
12/06/2025
মহিমান্বিত গাদিরে খুম দিবস পবিত্র ১৮ই জিলহজ্জঃ
ঐতিহাসিক 'গদীর-ই-খুম'-এর ঘটনাঃ
===========================
ঐতিহাসিক বিদায় হজ্ব সমাপন করে আমাদের আক্কা ও মাওলা হুযুর আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা তৈয়্যবায় পুনরায় তাশরীফ নিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে 'গদীর-ই-খুম' নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করেন।এখানে হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা কেরামের উদ্দেশ্যে যেসব ঐতিহাসিক বরকতময় নসীহত করেছিলেন তন্মধ্যে আহলে বায়আত, বিশেষ করে, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আন্হু সম্পর্কে কৃত বিশেষ নসীহত ছিলো অন্যতম।
আঁকা-হযরত সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন পথিমধ্যে 'গদীর-ই-খুমম' নামক স্থানে এসে যাত্রাবিরতি করলেন।এটা মক্কা ও মদীনা শরীফের মধ্যভাগে জোহফার আশেপাশেই অবস্থিত।এখান থেকে তিন মাইল দূরে ঐ 'গদীর' অবস্থিত।
এখানে এসে হুযুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা কেরামের দিকে মনোনিবেশ করলেন।আর এরশাদ ফরমালেন-
الَسْتُمْ تَعْلَمُونَ أَنِّي أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ؟
(তোমরা কি জাননা যে, আমি মুসলমানদের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক নিকটে?) অন্য এক বর্ণনানুসারে, হুযুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু'র হাত উপরের দিকে তুলে ধরে একথাটি তিন বার বলেছিলেন।
তদুত্তরে, সবাই বললেন- "হা, নিশ্চয়ই আপনি সমস্ত মুসলমানের নিকট তাদের প্রাণ অপেক্ষাও নিকটে ও প্রিয়।"
অতঃপর এরশাদ ফরমালেন, "আমি তোমাদের মধ্যে দু'টি জিনিস রেখে যাচ্ছি- তন্মধ্যে একটা অপরটা অপেক্ষা মহান। সে দু'টি হচ্ছে- ১) কোরআন করীম এবং ২) আমার আহলে বায়আত (পরিবার-পরিজন)। আমার পর ঐ দু'টি সম্পর্কে এ মর্মে সতর্ক থাকবে যে, সে দু'টির সাথে কিরূপ আচরণ করছো? সে দু'টির প্রতি তোমাদের কর্তব্য কিভাবে পালন করছো? আমি চলে যাবার পর এ দু'টির একটা অপরটা থেকে পৃথক হবে না।শেষ পর্যন্ত তোমরা 'হাওয-ই-কাওসার'-এর কিনারায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে।"
অতঃপর এরশাদ ফরমালেন, "আল্লাহ তা'আলা আমার 'মাওলা' (مولى) আর আমি হলাম সমস্ত মুসলমানের মাওলা (مولى)।
اللَّهُمَّ مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيُّ مَوْلَاهُ.
হে আল্লাহ! আমি যার 'মাওলা' আলীও তার 'মাওলা'।
اللَّهُمَّ وَآلِ مَنْ وَالاهُ.
হে আল্লাহ্! তুমিও তাকেই ভালোবাসো, যে আলীকে ভালোবাসে।
وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ
(এবং তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করো, যে তার সাথে শত্রুতা পোষণ করে।) অন্য বর্ণনায় এটাও এরশাদ হয়েছে-
وانصر من نصرَهُ وَاخْذُلْ مَنْ خَذَلَهُ
[হে আল্লাহ! তাকে সাহায্য করো, যে তাঁকে (আলীকে) সাহায্য করে। আর তাকে অপমানিত করো, যে আলীকে ছেড়ে দেয়। আর যেদিকে আলী মনোনিবেশ করে, সত্যকেও সেদিকে নিশ্চিত করো।"
এ ঘটনার পর সাহাবা কেরামের মধ্যে হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুর সাথে সাক্ষাৎ হলে, তাঁকে মুবারকবাদ দিয়ে বললেন-
هَنِيئًا يَا ابْنَ أَبِي طَالِبٍ أَصْبَحْتَ وَأَمْسَيْتَ مَولَى كُلِّ مؤمن ومؤمنة
#অর্থাৎঃ "আবূ তালিব-তনয়কে ধন্যবাদ।আপনার সকাল ও সন্ধ্যাতো এমতাবস্থায় হচ্ছে যে, আপনি প্রত্যেক মু'মিন নরনারীর 'মাওলা'।"
এ হাদীসখানা ইমাম আহমদ হযরত বারা ইবনে আযিব এবং হযরত যায়দ ইবনে আরকাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন; যেমন- মিশকাত শরীফে
উল্লেখ করা হয়েছে।
এ হাদীস শরীফ হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর চূড়ান্ত কারামত ও ফযীলতকে প্রকাশ করে। এটা দ্বারা হুযুর সাল্লাল্লাহু তা'আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনুনুর সাথে ভালোবাসা রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। পক্ষান্তরে, তাঁর প্রতি শত্রুতা পোষণ থেকে বিরত থাকার শিক্ষাই তাতে দেয়া হয়েছে। যেমন অন্য একটা বর্ণনায় এসেছে, "হযরত আলীর সাথে শুধু ঐ ব্যক্তিই ভালোবাসা রাখবে যে মু'মিন হবে। আর তাঁর প্রতি শত্রুতা সে-ই পোষণ করতে পারে, যে মুনাফিক্ব। তাছাড়া, হাদীসের ঐ প্রেক্ষাপটও একথাই সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করে। এটাই হচ্ছে আহলে সুন্নাতের সর্বসম্মত অভিমত।
মান কুন্তু মওলাহু, ফাহাজা আলিউন মওলাহু।
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
দশম হিজরীতে বিদায় হজ্ব সমাপনান্তে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাহবিহী ওয়া বারাকা ওয়াসাল্লামা) মদীনা অভিমুখে রওনা হলেন। তাঁর সাথে ছিলেন মদীনা ও সিরিয়ার কাফেলা। কাফেলা জুহ্ফার তিন মাইলের মধ্যে অবস্থিত ‘রাবুঘ’ নামক স্থানে পৌঁছলে হযরত জিবরীল আমীন (আ.) প্রিয় নবী (দরুদ)’র কাছে নিম্নোক্ত আয়াত নিয়ে আসলেন অর্থাৎ “আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার করুন; আর যদি আপনি তা না করেন, তা হলে আপনি তাঁর রিসালতই (যেন) প্রচার করেননি এবং মহান আল্লাহ্ আপনাকে জনগণের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন।” (সূরা মায়িদাহ্ : ৬৭)
এ আয়াতের বাচনভঙ্গি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ্ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রিয়নবী (দরুদ)’র যিম্মায় অর্পণ করেছেন। এই আয়াত নাযিলের পর প্রিয় নবী (দরুদ) কাফেলার যাত্রা বিরতির নির্দেশ প্রদান করলেন।যাঁরা কাফেলার সম্মুখভাগে ছিলেন, তাঁদের থামানো হলো এবং যাঁরা কাফেলার পেছনে ছিলেন, তাঁরা এসে তাঁদের সাথে মিলিত হলেন। সেদিন দুপূর বেলা তীব্র গরম পড়েছিল। জনতা তাদের বহিরাবরণের একটি অংশ মাথার ওপর এবং আরেকটি অংশ পায়ের নিচে রেখেছিল। যে চাদর গাছের ওপর ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিল, তা দিয়ে প্রিয়নবী (দরুদ)-এর জন্য একটি শামিয়ানা তৈরি করা হলো। মহানবী জামাআতে জোহরের নামায আদায় করলেন। এরপর সাহাবায়ে কিরাম (রিদ্বওয়ানিল্লাহি আলাইহিম আজমাঈন) তাঁর চারপাশে সমবেত হলে তিনি একটি উঁচু জায়গার ওপর গিয়ে দাঁড়ালেন যা উটের হাওদা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এর পর প্রিয়নবী (দরুদ) বলিষ্ঠ কণ্ঠে লক্ষাধিক সাহাবীর মজমায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন।
“মহান আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। তাঁর কাছে আমরা সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করি এবং আমাদের যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে তাঁর কাছে আমরা আশ্রয় নিচ্ছি। তাঁর ওপর ভরসা করি। তিনি ছাড়া আর কোন পথপ্রদর্শক নেই। তিনি যাকে হিদায়াত করেন, তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও প্রেরিত পুরুষ (রাসূল)।
হে লোক সকল! অতি শীঘ্রই আমি মহান আল্লাহর আহবানে সাড়া দেব এবং তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব। আমিও দায়িত্বশীল, তোমরাও দায়িত্বশীল। তোমরা আমার ব্যাপারে কী চিন্তা কর? এ সময় উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম (রা.) সত্যায়ন করে সাড়া দিলেন এবং বললেন : “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি রিসালাতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন এবং আমানত আদায় করেছেন। মহান আল্লাহ্ আপনাকে পুরস্কৃত করুন।”
প্রিয় নবী (দরুদ) বললেন : “তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে যে, বিশ্ব-জগতের মাবুদ এক-অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মদ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল; পরকালে বেহেশত, দোযখ এবং চিরস্থায়ী জীবনের ব্যাপারে কোন দ্বিধা ও সন্দেহ নেই?” তখন সবাই বললেন : “এসব সত্য এবং আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।”
অতঃপর তিনি বললেন : “হে লোকসকল! আমি দু’টি মূল্যবান জিনিস তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি। আমি দেখবো- তোমরা আমার রেখে যাওয়া এ দু’টি স্মৃতিচিহ্নের সাথে কেমন আচরণ করছ?” ঐ সময় একজন দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন : “এ দুই মূল্যবান জিনিস কী?” প্রিয়নবী (দরুদ) বললেন : “একটি মহান আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কুরআন), যার এক প্রান্ত মহান আল্লাহর হাতে এবং অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে আছে এবং অপরটি আমার বংশধর (আহলে বাইত) [কোন কোন বর্ণনায় এসেছে এই দু’টি বিষয়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য তিনি ৩ বার করে বললেন]। মহান আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন, এ দুই স্মৃতিচিহ্ন কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।
হে লোকসকল! পবিত্র কোরআন ও আমার বংশধর থেকে অগ্রগামী হয়ো না এবং কার্যতঃ এতদুভয়ের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করো না; এর অন্যথা করলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
এ সময় প্রিয়নবী (দরুদ) হযরত আলী (আ. ও রা.)-এর হাত ধরে এতটা উঁচু করলেন যে, তাঁদের উভয়ের বগলদেশ জনতার সামনে স্পষ্ট দেখা গেল এবং তিনি আলী (আ. ও রা.)কে উপস্থিত জনতার কাছে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর তিনি বললেন- “মুমিনদের চেয়ে তাদের নিজেদের ওপর কে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত?” তখন সবাই বললেন : “মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন।” প্রিয়নবী তখন বললেন : “মহান আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা; আর আমি তাদের নিজেদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এবং সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন। সুতরাং হে লোকসকল! “আমি যার মাওলা, এই আলীও তার মাওলা।” হে আল্লাহ! যে তাঁকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তাকেও তুমি বন্ধুরূপে গ্রহণ করো। যে তাঁর সাথে শত্রুতা করবে, তুমিও তার সাথে শত্রুতা করো। যে তাঁকে ভালোবাসবে, তাকে তুমিও ভালোবাস। যে তাকে ঘৃণা বা অপদস্থ করবে, তাকে তুমিও ঘৃণা ও অপদস্থ করো। যে তাঁকে সাহায্য করবে, তাকে তুমিও সাহায্য করো এবং যে তাঁকে সাহায্য থেকে বিরত থাকবে, তাকে তুমিও সাহায্য থেকে বিরত থাকো এবং সে যেদিকে ঘোরে, সত্যকেও তার সাথে সেদিকে ঘুরিয়ে দাও।”
এটিই সংক্ষিপ্তাকারে ঐতিহাসিক গাদীরে খুমের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ। যা শব্দ ও বাক্যের তারতম্য সহকারে প্রিয় রাসূলের (দরুদ) ১১০ জন সাহাবী কর্তৃক অসংখ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের কাছে মওলা আলী (আ. ও রা.) গুরুত্ব ও ফজীলত কতটুকু! সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী!
"ক্বুল লা আসআলুকুম আলাইহি আজরান ইল্লাল মাওয়াদ্দাতা ফিল ক্বোরবা"
#অর্থঃ" হে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম! বলুন, আমি আমার রেসালতের পারিশ্রমিক তোমাদের কাছে কিছুই চাইনা,শুধু আমার আহলে বায়াতের মহব্বত ব্যতিত।"
১৮ই জিলহজ্জ বিদায় হজ্জের দিনে,গাদিরে খুম নামক স্থানে সোয়া লক্ষ হাজীদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে রাসূল পাক (সাঃ) বলেছিলেনঃ
★“আমি (রাসূল) যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।হে খোদা যে আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে তুমিও তার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখ,যে আলীর সাথে শত্রুতা রাখে তুমিও তার সাথে শত্রুতা রাখ।”
#সূত্রঃ সহি মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ-৩৬২, মুসনাদে ইমাম হাম্বল, ৪র্থ খণ্ড, পৃ-২৮১)
★“আমি(রাসূল) যার বন্ধু আলী ও তাঁর বন্ধু ।”
#সূত্রঃ তিরমিযি, ইফাবা, ৬ঃ৩৭১৩।
★“হে আল্লাহ! আলী যে দিকে ঘুরবে হক ও সত্যকেও তুমি সে দিকে ঘুরিয়ে দিও।”
#সূত্রঃ তিরমিযি, ইফাবা, ৬ঃ৩৭১৪।
★“হে আলী! তুমি আমার এবং আমি তোমার জন্য।”
#সূত্রঃ তিরমিযি, ইফাবা, ৬ঃ৩৭১৬
★“আলী "আমার" আমি "আলীর"।আমার পক্ষ থেকে আমি আর আলী ছাড়া আর কেউ আমার "দায়িত্ব" পালন করতে পারে না।"