26/09/2025
স্মার্টফোনের পর্দা থেকে ঠিকরে আসা আলোয় একটি মুখ আলোকিত, চোখ দুটি চেনা সোশ্যাল মিডিয়া ফিডের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল স্রোতের গভীরে কিছু একটা বদলাচ্ছে, এক সূক্ষ্ম গুঞ্জন যা সাধারণ ব্যবহারকারীও অনুভব করতে পারছেন। যাঁরা মেটার ডিজিটাল প্রাঙ্গণে হেঁটেছেন, মিডজার্নির ফ্যান্টাসির জগতে একটু আধটু ঘুরে এসেছেন, কিংবা ব্ল্যাক ফরেস্ট ল্যাব থেকে আসা ফিসফিসে উদ্ভাবনের খবর রেখেছেন, তাঁদের জন্য এই হাওয়া এখন উত্তেজনা আর খানিকটা সংশয়ে মেশানো।
সামাজিক মাধ্যমের এই দৈত্য, মেটা, তার ব্যবহারকারীদের জন্য এক নতুন যুগের দ্বার খুলতে চলেছে—যে যুগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সূক্ষ্ম সুতোয় বোনা। ভাবুন তো, আপনি আপনার ফিড দেখতে দেখতে শুধু মানুষের তৈরি কনটেন্ট নয়, অ্যালগরিদমের নিজস্ব নির্যাস থেকে জন্ম নেওয়া ভিডিওর দেখা পাচ্ছেন। এগুলি কেবল সাজেস্ট করা ক্লিপ নয়; এগুলি হলো ডিজিটাল শূন্যতা থেকে উঠে আসা এআই-জেনারেটেড আখ্যান, যা একটি যন্ত্রের ধারণা—আপনার কী দেখতে ভালো লাগবে।
প্রথমটায় হয়তো এটা একরকমের নতুনত্ব মনে হবে, একটি কৌতূহলী পরীক্ষা। কিন্তু ধীরে ধীরে, মেটার অত্যাধুনিক অ্যালগরিদমগুলি, কোনো অভিজ্ঞ গল্পকারের মতো, আপনার পছন্দ, আপনার ছোট ছোট অভ্যাস, আপনার অব্যক্ত ইচ্ছেগুলো বুঝতে শুরু করবে। কনটেন্ট হয়ে উঠবে আরও বেশি ব্যক্তিগত, আপনার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা চলমান চিত্রের এক বিশেষ নকশা।
সৃষ্টির উপকরণ প্রস্তুত, আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে কিছু বানানোর জন্য। আপনার হাতে থাকবে শুরু থেকে একটি ভিডিও তৈরি করার ক্ষমতা, যেন এক ডিজিটাল ক্যানভাস আপনার নির্দেশের অপেক্ষায়। আবার, যাঁরা তৈরি করা গল্পের ওপর ভিত্তি করে কিছু গড়তে চান, তাঁদের জন্য ফিড থেকে একটি ভিডিও "রিমিক্স" করার সুযোগ থাকছে। ভাবুন: আপনি এক চমৎকার দৃশ্য দেখলেন, একটি ক্ষণিকের ঝলক, আর কিছু ট্যাপের মাধ্যমে তাতে নতুন ভিজ্যুয়াল যোগ করলেন, একটি মনকাড়া সুর বসালেন, কিংবা আপনার পছন্দের স্টাইল অনুযায়ী বদলে নিলেন সেটিকে। একবার আপনার সৃষ্টি নিখুঁত হয়ে গেলে, তা নতুন "ভাইবস" ফিডে পোস্ট করা যাবে, ব্যক্তিগতভাবে মেসেজে পাঠানো যাবে, অথবা ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক স্টোরিজ ও রিলসে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে।
তবুও, যে কোনো বড় প্রযুক্তিগত উত্থানের মতোই, এর গভীরে চাপা অসন্তোষের ফিসফাস শোনা যায়। ডিজিটাল দুনিয়ায় যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁদের অনেকের কাছেই "এআই-জেনারেটেড ভিডিও" শব্দটি একটি বিশেষ ভার বহন করে, যেন এক সংশয়ের ছায়া। স্বীকার করতেই হবে, এআই প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্তে অনেক ক্ষেত্রেই জন্ম নিয়েছে তথাকথিত "এআই স্লপ" বা ফালতু কনটেন্টের ঢল—যা ফিডগুলিকে ভরে দেয় এবং আসল বা খাঁটি বিষয়বস্তুর গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। ইউটিউবের মতো বড় প্ল্যাটফর্মগুলিও এই স্রোত আটকাতে চাইছে, কারণ তারা জানে যে যখন মৌলিকতা কমতে থাকে, তখন ব্যবহারকারীরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
ঠিক এই কারণেই মেটার এই পদক্ষেপটি বিশেষভাবে ভাবনার উদ্রেক করে, যেন তাদের নিজেদের গল্পেরই একটি অপ্রত্যাশিত বাঁক। এই বছরের শুরুর দিকেও সংস্থাটি কিন্তু "আসল গল্প বলা" (authentic storytelling)-এর পক্ষ নিয়েছিল, ক্রিয়েটরদেরকে ক্ষণস্থায়ী, মূল্যহীন ভিডিওর বদলে মৌলিক গল্পের ওপর জোর দিতে বলেছিল। এই বৈপরীত্য আমাদের ভাবায়: এটি কি ভবিষ্যতের দিকে এক নির্ভীক লাফ, নাকি দ্রুত পরিবর্তনশীল ডিজিটাল প্রেক্ষাপটে একটি হিসেবি ঝুঁকি?
এই কৌশলগত পরিবর্তনটি এমন এক সময়ে এলো যখন মেটা তার এআই বিভাগকে চাঙ্গা করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। ওপেনএআই, অ্যানথ্রপিক এবং গুগল ডিপমাইন্ডের মতো প্রতিযোগীদের নতুন নতুন উদ্ভাবনের খবর নিঃসন্দেহে মেটাকে তার নিজস্ব পথ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে। এটি কেবল প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই নয়, এর পাশাপাশি তাদের বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারীর মন জয় করারও প্রতিযোগিতা।
সুতরাং, ডিজিটাল স্রোত যখন বদলাচ্ছে এবং মানুষ ও মেশিনের সৃজনশীলতার সীমারেখা অস্পষ্ট হচ্ছে, তখন এক নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। মেটার এআই-চালিত এই নতুন আখ্যানটি কি একটি পছন্দের গল্প হয়ে উঠবে, নাকি এটি ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠা ডিজিটাল জগতের চ্যালেঞ্জে ভরা এক কাহিনি হবে? সে কথা বলবে শুধু সময় এবং এর ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা। আর আমরা যেমন স্ক্রল করে যাই, সৃষ্টি করে যাই, আর দেখতে থাকি, আমরাও এই চলমান গল্পের এক অবিচ্ছেদ্য চরিত্র হয়ে উঠি।
Bigbangla Story Time Episode-1 | 26-09-2025 | Dhaka