20/09/2025
গল্প : ৬
🌲 শালবনের আতঙ্ক (প্রথম পর্ব) 🌲
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈলের পশ্চিম প্রান্তে বিশাল এক শালবন ছড়িয়ে আছে। দিনের আলোতে এই বনের ভেতর দিয়ে গেলে মনে হয়, যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি। বাতাসে শালপাতার দুলুনি, পাখির ডাক, গাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো— সব মিলিয়ে শান্ত এক পরিবেশ। কিন্তু সূর্য নামলেই এ বন অন্য রূপ নেয়। অন্ধকারের ভেতর প্রতিটি গাছ যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে, প্রতিটি ছায়া যেন কারও দিকে তাকিয়ে থাকে।
গ্রামের প্রবীণরা বলে আসছে— এই বনের নিচেই চাপা আছে বহু অশান্ত আত্মা। অনেক আগে এক ভয়ংকর মহামারিতে গ্রামের শত শত মানুষ মারা যায়। তখন একসাথে তাদের কবর দেওয়া হয়েছিল এই বনে। সেই কবরগুলোর ওপরই আজকের এই ঘন শালবন। তাই নাকি এখানে আত্মারা শান্তি পায়নি, আর মাঝরাতে তারা বের হয়।
বছরের পর বছর ধরে এই বন নিয়ে ভয়ংকর সব গল্প ছড়িয়ে আছে। অনেকে বলে, রাত নামলেই শোনা যায় মেয়েদের কান্না। আবার কেউ বলে, গাছের ডালে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে লম্বা চুলওয়ালা এক নারী, যার চোখ লাল হয়ে জ্বলজ্বল করে। কেউ আবার দাবি করেছে, গভীর রাতে ভেসে আসে শঙ্খ বাজানোর মতো অদ্ভুত শব্দ, অথচ চারপাশে কোনো মানুষই থাকে না।
গ্রামের তরুণরা এসব কথা বিশ্বাস করত না। বিশেষ করে রফিক নামের এক যুবক। বয়স আনুমানিক তেইশ। দুঃসাহসী, জেদি, আর সবকিছুকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া তার স্বভাব। রফিক সবসময় বলত— “ভূত-টুত বলে কিছু নাই। সব গাঁয়ের বুড়োদের বানানো গল্প।”
এক সন্ধ্যায় রফিক কয়েকজন বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছিল চায়ের দোকানে। আলোচনা উঠল শালবনের ভয়ংকর কাহিনি নিয়ে। বন্ধুরা গল্প জমিয়ে বলছিল— কে কোথায় কী শুনেছে, কারা বনে গিয়ে কী দেখেছে। রফিক হেসে উঠে বলল— “সব বাজে কথা। আজকে চাইলে প্রমাণ করে আনতে পারি।”
বন্ধুরা প্রথমে ভেবেছিল মজা করছে। কিন্তু রফিক জেদ ধরে বলল— “আজ রাতেই যাব শালবনে। একা গিয়ে রাত কাটিয়ে আসব। কালকে তোমরা সবাই দেখবা, কিছুই নাই।”
বন্ধুরা তখন উসকানি দিতে লাগল— “দেখি কত বড় সাহস! যদি সত্যিই যাস, তবে তোর নাম হবে গ্রামের বীর। না গেলে কাপুরুষ।”
রফিক চ্যালেঞ্জটা নিল। রাতে একা শালবনে যাওয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু সে গায়ের জোরে, আত্মবিশ্বাসে, আর অহংকারে ভর করে সিদ্ধান্ত নিল।
সেদিন রাত আনুমানিক এগারোটার দিকে রফিক বাড়ি থেকে বের হলো। হাতে একটা টর্চ, কোমরে দা, আর মনে অজানা সাহস। আকাশে আধো চাঁদ, চারপাশে অন্ধকারে ঢাকা গ্রাম। বাতাসে শীতলতা, আর কুকুরের হাউমাউ ডাক চারপাশকে আরও ভৌতিক করে তুলছিল।
বনের ধারে পৌঁছাতেই তার সামনে দাঁড়িয়ে গেল এক বৃদ্ধা। গ্রামে সবাই তাকে “দাদি আম্মা” বলে ডাকে। তিনি কাঁপা গলায় বললেন— “বাবা, ওদিকে যাস না। অনেককে আমরা হারাইছি ওই বনে। যারা ঢুকছে, তারা আর আগের মতো ফিরতে পারে নাই।”
রফিক হাসতে হাসতে বলল— “সব কুসংস্কার দাদি। কিছুই হবে না।”
বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে গেলেন। রফিক ঢুকে পড়ল শালবনের অন্ধকারে।
প্রথমেই সে টের পেল, বনের ভেতরটা যেন আলাদা এক দুনিয়া। বাইরে গ্রামে যতই চাঁদের আলো থাকুক, ভেতরে সব গ্রাস করেছে অন্ধকার। টর্চের আলো সামনের কয়েক হাত পথই শুধু আলোকিত করছে, বাকিটা গা ছমছমে অন্ধকার।
হঠাৎ একটা সোঁ সোঁ শব্দ কানে এল। বাতাসের ঝাপটা, নাকি কারও ফিসফিসানি— রফিক বুঝতে পারল না। সে থামল, কান পেতে শুনল। তখনই শুনতে পেল— যেন কোনো নারী কাঁদছে।
“আমারে বাঁচাও… আমারে বাঁচাও…”
রফিক কেঁপে উঠল। মনে মনে নিজেকে শক্ত করল— “না, না, এসব আমার মনের ভুল।”
কয়েক কদম এগোতেই টর্চের আলো এক গাছের নিচে গিয়ে পড়ল। আর তখনই সে জমে গেল।
সেখানে বসে আছে এক সাদা পোশাক পরা নারী। মাথা নিচু, লম্বা চুল মাটিতে লুটিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সে মাথা তুলল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে লাল আলোয়। ঠোঁটের কোণে রক্তের রেখা।
রফিকের বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু টের পেল— পিছনের পথটা অদৃশ্য হয়ে গেছে! চারদিকে শুধু গাছ, অন্ধকার আর অদ্ভুত ফিসফিসানি।
নারীটি আস্তে আস্তে মাটি থেকে উঠে ভেসে যেতে লাগল। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল— “তুই কেন এসেছিস? এটা আমাদের রাজ্য। এখন তুই আর ফিরতে পারবি না।”
রফিকের গা থেকে ঘাম ঝরতে লাগল। টর্চ হঠাৎ নিভে গেল। চারদিক আরও অন্ধকার হয়ে গেল। শুধু সেই নারীর চোখ দুটো জ্বলছে লাল অগ্নিশিখার মতো।
ঠিক তখনই চারপাশে ভেসে এল অসংখ্য ফিসফিসানি। মনে হলো শত শত মানুষ তাকে ঘিরে আছে। কানে ভেসে আসছে— “থেকে যা… থেকে যা… আর ফেরার পথ নেই…”
রফিক হঠাৎ ঠান্ডা এক হাত নিজের কাঁধে অনুভব করল। সে কেঁপে উঠে পিছনে তাকাল। কিছুই নেই। আবার সামনে তাকাতেই দেখল— নারীটি একদম তার চোখের সামনে।
নারীটি ফিসফিস করে বলল— “আজ থেকে তুই আমাদের সাথেই থাকবি…”
রফিক গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল। তার শব্দ মিলিয়ে গেল বনের অন্ধকারে…
👉 চলবে…
পরবর্তী পর্বে জানা যাবে— রফিক কি বাঁচতে পারবে, নাকি চিরতরে আটকে যাবে শালবনের অভিশপ্ত আত্মাদের মাঝে?
📌 চোখ রাখুন 👉 Bhoot FM.Com-ভুতএফএম.কম
#ভৌতিকগল্প #শালবনেরআতঙ্ক #ঠাকুরগাঁও