21/11/2024
কবি Abdul Kadir Hawlader (রহ.)-কে যেমন দেখেছি।
এলান গানের শুটিং চলছে। প্রথম দিন বৃষ্টির কারণে শুটিং অনেকটাই ভেস্তে গেল। কেবল শুরুর নাট্যাংশের ফুটেজগুলোই নেওয়া গেল; বাকিগুলো মানহীন।
শুটিং দ্বিতীয় দিনে গড়াল। নারায়নগঞ্জের আড়াই হাজার এলাকার এক গোরস্থানে শুটিং করা হলো।
রাতে শ্রদ্ধেয় Gazi Anas Rawshan ভাই জানালেন-দুর্ভাগ্যবশত দ্বিতীয় দিনের সমস্ত ফুটেজ ডিলিট হয়ে গেছে। রি-স্টর করার কোনো প্রচেষ্টাই কাজে আসেনি। অগত্যা তৃতীয় দিনে গড়াল শুটিং।
প্রতিদিনই আমি আব্দুল কাদের ভাইয়ের সাথে বাসে শুটিং স্পটে যেতাম। নারায়নগঞ্জের ছাপড়ি হোটেলে বসে বড়ো বড়ো পরোটা-ডিম দিয়ে সকালের নাশতা করতাম। ভালোই লাগত।
প্রথমে আব্দুল কাদের ভাইকে খুব সাধারণ মানুষ হিসেবেই গণ্য করতাম। কিন্তু এই কয়েকদিন দীর্ঘক্ষণ তার সাথে সময় কাটানোয় তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। খুবই সাদাসিধে চিন্তা; কিন্তু এগুলোর প্রভাব এত গভীর, ভাবতেই অবাক হচ্ছিলাম।
শুটিংয়ের আগে একটি মাদরাসায় সকালের নাশতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । আনাস ভাই অনেকটাই চিন্তিত। একে একে দুইদিনের শুটিং ভেস্তে গেছে। তার উপর আমাদের সম্মানিতা ভাবি গত রাতে হঠাৎ ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছেন। ভীষণ জ্বর। তিনি বললেন-‘আমার মনে হচ্ছে আল্লাহ এই গানটায় আমাদের ওপর খুশি না। তাই একটার একটা বিপদ আসছে।’
আমি বিনয়ের সাথে বললাম-‘ভাই, এমনটাও তো হতে পারে যে আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। বিপদ সত্ত্বেও আমরা তাঁর সিদ্ধান্তে কতটা ধৈর্য ধারণ করতে পারি, তার পরীক্ষা নিচ্ছেন।’
মুখে আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করে ‘হতে পারে।’ বললেন আনাস ভাই।
কী দেখে ভাবি ভয় পেয়েছেন, জানতে চাইলাম। আনাস ভাই জানালেন-আমাদের চলমান গানটার শুরুর নাট্যাংশটি দেখেই তিনি ভয় পেয়েছেন এবং এতে ভীষণ জ্বর এসেছে গায়ে (প্রথম দিনের শুটিং-এর ফুটেজগুলো নিয়ে গানের কিছু অংশ ইতোমধ্যেই এডিট হয়েছিল)।
আমি বেশ অবাক হলাম। হাওলাদার ভাই বললেন-‘কী বলেন! কী এমন ভিডিও, যা দেখে ভয় পায়! আমাকে একটু দেখান তো!’
আনাস ভাই মোবাইলে ভিডিও বের করে তাঁকে দিলেন। আমরা নাশতায় ব্যস্ত হলাম। অত্র মাদরাসার হুজুর তার সংগ্রহের খাঁটি মধু আমাদের তোহফা দিলেন। আমরা তা চেকে দেখছিলাম।
হঠাৎ কান্নার আওয়াজে আমরা হতভম্ব হলাম। পেছন ফিরে দেখলাম আব্দুল কাদের হাওলাদার ভাই হু হু করে কাঁদছেন। মুখ চেপে ধরে কাঁদছেন! ভীষণ ভয় পেলাম। ভাবলাম-তাঁর বাড়ি থেকে কারো মৃত্যুর খবর এলো কিনা। আমরা দৌড়ে গেলাম তাঁর কাছে। আনাস ভাই শান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেউ-ই বুঝতে পারছিলাম না হঠাৎ কী এমন ঘটল!
হাওয়ালাদার ভাই ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকলেন! প্রায় দুই মিনিট কেটে গেল! এরপর একটু স্বাভাবিক হলেন। জিজ্ঞেস করলাম-‘ভাই কী হয়েছে! বাড়ি থেকে কোনো দুঃসংবাদ এসেছে নাকি?’
তিনি আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলতে থাকলেন-‘আমিও তো এভাবে মারা যেতে পারি! আমিও তো এভাবে মারা যেতে পারি! আমারও তো এভাবে এলান হবে একদিন!’
বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমাদের। একে অপরের চোখের দিকে তাকালাম। সকলের চোখেই বিস্ময়! মৃত্যুকে স্মরণ করে কেউ এভাবে কান্না করতে পারে, আমাদের যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
নিজ চোখে না দেখলে আমিও হয়ত বিশ্বাস করতে পারতাম না। কিন্তু আব্দুল কাদের হাওলাদার ভাই ছিলেন এমনই। সদা মৃত্যুর স্বরণে আচ্ছন্ন থাকতেন তিনি। এজন্যই তাঁর কলম থেকে এসেছে-‘কত জানাজার পড়েছি নামাজ, দিয়েছি কত দাফন!’, ‘একদিন তোমারই নাম, মসজিদে হবে এলান!-এর মতো হৃদয় ছোঁয়া সব পঙ্ক্তি’।
আব্দুল কাদের হাওলাদার ভাই যার সাথেই কথা বলতেন, মনে হত যেন তিনি তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন! তার সন্তানের বয়সী হলেও তিনি আমাদের ‘আপনি’ ও ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। মাঝে মধ্যেই কল দিয়ে খোঁজখবর নিতেন। ইসলামি সংস্কৃতি নিয়ে তার নানা পরিকল্পনার কথা জানাতেন।
এলান গানের পরেও আমার আরও দুটি শর্টফিল্মে তিনি অভিনয় করেছেন ,(যদিও তিনি অভিনেতা নন)। শুটিং-এর আগে তিনি বার বার ফোন দিয়ে বলতেন-‘হাসিব ভাই, দেখেন তো ডায়লোগটা ঠিক আছে কিনা!’ প্রচুর রিহার্সেল করতেন।
যৌবনে তিনি রঙ তুলিতে ছবি আঁকতেন। বড়ো বড়ো বিল বোর্ডে সিনেমার পোস্টার আঁকতেন। একটা সময় দ্বীনের দাওয়াত পেয়ে অঙ্কন পেশা ছেড়ে দেন এবং স্বাভাবিকভাবেই আর্থিক সংকটে নিপতিত হন। তাঁর গানগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হলেও গীতিকার হিসেবে তিনি পেতেন খুবই সামান্য সম্মানী। এই দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতেন।
নিয়মিত অভাব অনটনের পরেও তার মুখের হাসি কখনো মলিন হতে দেখিনি। আর্থিক টানাপরেন সত্ত্বেও কখনো ফিরে যাননি পুরোনো পেশায়। আমি পাবলিকেশন্স সেক্টরের সাথে জড়িত বিধায় তাকে কিছু অঙ্কনের কাজ দিয়েছিলাম; কিন্তু তিনি কোনো ক্যারেক্টারের ছবি আঁকতে রাজি হননি।
আব্দুল কাদের হাওলাদার ভাই। আপনার কুরবানি আল্লাহ কবুল করুন। কত জানার পড়েছি নামাজ, আপনার জানাজাও শেষ পর্যন্ত পড়লাম। আপনার নামও মসজিদে এলান হলো। ফেসবুকে পোস্টারিং হলো। আপনার জীবনের লোকাল গাড়িও স্টেশনে ভিড়ল। এবার আমাদের পালা।
মহান রবের দরবারে প্রার্থনা মাঙি-জান্নাতের সেই বর্ণাঢ্য আসর, যেখানে স্বয়ং মহান রব মুমিনদেরকে তিলাওয়াত শোনাবেন, সেখানে আপনার সাথে যেন আমাদের সাক্ষাৎ হয়। আমরা একসাথে উপভোগ করতে পারি যেন-মহান মালিকের পবিত্র সুর!
-হাসিবুর রহমান
Rahman
স্ক্রিপ্ট রাইটার।