04/07/2025
৫ আগষ্টের আগে দলগতভাবে মজলুম দল হিসেবেই জামায়াতকে আমরা দেখেছি। জামায়াতের ভাইদের সবসময় ভেবেছি নিজেদের একান্ত আপন। বিশেষত ছাত্র শিবির থেকে উঠে আসা একাধিক ভাইয়ের সাথে পরিচয় সম্পর্ক ছিল খুব ভালো। সে জায়গা থেকে তাদের বিষয়ে সরাসরি বিরোধিতায় জড়াইনি কখনোই।
৫ আগষ্টের আগ পর্যন্ত মওদুদিবাদ যে একটা ইস্যু এটা আমার কাছে মারাত্মক বিরক্তের ছিল। বিরক্ত বলতে আমি এর আকিদা সম্পর্কে জানি কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে মজলুম একটি দলকে কুপোকাত করা বিষেদগার করার সবসময় বিরোধিতা করতাম আমি। রাস্তাঘাটে কত মানুষের সাথে কথা হয়েছে যারা জামায়াত কে পছন্দ করে কোনদিন তাদেরকে জামায়াতের বিরুদ্ধে বলিনি। এমনকি এখনো বলি না। আমার কাছে মনে হয় সাধারণ মানুষ ইসলামের জন্য জামাতকে পছন্দ করে। এর সাথে কোন মতবাদের সম্পর্ক নাই। এখন এমন কাউকে মতবাদের দোহায় দিয়ে একটি দলের সম্পর্কে খারাপ কিছু বলার পক্ষে আমি নই।
এক জামাতের প্রতি কট্রোরপন্থী থাকার জন্য আমাদের কত ওস্তাদের যে বিরোধিতা করেছি তার হিসেব নেই। এমনও হয়েছে আমাদের ওস্তাদদের বলেছি 'জামাতের ম্যালা দোষ থাকলেও আপনি আমাদের অনুরোধের কারণে পাবলিকলি জামাতের বিষয়ে বলবেন না। এ দলটি মজলুম। এদলের মানুষগুলো মজলুম। এখন কোন অবস্থায় তাদের বিরোধিতা করে তাদেরকে হত্যাযোগ্য করার পক্ষে আমরা না। বিশ্বাস করবেন কি না! বর্তমান জমিয়ত সভাপতি, ওবাইদুল্লাহ ফারুক সাহেবের এক পোস্টের বিরোধিতাও আমি করেছিলাম।
আমার কথা হচ্ছে, ইসলাম মুসলমানের কনসেপ্টে আমরা এক। আমাদের এক থাকতে হবে। জামাত যেভাবে মাজলুম আমরাও মাজলুম। আমরা মানে কওমীপন্থীরা। সাধারণ মানুষরা। সো এক মাজলুম আরেক মাজলুমের বিপক্ষে থাকার মানেই হয় না।
আমাদের ওস্তাদদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সবসময় জামাতের বিরোধিতা করে গেছেন। আমাদের তাম্বিহ করেছেন। বলেছেন, জামাত কী জিনিস আজ বুঝছনা, যখন বুঝবা তখন আফসোস করবা। এই জামাত কোনদিন আমাদের আপন ভাবেনি ভাবতে পারবেও না। আমি সহ আমাদের একটা পুরো জেনারেশন আমাদের ওস্তাদদের এই কথাগুলোর সবসময় বিরোধিতা করে এসেছি।
৫ আগষ্টের পর, জামাতের আমির সাবের কার্যক্রমে যেন আরো মুগ্ধ হলাম। এমন আমির যে দলের সে দলের বিরুদ্ধে আমরা যাই কীভাবে! তাছাড়া বাংলাবাজার কেন্দ্রিক উঠাবসায় জামাত ঘরানার লেখক সাহিত্যিকদেরও দেখেছি কত উদার, কত ভালো।
কিন্তু বিশ্বাস করেন রাসেল ভাই!
গত ১ বছরে জামাত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে জামাত কওমী কখনো ভাই ভাই হতে পারে না। সর্বোচ্চ সৎ ভাই হিসেবে বলা যেতে পারে এর বেশি না!
৫ আগষ্টের পর আমাদের রাজশাহীর একাধিক মসজিদ থেকে কওমী আলেমদের জোরপূর্বক বের করেছে দীর্ঘদিনের জুলুমের শিকার হওয়া জামাতের ভাইয়েরা। কোন কারণ নাই। উদ্দেশ্য একটাই মসজিদ দখলে নিতে হবে। প্রশাসনের কাছে কওমী আলেমদের আওয়ামীলীগের দোসর আখ্যা দিয়ে রাজশাহীর সবচেয়ে পুরোনো ঈদগাহের ইমামতি দখল করেছে তারা। অথচ যে দোষ দেখিয়ে তারা আমাদের দোসর বলে সে দোষের দোষী তারাও। বরং আরো বেশি করে।
রাজশাহীতে সাবেক মেয়র লিটনের আস্থাভাজন ৫ জন থাকলে একজন থাকত জামাতের মৌলভী মৌলানারা। মেয়র লিটনের প্রোগ্রামের প্রধান ক্বারী থাকত তারা। কিন্তু ৫ আগষ্ট পর তারাই হয়ে গেল বড় বিপ্লবী বড় জামাতি।
রাজশাহীর কিছু আলেমকে একান্ত বাধ্য হয়ে মেয়র লিটনের সাথে সখ্যতা রাখতে হয়েছে। কিন্তু এর বিনিময়ে না তারা সরকারি চাকরি নিয়েছে আর না শহরের কোন টেন্ডার! কিন্তু জামাতের এই ভাইয়েরা লিটনের সাথে সখ্যতার মাধ্যমে চাকরি থেকে শুরু করে রিয়েল স্টেইটের ব্যবসা সবকিছু করেছে। তারপরও ৫ আগষ্টের পর ঢালাওভাবে কওমী আলেমদের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ, মসজিদ থেকে বের করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এরা।
আজ শুক্রবার, রাজশাহী সাহেব বাজার কেন্দ্রীয় মসজিদের ২৬ বছরের ইমামতি করা আলেমকে কোন প্রকার আগাম নোটিশ ছাড়া হুট করে আজ জুমআর আগে নামাজ পড়ানো লাগবে না বলেছে কমিটি কর্তৃপক্ষ। সেখানে নামাজ পড়িয়েছে চতুরতার সাথে ঈদগাহ দখল করা সেই জামাতি আল্লামা। তার ছোট ভাই সহ জামাতের কর্মী সমর্থকরা 'আলহামদুলিল্লাহ ' লিখে পোস্ট করছে যে নিয়োগ হয়েছে। অথচ কেন্দ্রীয় একটা মসজিদের এভাবে নিয়োগ হওয়া সম্ভব না।
আরো বড় কথা হচ্ছে, সাহেব বাজার বড় মসজিদের ইমাম রাজশাহীর সকল আলেমদের মুরুব্বিতুল্য! মুহাদ্দিস মানুষ। থানভী সিলসিলার খলীফাও। তার মত সরল মানুষ উত্তরবঙ্গে দুইটা পাওয়া কঠিন। এমন একজন মানুষকে সরিয়ে জোরপূর্বক ইমামতি দখল করতে এদের দিলে কাঁপে না। এ হচ্ছে এদের মজলুমানা রুপ।
খেয়াল করে দেখেন, আওয়ামী আমলে কওমী হুজুররা কী পরিমাণ জেল জুলুম সহ্য করেছে! শেষদিকে এসে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ আপোস করেছে। কিন্তু অধিকাংশই থেকেছে বিরোধিতার মধ্যে। কিন্তু কোন আলেমকে আপনি দেখেছেন আওয়ামী লীগের দলীয় কোন পদে? দুএকজন মার্কামারা ছাড়া।
অথচ জামাত শিবিরের এই ভাইয়েরা সেসময় আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের দলীয় পদে থেকে সুবিধা ভোগ করেছে, সাধারণ মানুষের নির্যাতনের সাক্ষী হয়েছে, কেউ কেউ নির্যাতনও করেছে ৫ আগষ্টের পরপরই আবার এরা জামাতি হয়ে গেছে! কত নিকৃষ্ট এদের অবস্থা। মানে উভয় যুগেই তারা সুবিধা ভোগ করল। উভয় সময়েই ক্ষমতার কাছাকাছি তারাই। একবার নামে একবার বেনামে!
এ ঘটনাগুলো কি শুধু রাজশাহীর? না শুধু রাজশাহীর না। পুরো দেশেই ঘটছে এমন ঘটনা। মসজিদ থেকে শুরু করে বিশ্বিবদ্যালয় সবজায়গায় তারা লোক ঢুকাচ্ছে যেকোনো মূল্যে। বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য জায়গায় লোক ঢুকানো নিয়ে আমার আপত্তি নাই। উপযুক্ত হলে ঢুকাক। কিন্তু মসজিদ দখল করা নিয়ে আমার অনেক আপত্তি। অধিকাংশ জামাতি মৌলভিরাই ভালো আলেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না। এখন মসজিদ মাদ্রাসা যদি এমন লোক বসতে থাকে যার ইলমি অবস্থান নাই, কিন্তু দলীয় অবস্থান ভালো তাহলে দেশের ইসলামের কী হবে ভেবে দেখেছেন?
এইযে আজ জমিয়তের দাঁড়ি পাকা মুরুব্বিরা জামাতের বিরোধিতা করে বলে আমরা গালাইয়া রাখতেছি না! কিন্তু দেখেন এই মুরুব্বিরা কী বলছে, 'বিএনপি দখল করে টেম্পুস্ট্যান্ড, আর জামাত দখল করে মসজিদ মাদ্রাসা ' তাহলে আমরা দেশ রক্ষার রাজনীতিতে নেমে আগে টেম্পুস্ট্যান্ড বাঁচাবো নাকি আগে মসজিদ মাদ্রাসা বাঁচাবো। দুটোই দরকারি। কিন্তু আমরা আগে মসজিদ মাদ্রাসা বাঁচাতে চাই। এ কথা ওবায়দুল্লাহ ফারুক সাহেব এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
এইযে জামাতের ভাইয়েরা মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহগুলো দখল করছে, এটা কি এ দেশের ইসলামপন্থার জন্য ভালো কিছু? মোটেও ভালো কিছু না। কওমী মাদ্রাসার আলেমরা যদি না থাকত এদেশের অজপাড়াগাঁয়ে মক্তবে কোরআন শেখানোর মানুষ থাকত না। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে প্রান্তিক এলাকাগুলোতে যারা দ্বীনের আলো জ্বালিয়েছে দেখবেন অধিকাংশই কওমী আলেম। আর আজ তাদেরকেই মসজিদ মাদ্রাসা থেকে বের করার ষড়যন্ত্র! ছিহ!
৫ আগষ্টের পর আমরা ভেবেছিলাম, ২০ বছর আগের জামাত আর পরের জামাতের আসমান যমিন পার্থক্য দেখব আমরা। কিন্তু সত্যি আমরা হতাশ হয়েছি। জামাত চাইলে মসজিদ মাদ্রাসাগুলো রাজনীতি না করা কওমী আলেমদের হাতেই রাখতে পারত। কিন্তু তারা তা করবে না। ইসলামি ব্যাংকের যেমন দরকার তেমন তাদের দরকার মসজিদের ইমামতিও। সো যেখানে সুযোগ আছে দখল করতে হবে।
বিএনপি সরকার থাকতে কওমী মাদ্রাসা স্বীকৃতি প্রায় হয়েই গেছিল! কিন্তু জামাতের মুরুব্বিরা এটা করতে দেয়নি। আমার বড় ভাই, মাওলানা হাবিবুর রহমান সাহেব সেদিন বললেন, মতিউর রহমান নিজামি নিজে পত্রিকায় লিখেছে, যারা সরকারের রুলস মানবে না তাদের কীসের স্বীকৃতি! মানে বুঝছেন? কওমী স্বীকৃতি নিতে হলে আমাদের সরকারের গোলামী করে নিতে হবে! এটা কে বলসে? দ্বীনের জ্ঞানসম্পন্ন নিজামি সাহেব। একথা কিন্তু বিএনপির কেউ বলেনি। জামাতের ভাইয়েরা এখনো এটাই মনে করে।
জামাতের টপ টু বটম এ দেশের সাধারণ কওমী পন্থী আলেম সমাজকে অচ্ছুত হিসেবে ভাবতে দেখতে পছন্দ করে। শুধু অচ্ছুত না, তারা ভাবে সাধারণ আলেমরা তাদের জ্ঞানের গভীরতা নাই, দুনিয়ার কিচ্ছু বুঝে না তারা। রাষ্ট্রের কোথাও তাদের স্টেইক থাকার আসলে অধিকারই নাই।
এইযে কয়েকদিন ধরে জামাতের সাথে জোট করা নিয়ে চরমোনাই আর জমিয়তের ক্যাচাল চলছে, আপনার কি মনে হয় ইসলামের স্বার্থে কেউ এই জোট চাচ্ছে? একটা সোজা হিসাব বলি, দেখেন কিছু মিলানো যায় কি না! জামাতের কঠিন দুঃসময়ে মাওলানা মামুনুল হক সাহেব থেকে শুরু করে জমিয়তের মুরুব্বিরা সরাসরি সভা সেমিনারে কয় পার্সেন্ট মওদুদিবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন! আর চরমোনাইয়ের আমির নায়েবে আমির থেকে শুরু করে আবরার ভাইয়েরা কয় পার্সেন্ট করেছে?
এইযে রেজাউল করিম আবরার, এখন মারাত্মক ঐক্যের ঘোষক! আওয়ামী দুঃশাসনের ঘনঘোর টাইমে সব মজলিসে মওদুদিবাদ নিয়ে কথা বলেছে! নায়েবে আমীর সাহেবও একই কাজ করেছেন। কিন্তু দেখেন আজ তারা বুঝাচ্ছে তারা নাকি ইসলামের জন্য জামাতের সাথে ঐক্য করতে যাচ্ছে! কী মজার ঘটনা না! অথচ জামাতের দুর্দিনে যদি তারা এই ইস্যুগুলো নিয়ে চুপ থাকত অন্তত দুইটা মানুষ জামাতকে মানুষ মনে করত। একদিকে আওয়ামী লীগ জামাতকে ৭১ প্রশ্নে না মানুষ প্রমাণ করেছে আরেকদিকে ডিবেইটার আবরার ভাইরা জামাতকে মওদুদিবাদ বলে অধর্মী প্রমাণ করেছে। আর আজ তারা জামাতকে কেন্দ্র করে ঐক্য করবে সেখানে মুরুব্বি আলেমদের যা না তাই বলছে! তাদের একটু লজ্জা শরম ধার দেওয়া উচিত।
যাহোক!
লেখা লম্বা হল। রাজনৈতিক স্বার্থে কেউ যদি জামাতের সাথে জোট করে আমার আপত্তি নাই। আমি এপ্রিশিয়েট করি। যেমনভাবে বিএনপির সাথে জোটকেও এপ্রিশিয়েট করি।কিন্তু ইসলামের কথা বলে এই জোট আসলে মানতে পারি না ভাই। আগামীতে জামাত যে কয়টা আসনে সিট পাবে সে কয়টা আসন সাধারণ আলেমদের জন্য কারাগা হয়ে উঠবে। কিন্তু কনফার্ম বলছি বিএনপি দু চারটা জায়গা ছাড়া এমন ঘটনা ঘটবে না।
কারণ বিএনপি আর যাই করুক মসজিদ মাদ্রাসা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কিছু পাতি নেতা থাকবে যারা খালেদা জিয়ার নাম ধরে দোআ করার জন্য ইমাম সাহেবের সাথে খারাপ আচরণ করবে, কিন্তু সেটাও কুলিয়ে উঠতে পারবে না। অধিকাংশ নেতারাই আলেমদের শ্রদ্ধা করবে। যেখানে জামাতে অধিকাংশ কর্মীরা পর্যন্ত আলেমদের ভাবে খ্যাত, দুনিয়া বিষয়ে অজ্ঞ!
অথচ ৫ আগষ্টের আগে পরে সবসময় এমন ঐক্যের স্বপ্ন দেখতাম। মুরুব্বিদের নিন্দা করতাম। মুরুব্বিদের মনে করতাম সেকেলে, কট্টর। মনে করতাম হিংসুক। কিন্তু সত্যি বলছি আমার এখনকার উপলব্ধি মুরুব্বিদের জন্য শুধু দোআ আর দোআ।
শেষকথা!
জামাতের ভাইদের অনুরোধ করব, যদি আওয়ামী পরিণতি না চান তবে মসজিদ মাদ্রাসার দখলদারিত্ব ছাড়েন। জেনারেলি আপনাদের কাজের অনেক জায়গা। সেখানে কাজ করেন। আপনাদের সততা ব্যাংকে দেখান। ইউনিভার্সিটিতে দেখান। কিন্তু দয়া করে মসজিদ মাদ্রাসায় এসে পণ্ডিতি দেখাতে আসবেন না। এটা বুমেরাং হবে। আজ বা কাল। লিখে রাইখেন।
জাওয়াদ আহমাদ
শ্যামলি, ঢাকা।