28/05/2024
‘সেলফ মেড’ শব্দটার সবচেয়ে বড় প্রমাণ শাহ্রুখ খান শুধুমাত্র অভিনয় দিয়ে আপনি শাহরুখ কে আবিস্কার করতে পারবেন না। অভিনেতা শাহরুখ এর চেয়ে ব্যক্তি শাহরুখ যোজন যোজন এগিয়ে। বিনয়, সেন্স অফ হিউমার
শাহরুখ এর চেয়ে বেশী ভারতবর্ষে আর আছে কার?
সারা বিশ্বে এত ক্রেজ এবং এত ফ্যানবেস খুব কম ভারতীয় অভিনেতাই তৈরি করতে পেরেছে। তাইতো তাকে গ্লোবাল স্টার বলা হয় Google এ the biggest movie star of the world লিখে সার্চ দিলে তাঁর নামটাই আসে।
কিন্তু এই লোকটির শুরুটা কখনো মসৃণ ছিলনা আজকের এই অবস্থানে আসতে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েছেন তিনি ২০ রূপী ও অভিনেতা হবার স্বপ্ন নিয়ে দিল্লি থেকে মুম্বাই আসা লোকটাই আজ ৬০০ মিলিয়ন ডলারের মালিক, যে বাড়ির সামনে একসময় ঘুমাতেন আজ সেই ২০০ মিলিয়ন ডলারের মান্নাতের মালিক তিনি। পৃথিবীতে যার ছড়িয়ে রয়েছে কোটি কোটি ফ্যান।
শাহরুখ খান একবার বলেছিলেন, ‘তারকা খ্যাতি যখন আমাকে মাথায় উঠিয়ে দেয়, নিজেকে যখন বিরাট কিছু ভাবতে শুরু করি, তখনই আমি যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তখন আমার সব অহংকার, মহাতারকা হওয়ার গৌরব এক নিমেষেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেন।’ খুব রূঢ় ও তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও শাহরুখ এভাবে বর্ণনা করেন। এটাই তাঁর স্বভাব।
স্ত্রী গৌরী নাকি ‘কিং খান’-এর এই ‘সেন্স অব হিউমার’ দেখে প্রেমে পড়েছিলেন, শুধু গৌরী নন, শাহরুখের এমন অনেক ভক্ত আছেন, যাঁরা তাঁকে অভিনেতা হিসেবে ফুল মার্কস না দিলেও তাঁর রসবোধের জন্য পারলে বোনাস নম্বর দেবেন।
শাহরুখ তাঁর অতীতের কথা যতটা হাসিঠাট্টার সঙ্গে বর্ণনা করেন, আদতে সেই গল্পগুলো এত মধুর নয় অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে শাহরুখ আজ এই অবস্থানে এসেছেন এখন এই তারকার কাছে সব আছে, দামি গাড়ি, প্রাসাদসম বাড়ি, ফার্ম হাউস, ব্যক্তিগত জেট, আরও অনেক কিছু।
একদিন শাহরুখের কাছে কিছুই ছিল না, অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে তাঁর দিশেহারা হয়ে ঘোরার কথা ছিল, শাহরুখ তা করেননি, নিজের জীবনের দিশা খুঁজেছেন থিয়েটারে, রোজগারের জন্য দিল্লির দরিয়াগঞ্জে একটি রেস্তোরাঁও চালিয়েছিলেন কিছুদিন এর মধ্যে এক পার্টিতে গৌরীর সঙ্গে দেখা।
শাহরুখের ভাষ্য, ‘গৌরী আমার জীবনের প্রথম নারী, যে আমার সঙ্গে সাড়ে তিন মিনিটের বেশি কথা বলে, আর এতেই আমি প্রশ্রয় পেয়ে যাই কিছুদিন পর তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসি, মেয়ে রাজি হয়ে যাওয়ায় আমার তখন পোয়া বারো। অনেকটা হেঁসে কথাগুলো বললেন।
গৌরীকে বিয়ে করে ইন্ডাস্ট্রিতে আসা শাহ্রুখকে নিয়ে কখনো কোন কেলেঙ্কারী বা স্ক্যান্ডাল শোনা যায় নি, হয়তো যাবেও না। ক্রিকেটে টেন্ডুলকার, বলিউডে শাহ্রুখ- যেন একই নাম। মুম্বাইয়ের জুবিলী সিনেমা হলের সামনে বসে ছোট্টবেলায় বসে বাদাম চিবুতে থাকা বাচ্চাটা একদিন শাহ্রুখ হবে, কে জানতো?
’শাহরুখ ‘আপ কি আদালত’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক রজত শর্মাকে বলেন, সিনেমায় অভিনয়ের কোনো পরিকল্পনাই নাকি ছিল না তাঁর। সব সময় খেলোয়াড় হতে চাইতেন, বিশেষ করে হকি খেলার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল ভীষণ, পিঠে চোট পাওয়ার কারণে খেলাধুলার ক্যারিয়ারকে তখনই বিদায় জানাতে হয়, একসময় চিন্তা করলেন, মুম্বাইয়ে গিয়ে টেলিভিশন সিরিয়ালে নাম লেখাবেন।
ছোটবেলা থেকে থিয়েটারের নাটক দেখে দেখে অভিনয় তাঁর ভালোই আয়ত্তে চলে এসেছিল, কিন্তু আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুরা তাঁকে টিভিতে মুখ দেখানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে সবাই বলল ‘তুই নায়ক হতে যাস নে' তোর চেহারা খুব বিশ্রী! এই রূপ নিয়ে তোকে কে নায়ক বানাবে? কথাগুলো শুনে শাহরুখের মন খারাপ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি দমে যাননি।
মুম্বাই আসার পর বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মনসুর খানের কাছে যান, মনসুর ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির পরিচালক, শাহরুখকে প্রথম দেখায় তিনি পছন্দ করলেন তিনি নাকি ‘কিং খান’কে বলেছিলেন ‘তোমাকে দিয়েই হবে, তোমার চেহারা এতই খারাপ যে আমি তোমাকে দিয়ে যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করাতে পারব!’ এ কথা শোনার পর আর কার মনোবল থাকে? দাঁতে দাঁত চেপে শাহরুখ তা সহ্য করলেন।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কোনো বাছবাছাই করেননি এই তারকা, ছোট পর্দায় অনেক ছোটখাটো চরিত্রে কাজ করেছেন, বড় পর্দায় যখন ডাক পড়ে, তখনো নায়ক, না খলনায়কের চরিত্রে কাজ করছেন, এসব নিয়ে মাথা ঘামাননি, অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর নিষ্ঠাই তাঁকে ‘বলিউড বাদশা’ বানিয়েছে।
ডার’ এবং ‘বাজিগর’ ছবির ভিলেন চরিত্র দিয়ে শুরু। সেখান থেকে ‘দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবির ‘রাজ’ এর মতো রোমান্টিক চরিত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। মুম্বাইয়ের মারাঠা মন্দির থিয়েটারে মুক্তির পর থেকে ২০১৫ পর্যন্ত টানা ২০ বছর চলেছে এই মুভি। মুভিটির প্রথম দর্শনেই হাত বাড়িয়ে কাজলকে ট্রেনে টেনে তোলার দৃশ্য কেউ কখনো ভুলতে পারবে?
টাইমস ম্যাগাজিনের হিসেব মতে শাহ্রুখই বিশ্বের বিগেস্ট সুপারস্টার, হলিউডের লিওনার্দো, ব্র্যাড পিট, টম ক্রুজ, ডাউনি জুনিয়র, সবাইকে টপকে। মানুষকে ভালোবাসতে শেখানোটা সবচে কঠিন কাজ; শাহ্রুখ তাঁর মুভিতে এই কাজটা করে দেখিয়েছে।
তরুণ-তরুণীদের নতুনভাবে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। সে যখন স্ট্রং স্ক্রিপ্টের মুভি করে, আমরা তাঁকে বক্স অফিসের ফিগার দেখাই। আবার যখন বক্স অফিস কাঁপানোর মতো মুভি করে, আমরা গল্প আর অভিনয়ের দোহাই দেই।
দিনে পাঁচ-সাতটা সিগারেট লাগে তাঁর, সবারই তাঁর স্মোকিং নিয়ে সমস্যা। এটা নিয়ে শাহ্রুখ বলে, “আমি যখনই খুব স্ট্রেসে থাকি… সিগারেট তুলে নিই। জীবনটা শুধুই আমার। আমি মনে করি আমার বেঁচে থাকতে হলে সিগারেটের দরকার আছে।”
এখনো শিশুদের মতোই মন তাঁর। একজন দায়িত্ববান স্বামী, একজন বাবা। তাঁর ছেলে ক্রিকেট পছন্দ করে বলেই কিনে নিয়েছেন কলকাতা নাইট রাইডার্স। বারবার হারলেও আইপিএলে যে দলটা ব্যবসা করতো সবচেয়ে বেশি, তিনি মাঠে আসতেন। দল হারলে গ্যালারীতে বসে চোখের কোনায় পানি মুছতেন। তাঁর আবেগটা সত্য, পরিষ্কার।
প্রতিদিন তাঁর বাড়ি ‘মান্নাত’ এর সামনে ভিড় জমে হাজারো ভক্তের। ঘুম ভেঙ্গে বারান্দায় এসে সবার প্রথমে ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন শাহ্রুখ।
যত কিছুই হোক, নাইন্টিজে জন্ম নেয়া খুব রোমান্টিক ছেলেটা বা নতুন প্রেমে পড়ে ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ দেখা মেয়েটির রুমে শাহ্রুখের পোস্টার রয়ে যাবে। সেটা অন্য কাউকে দিয়ে কখনোই রিপ্লেস হবে না। হাত বাড়িয়ে শাহ্রুখের ট্রেডমার্ক পোজটায় আর গালের টোলে ভক্তরা পাগল হবে, যুগ যুগ ধরে।
‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ মুভিতে মোটর সাইকেল থামিয়ে সানগ্লাস নামিয়ে দেখা, ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’ মুভির ওপেনিংয়ে রানীর সাথে প্রথম দৃশ্যটা, ‘সুরাজ হুয়া মাধ্যম’ গানে হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো, ‘ভীর জারা’র কোর্টে দাঁড়িয়ে কয়েদি নাম্বার ৭৮৬ এর চিঠিটা পড়া, ‘চালতে চালতে’তে রানীর বাড়ির সামনে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’র সত্তুর মিনিটের স্পিচ, ‘কাল হো না হো’র প্রীতিকে সাদা ডায়েরী পড়ে শোনানোর দৃশ্য।
‘রাব নে বানা দি জোড়ি’র প্যান্ট টেনে কোমর থেকে নীচে নামিয়ে রাজের এন্ট্রি, ‘দেবদাস’-এর শেষ দৃশ্যে পারুর মহলের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকা, ‘বাজিগার’ এর “কাভি কাভি কুচ জিতনে কে লিয়ে কুচ হারনা ভি পারতা হ্যায়… অর হার কার জিতনে ওয়ালে কো বাজিগার কেহতে হ্যায়” ডায়ালগটা আমাকে এখনো গুজবাম্প দেয়।
কেভিন স্পেইসী, টম হ্যাঙ্কস, ডেনজেল ওয়াশিংটন, এডওয়ার্ড নর্টন, ব্র্যাড পিট’রা মুগ্ধ করেছেন অনেকবার। বলিউডের উপর থেকে আগ্রহ চলে গেছে সেই স্কুল লাইফের পরেই। কিন্তু আবেগটা রয়ে গেছে একমাত্র সেই ছোটবেলার সুপারস্টারের জন্যই।
সবশেষে কথা একটাই, যদি কড়াকড়ি রকমের ফ্যান না হয়ে থাকেন, কখনোই বুঝবেন না অবসেশনটা, কখনোই না। একজন শাহরুখ ফ্যানকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তাঁর সুপারস্টার তাঁর কাছে কি। ফ্যান হবার অবসেশনটা কীরকম, জিজ্ঞেস করে দেখুন। অভিনেতা শাহরুখ কে আপনার ভালোবাসতর হবে না, ব্যক্তি শাহরুখ কে এড়িয়ে যাবেন কি করে? সে দরজা তো বন্ধ করেছে সে।
ধন্যবাদ শাহরুখ, কৃতজ্ঞতা দু’হাত বাড়িয়ে ভালোবাসতে শেখানোর জন্য, একজন ‘ইমোশোনাল ফুল’ বানানোর জন্য। Thanks For Making My Boyhood Wonderful!
একদিন ঠিকই জন্মদিনের প্লেকার্ড নিয়ে হাজির হয়ে যাবো আপনার স্বপ্নের মান্নাতের সামনে।
এই লেখাটা যখন লিখতেছিলাম, তখন খবর পেলাম শাহরুখ হিটস্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তীব্র গরম থেকে এমনটা হয়েছে জানিয়েছেন ডাক্তাররা। তাঁকে আহমেদাবাদের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবর হিন্দুস্তান টাইমস’র। আশাকরি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে বাদশা, এখনো অনেক গল্প লেখা বাকি।