05/09/2025
গল্পের নামঃ পরীক্ষার আগে
তেরো এপ্রিল ২ হাজার সাল। আমি তখন ঢাকা কলেজের একজন পরীক্ষার্থী। এইচএসসি পরীক্ষার মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি। চোদ্দ ও পনেরো তারিখ পরপর দুটি রসায়ন ফাইনাল মডেল টেস্ট। অথচ পদার্থ ও গণিতে সময় দিতে গিয়ে রসায়নের যে কী বেহাল অবস্থা, তা একমাত্র আমিই জানি।
দুপুরবেলা বসে পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। হঠাৎ আম্মু এসে বললেন, "ছোটবোন নরীন কাল স্কুলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নাচবে।" তাই নতুন শাড়ি কিনতে হবে। মায়ের অনুরোধে এবং ছোটবোনের কান্নাকাটিতে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেকটা বাধ্য হয়ে শার্ট-প্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়লাম। লক্ষ্য, পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবো। কিন্তু যানজটের কারণে পৌঁছাতেই চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। আম্মু সাইফুলভাইয়ের দোকানে আগেই ফোন করে রেখেছিলেন। চাঁদনি চক মার্কেটে সাইফুলভাইয়ের দোকানে পৌঁছেই এক নিঃশ্বাসে বললাম, "সাইফুলভাই, কেমন আছেন? আম্মু শাড়ি দিতে বলেছেন, তাড়াতাড়ি দেন।"
তিনি বললেন, "আরে, ব্যস্ত হচ্ছো কেন? বসো, ঠাণ্ডা হও, তারপর না হয় শাড়ি নেবে।"
বললাম, "একদম সময় নেই, কাল পরীক্ষা।" শাড়ির প্যাকেট করা হলে গেলে, ঝড়ের মতো কেড়ে নিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে একটা রিকশায় উঠে বসলাম।
"কই যাইবেন, স্যার?"
"মোহাম্মদপুর, আদাবর দুই নাম্বার রোড। তাড়াতাড়ি চল ব্যাটা।"
"পঁচিশ টাকা লাগবো, স্যার।"
"আরে, ডাকাত নাকি! পনেরো টাকার ভাড়া পঁচিশ টাকা চাস?"
রিকশাচালক কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু আমার চোখ ততক্ষণে স্থির হয়ে গেছে শীলাআপুর দিকে।
শীলাআপু আমার এক বছরের সিনিয়র। আমাদের আগের ধানমন্ডির বাসার পাশের বাসাতেই তারা থাকতো। শুনেছি, এ বছর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ-তে ভর্তি হয়েছেন। পরিচয় থাকলেও তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই।
আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটিকে হালকা হলুদ সালোয়ার-কামিজে আজ অনেক সুন্দর লাগছে। কথা বলার সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো মানেই হয় না। জাহান্নামে যাক রসায়ন মডেল টেস্ট!
"আরে, শীলাআপু, এখানে কী করছেন?"
"সজীব যে! কী খবর? তোমার না কয়েকদিন পরে পরীক্ষা? এই এলাকা কি ছাড়তে ইচ্ছা করে না?"
"আপনার দেখা পাওয়ার সৌভাগ্যই হয়তো এখানে নিয়ে এসেছে।"
"অ্যাঁই, দুষ্টুমি হচ্ছে! আচ্ছা, দেখো তো কী যন্ত্রণায় পড়লাম! কাল রমনা বটমূলের এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। তিন বান্ধবী একই রকম শাড়ি কিনবো। আমি এসেছি প্রায় আধা ঘণ্টা হলো, অথচ..."
"শীলাআপু, আপনি ভালো আছেন? শরীর-মন ভালো তো?"
"হ্যাঁ, ভালো।" তারপর মুচকি হেসে বললেন, "ঘরে বসে থেকে তোমার স্বাস্থ্য তো খুব ভালো বানিয়েছো।"
"আমার কী দোষ? আপনিও তো..."
হঠাৎ শীলাআপুর মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।
"আরে শান্ত, তুই কোথায়?..." কথোপকথন চললো।
শীলাআপু ফোন অফ করলে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনি শাড়ি কিনবেন না?"
"ধেৎ! তারা নাকি শাড়ি কিনে ফেলেছে। এখন একা...। আচ্ছা চলো, তোমাকে নিয়ে... না, সরি, তোমার তো আবার পরীক্ষা।"
তড়িঘড়ি করে বললাম, "আরে না না, পরীক্ষা কোনো সমস্যাই না। বেশি পড়ে মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। আজ রেস্ট।"
"তাই নাকি?"
"আচ্ছা শীলাআপু, দেখেন তো এ শাড়িটা কেমন? পছন্দ হলে নিতে পারেন।"
"ওয়াও! খুব সুন্দর তো শাড়িটা। খুলতে হবে না, আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এটা কার?"
"এটা আপনাকেই মানাবে। তাই এটা আপনার।"
শাড়িটির দাম দিতে চাইলে আমি বললাম, "না, না, মাথা খারাপ! সামান্য একটা শাড়ি, টাকা নেবো কেন? ছিঃ! ছিঃ!"
তিনি বেশি জোর করলেন না। বললেন, "তাহলে চলো।"
"কোথায়?"
"আমাদের বাসায়।"
"কেন?"
"ওমা! তুমি আমাকে শাড়ি কিনে দিলে, তোমাকে কিছু খাওয়াবো না?"
বাসায় নেয়ার আগ্রহটা একটু বেশিই মনে হলো, কারণ এখানেও তো অনেক খাবার দোকান আছে।
ততক্ষণে শীলাআপুর হ্যাঁচকা টানে ধপ করে গাড়িতে উঠে বসলাম তার পাশে এবং লোভাতুর দৃষ্টিতে খুব কাছ থেকে তার শরীরের সৌন্দর্য দেখলাম। এক ফাঁকে তাকে বললাম, "এই শাড়িটিতে আপনাকে কেমন লাগবে, তা দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।"
তিনি শুধু মুচكي হাসলেন।
বিশাল বাড়ির ড্রয়িংরুমে আমাকে বসিয়ে রেখে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। বাসায় তেমন কেউ নেই মনে হচ্ছে। মিনিট দশেক পর হঠাৎ শুনলাম, "সজীব, শাড়িটি মনে হয় বাচ্চাদের।"
কথাগুলো অস্পষ্ট মনে হলো। কিন্তু আমাকে শীলাআপু কি ডাকছেন? হৃৎকম্পনের মাত্রা বেড়ে গেল।
বুঝলাম, শীলাআপুর বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমার ঠিক সামনে, মাথায় হলুদ তোয়ালে প্যাঁচানো, মাত্র গোসল সেরে ওঠা শীলাআপু যেন তরতাজা একটি গাঁদা ফুল। তার দুই চোখ যেন আমাকে আরও কাছে ডাকছে। ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। পিষে ফেললাম তাকে আমার বিশাল বুকে। ঠোঁটে ঠোঁট রাখতেই কোনো বাধা না পেয়ে আমার হাত দুটো যেন সাহসী হয়ে উঠলো। সরিয়ে ফেললাম প্রায় সব আবরণ তার শরীর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে শীলাআপু বাদ সাধলেন। প্রায় জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, "প্লিজ, প্লিজ, আজ নয়। তোমার পরীক্ষা শেষ হোক।" আমি যেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিলাম। মনে হলো, পরীক্ষার নাক বরাবর একটা ঘুষি মারি।
গাঢ় নীল রঙের ম্যাক্সিতে নিজেকে ঢেকে নিয়ে শীলাআপু বললেন, "পরীক্ষার পর এসো, তোমাকে নিরাশ করবো না।"
ব্যথিত আমি ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু চেয়ে রইলাম।
নীল পোশাকে অপরূপা শীলাআপুর সান্নিধ্য এক ঘণ্টা কাটানোর পর বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো।
সঙ্গে রইলো সেই শাড়িটি, আর চিন্তা-চেতনায় থাকলো পরীক্ষার পরের সম্ভাব্য সুখ।
সেদিন রাতে হলো না লেখাপড়া, হলো না ঘুম। শুধু মনে হলো, টাইম মেশিনে করে চলে যাই এক মাস পরের সময়টাতে। শীলাআপুকে দিয়েছিলাম ছোট একটি শাড়ি, একথা ভেবে হাসিও পাচ্ছিল। কিন্তু শীলাআপুদের বাসায় আর যাওয়া হয়নি। কারণ, এক মাস পর শীলাআপুদের সিলেটি পরিবার লন্ডনে শিফট হয়ে যায় এবং আমার পরীক্ষাও খুব খারাপ হয়। ছোটবোনের সেই শাড়িটিকে দেখলে এখনো সেই দিনটির কথা মনে পড়ে। রাগ হয় পরীক্ষা খারাপের জন্য, আফসোস হয় শীলাআপুর জন্য।