01/01/2025
আব্দুল কাদের, বাংলাদেশের অভিনয় জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ১৯৫১ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুল জলিল এবং মা আনোয়ারা খাতুন। শৈশব-কৈশোর কেটেছে সোনারং হাইস্কুল ও বন্দর হাইস্কুলে। পরবর্তী সময়ে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
পড়াশোনার পর তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। সিংগাইর ডিগ্রি কলেজ এবং লোহাজং কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করেন এবং শেষমেশ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ‘বাটা’তে উচ্চপদস্থ পদে যোগ দেন। তবে পেশাগত জীবনের সাফল্যের পাশাপাশি তাঁর হৃদয়ের গভীরে অভিনয়ের প্রতি ছিল অদম্য ভালোবাসা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি মঞ্চে প্রথম পা রাখেন। এরপর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় সেলিম আল দীন রচিত ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ নির্দেশিত ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ নাটকে সেরা অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেন। মঞ্চের এই সাফল্য তাঁকে টেলিভিশন এবং রেডিওর পথ দেখায়। ১৯৮২ সালে তিনি টেলিভিশন নাটকে এবং ১৯৮৩ সালে রেডিও নাটকে অভিনয় শুরু করেন।
টেলিভিশনে তিনি প্রায় দুই হাজারের বেশি নাটকে অভিনয় করলেও তাঁকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয় হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর ‘বদি’ চরিত্রের জন্য। এছাড়াও ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে তাঁর ‘মামা’ চরিত্র তাঁকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে যায়। তাঁর অভিনয়ের সহজাত দক্ষতা এবং চরিত্রকে জীবন্ত করে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে জনমানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে দিয়েছে।এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু টেলিভিশন নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মাটির কোলে’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘শীর্ষবিন্দু’, ‘সবুজ সাথী’, ‘তিন টেক্কা’, ‘যুবরাজ’, ‘আগুন লাগা সন্ধ্যা’, ‘প্যাকেজ সংবাদ’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘কুসুম কুসুম ভালোবাসা’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘আমাদের ছোট নদী’, ‘দুলাভাই’, ‘অজ্ঞান পার্টি’, ‘মোবারকের ঈদ’, ‘বহুরূপী’, ‘এই মেকআপ’, ‘ঢুলিবাড়ি’, ‘সাত গোয়েন্দা’, ‘এক জনমে’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘খান বাহাদুরের তিন ছেলে’ ইত্যাদি।
অভিনয় জীবনে তিনি প্রায় ৩০টি মঞ্চ নাটকে এবং ১,০০০-এর বেশি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘স্পর্ধা’, ‘দুই বোন’,‘মেরাজ ফকিরের মা’। ১৯৮২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে বাংলাদেশের নাটক থিয়েটারের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এ অভিনয় করেন। টেলিভিশনে তাঁর অভিনীত নাটকের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। বিজ্ঞাপনচিত্রেও তিনি নিজের দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি টেনাশিনাস পুরস্কার, মহানগরী সংস্কৃতি গোষ্ঠী পুরস্কার, জাদুকর পিসি সরকার পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা অর্জন করেন।
২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর, সকাল ৮টা ২০ মিনিটে, ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াই শেষে আব্দুল কাদের চিরবিদায় নেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা নাট্যাঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। তাঁর অসাধারণ কাজ এবং অবদান আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। "বাংলার প্রাঙ্গণ" তাঁর স্মৃতির প্রতি জানায় বিনম্র শ্রদ্ধা।