭ বন্ধ ইঞ্জিন নিয়ে নিঃশব্দে নামে পৃথিবীর বুকে — নরম ঘাসে, ছোট্ট এক জায়গায়।
সকল ৪৫ জন যাত্রী ও ক্রু নিরাপদে বেঁচে যান। কেবল সামান্য কিছু চোট পাওয়া যায়। বিমানটির ডান ইঞ্জিন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর সামান্য বরফে ক্ষয়।
NTSB তদন্ত করে দেখে, বিমানটি একটি শ্রেণি ৪-এর বজ্রঝড়ের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। এত বিশাল পরিমাণ পানি ইঞ্জিনে ঢুকে গিয়েছিল যে, তা এফএএ-এর মানদণ্ডেও নিরীক্ষণকৃত পরিস্থিতির চেয়েও বেশি ছিল। ফলস্বরূপ, ইঞ্জিনের ‘কমবাস্টর’ অংশে আগুন ধরে রাখতে পারেনি — ফলে ফ্লেমআউট।
CFM International এরপর ইঞ্জিনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে: যেমন (১) স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভারি বৃষ্টি বা বরফে “কনটিনিউয়াস ইগনিশন” চালু রাখার সেন্সর (২)
ইঞ্জিন নোজকোনে পরিবর্তন (৩) ফ্যান ব্লেডের দূরত্ব পরিবর্তন করে বরফ প্রতিরোধ (৪) অতিরিক্ত ওয়াটার ব্লিড ডোর ইত্যাদি।
প্রথমে ভাবা হয়েছিল বিমানটিকে খুলে খণ্ড খণ্ড করে নৌকায় সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু পরে বোয়িং-এর প্রকৌশলীরা লেভির পাশেই ইঞ্জিন পরিবর্তন করেন। এবং বিমানের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে নাটকীয়ভাবে, সেই বিমানটিই আবার উড়ে যায় — NASA’র পুরনো রানওয়ের উপর তৈরি হওয়া Saturn Boulevard নামের এক সরু সড়ক থেকে।
মেরামতের পর সেটি ফের কার্যকর হয়। বহু বছর ধরে, এটি সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সে ব্যবহৃত হয়, এবং ২০১৬ সালে বিমানটি তার কর্মজীবন শেষ করে।
আজও যখন কেউ আকাশে ঝড় দেখে ভয় পায়, তখন TACA Flight 110-এর গল্প প্রেরণা জোগায়। একজন পাইলটের সাহস, সঠিক সিদ্ধান্ত, এবং ঠান্ডা মাথার উপস্থিতিই বদলে দিতে পারে শত মানুষের ভাগ্য।
কার্লোস দার্দানো এক চোখে দেখতেন, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল হাজার চোখের চেয়েও তীক্ষ্ণ। আর সেদিন, আকাশে নয়, মাটিতে নেমেই তিনি প্রমাণ করেছিলেন — প্রকৃত নায়ক কখনো হার মানে না।