24/06/2025
শহীদ নিজামীর ছেলেও এই পোস্ট শেয়ার দিয়েছেন
আমিরে জামায়াত ডক্টর শফিকুর রহমানের একটি বক্তব্যে অনেকেই বিচলিত এবং বিব্রত বোধ করছে। রাসূলে কারীম ﷺ এর একটি হাদীস; যা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত, সেই হাদীসটিকে সামনে রেখে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তিনি হাদীসটির সুস্পষ্ট অপব্যাখ্যা করেছেন। আমরা শুরুতে তার বক্তব্যটি তুলে ধরছি, তারপর হাদিসটি উল্লেখ করে তার সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরব। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, রাসূল ﷺ এর উসূল হচ্ছে, সামনে যখন দুইটি জিনিস লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য থাকতো, দুইটা বাহন অথবা দুইটা রাস্তা, অধিকতর সহজ যেটি সেটি গ্রহণ করতেন। উল্লেখ্য, তিনি হাদীস শরীফের সঠিক অনুবাদও করেননি; বরং অনুবাদ করতে গিয়ে কিছু মনগড়া শব্দ ও বাক্য টেনে এনেছেন। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীসের পরের অংশটি তিনি যদি বলতেন বা উল্লেখ করতেন, তাহলে হাদীসটি অপব্যাখ্যার আর কোন সুযোগই থাকতো না। একটি বিষয় স্পষ্টভাবে জেনে রাখা দরকার যে, পবিত্র কুরআনুল কারীম কিংবা আল্লাহর হাবিব নূর নাবীজি হযরত মুহাম্মাদ ﷺ এর কোন হাদীস নিজ থেকে ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই; বরং উম্মতের মহান মুজতাহিদগণ ও মুফাসসিরগণ যে ব্যাখ্যা করেছেন, সে ব্যাখ্যাটাই গ্রহণ করতে হবে। আর হাদিস শরীফ ব্যাখ্যার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকতে হবে।
হাদিস বোঝার ক্ষেত্রে ফকীহ হচ্ছে সবচেয়ে যোগ্য। অতএব, তিনি হাদিস ব্যাখ্যার আহাল না হয়েও, হাদিস শরীফ থেকে উদ্ধৃতি পেশ করলেন, সেটাও হাদীসের শব্দগুলো গ্রহণ করলেন না; যা একটি অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য।
এখন আসুন, আমরা বুখারী শরীফের হাদিসটি তুলে ধরছি এবং এ হাদিসটির অপব্যাখ্যার যে সুযোগ নেই, সে কথাটিও তুলে ধরছি। কারণ ডক্টর শফিকুর রহমান এ হাদিসটির অপব্যাখ্যা করে শিরক ও কুফরের উপর প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে হালাল করার বা বৈধতা দেওয়ার একটি অপচেষ্টা করেছেন। তাওহীদপন্থী কোন মুসলমান তা মেনে নিতে পারে না। হাদিসটি সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস নং. ৩৫৬০। হযরত আয়েশা রা: থেকে হাদীসটি বর্ণিত।
عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ أَنَّهَا قَالَتْ مَا خُيِّرَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بَيْنَ أَمْرَيْنِ إِلاَّ أَخَذَ أَيْسَرَهُمَا، مَا لَمْ يَكُنْ إِثْمًا... الخ
আম্মাজান আয়েশা রা: বলেন, আল্লাহর রাসূল নূর নাবীজি মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺ কে যখন দুটো কাজের ইখতেয়ার/ইচ্ছে দেওয়া হতো, তিনি দুটো পন্থার মধ্যে অধিকতর সহজ পন্থাটিকে গ্রহণ করতেন; যদি সে সহজ কাজটি গোনাহের কাজ না হয়ে থাকে।
এখানে হাদিস শরীফে তো স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা অন্য যে কোন ক্ষেত্রে রাসূলে কারীম ﷺ দুটি পন্থার মধ্যে সহজটি গ্রহণ করতেন, এ শর্তে যদি না সে সহজ পন্থাটি গুনাহ বা অন্যায় না হয়ে থাকে। তাহলে তো স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে, আল্লাহর হাবিব নূর নাবীজি মুহাম্মাদ ﷺ এর উম্মত হিসেবে আমরা যদি ওনার সুন্নাহের অনুসরণ করতে যাই, আমরাও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক বা যেকোনো তাৎপর্যপূর্ণ কাজে দুটি পন্থার মধ্যে তখনই সহজ পন্থাটিকে গ্রহণ করতে পারব, যদি সেটা শরীয়ত বিরোধী বা গুনাহের কোন কাজ না হয়।
দ্বিতীয়তঃ হাদিসের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়,
"ما خُيِّرَ رسولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بين أمرينِ
এখানে সীগাহটি মাজহুলের সীগাহ। অতএব, রাসূলুল্লাহ ﷺ কে যখন দুটো কাজের মধ্য থেকে যেকোনো একটি কাজকে বেছে নেওয়ার খেয়ার দেওয়া হতো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে খেয়ার কে দিতো? নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা।
অতএব, আল্লাহ তা’য়ালা নূর নাবীজি মুহাম্মাদ ﷺ কে দুটো কাজের যেকোনো একটি বেছে নেওয়ার খেয়ার দিলে, আল্লাহর রাসূল নূর নবীজি মুহাম্মাদ ﷺ দুটো পন্থার মধ্যে সহজটাকে গ্রহণ করতেন। সুস্পষ্ট ভাবে এ কথা তো হাক্কুল ইয়াকিন যে, আল্লাহ তা'আলা উনার হাবীব মুহাম্মাদ ﷺ কে কোন কাজে দুইটি পন্থার মধ্যে যেকোনো একটি পন্থা বেছে নেওয়ার সুযোগ যে দিতেন, সেখানে দুটো পন্থা'ই ছিল উত্তম এবং আল্লাহ তা’আলার বিধান অনুযায়ী সিদ্ধ। শুধু আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মাদ মোস্তফা ﷺ কে এতোটুকু এখতেয়ার দিতেন, তিনি কঠিন পন্থাটিকে বাদ দিয়ে সহজ পন্থাটিকে বেছে নিবেন।
অতএব, আল্লাহর আখেরী নাবীজি মুহাম্মাদ ﷺ কে দুটো পন্থার মধ্যে যেকোনো একটি পন্থাকে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো, তো আল্লাহর হাবিব মুহাম্মাদ ﷺ আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কাজে দুটো পন্থার মধ্যে যেকোনো একটি পন্থার সহজটি বেছে নিতেন। এটা হাদিসের উদ্দেশ্যে; হাদিসের বাকি অংশে এসেছে, সহজ পন্থাটি তখন রাসূল ﷺ বেছে নিতেন, যদি তা গুনাহের কাজ না হয়ে থাকে।
অতএব, আল্লাহর আখেরী নাবী নূর নাবীজি মুহাম্মাদ ﷺ এর ঈমানদার উম্মত হিসেবে বুখারী শরীফে বর্ণিত এই হাদিসের অনুসরণ করতে গেলে, আমাদের জন্য আবশ্যক হচ্ছে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ব্যক্তিজীবন; জীবনের যেকোনো মৌলিক বিষয়ে হোক, যদি দেখি দুটি পন্থা যার একটি কঠিন, একটি সহজ, তখনই আমরা কঠিন পন্থাটিকে গ্রহণ না করে, সহজ পন্থাটিকে বেছে নিতে পারবো, যদি সেটা হালাল/জায়েজ/বৈধ হয়।
এখন ডক্টর শফিকের কাছে আমার প্রশ্ন। তিনি এই হাদিসের অপব্যাখ্যা করে যে ব্যালট নির্বাচন পদ্ধতি বা গণতন্ত্রকে যে হালাল বলতে চাইলেন, আদৌও কি তা হালাল করা যাবে? বা গণতান্ত্রিক পন্থাকে বা ব্যালট বা নির্বাচনী পন্থাকে আদৌও কি এই হাদিসের অনুসরণে হালাল করা যায়?
এর জবাব হচ্ছে - অবশ্যই না। অতএব, তিনি যে হাদীসের অপব্যাখ্যা করলেন, আমরা বলবো, তিনি তার এই অপব্যাখ্যাকে প্রত্যাহার করবেন এবং মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট তওবা করবেন।
এবার আসুন গণতন্ত্রের বিষয়:-
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি শি-রক ও কু-ফরের উপর। সেটা কখনোই হালাল হতে পারে না;
তবে নির্বাচনি পদ্ধতিতে ভোটাভোটির বিষয়টা ভিন্ন আলোচনার দাবি রাখে।
গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের তন্ত্র, আইন কিংবা গণতন্ত্র হচ্ছে সেই রাজনৈতিক পদ্ধতি বা আদর্শ, যে রাজনৈতিক পদ্ধতি বা আদর্শে মহান আল্লাহ তা’আলাকে বাদ দিয়ে মানুষ হয়ে মানুষকে আইন বানাবার ক্ষমতা দেওয়া। এটা সুস্পষ্টভাবে একটি শি-রকি কাজ; যা সূরা আল ইমরানে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন।
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍۢ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا ٱللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِۦ شَيْـًۭٔا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًۭا مِّن دُونِ ٱللَّهِ ۚ فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُواْ ٱشْهَدُواْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ.(سورة ال عمران:٦٤)
এ আয়াতের তাফসীরের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে দেখা যায় যে, ই-হু-দী এবং খ্রি-স্টা-ন পন্ডিতগণ হালালকে হারাম করতো আর হারামকে হালাল করতো আর খ্রি-স্টা-ন ও ই-হু-দীরা তা মেনে নিতো। আর সেটাকে আল্লাহ তা’আলা মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে রব বানানোর মতো জঘন্য গুনাহ বা শিরকের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। আর গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি এটাই যে, আইন বানাবার অধিকার জনগণের এবং জনগণ অন্য মানুষদেরকে নির্বাচনে নির্বাচিত করে আইন প্রণেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়; যারা তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন তৈরি করে।
অতএব, যে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিটাই শি-র-কের মতো একটি জঘন্য বিষয় এবং আরো অসংখ্য শি-রক ও কু-ফর গণতন্ত্রের প্রত্যয়গুলোতে আছে, সেই গণতন্ত্রকে কি ইসলামীকরণের কোনো ব্যবস্থা আদৌও আছে? অবশ্যই তার কোন সুযোগ নেই।
এখন আসেন, নেতা নির্বাচনে নির্বাচনী যে পদ্ধতি তা নিয়ে কিছু কথা। নির্বাচনে যে পদ্ধতি অর্থাৎ ভোটাভুটির মাধ্যমে যে নেতা নির্বাচন, গণতন্ত্রের আদর্শকে বৈধ মনে না করে ওজর হিসেবে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ যদি কেউ করতে চায়, তাহলে অবশ্যই সেটাকে হারাম ও না-জায়েজ জেনেই করতে হবে। শরীয়তের একটি উসূল হচ্ছে,
الضرورة تتقدر بقدر الضرورة
অর্থাৎ, বিশেষ প্রয়োজন বা জরুরাতের সময় হারামকে হারাম জেনে কিছু সময়ের জন্য কাজটি করার অনুমতি থাকে; কিন্তু সেটাকে আদর্শ হিসেবে বা হালাল হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই।
অতএব, ডক্টর শফিক সাহেব স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছেন। আমরা আল্লাহর কাছে তার হেদায়েত কামনা করি। আর হারাম চিরকাল হারামই থাকবে; সেটাকে হালাল মনে করার কোন সুযোগ নেই। শরহু ফিকহীল আকবারে ইমাম আযম আবু হানিফা রহ. থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য,
من استحل حرمة قد ثبتت حرمتها بدليل قطعي فهو كافر
কোনো হারাম বিষয় যদি সুস্পষ্ট দলিল দিয়ে প্রমাণিত হয় বিষয়টি হারাম, সেটাকে যে হালাল মনে করবে সে কাফের হয়ে যাবে।
অতএব, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আমাদের সকল আলেম-ওলামা, পীর মাশায়েখ, নেতা, স্কলার, বুদ্ধিজীবী এমনকি সাধারণ মুসলমানদেরকেও এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।
এবার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে
একটি কথা বলবো। পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামপন্থীগণ ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু প্রায় একশ বছরের ইতিহাস এ কথারই প্রমাণ দেয়, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রে বা ভূখণ্ডে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামপন্থীগণ ক্ষমতায় যেতে পারে নি। ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠাও করতে পারেনি। তার দূর অতীতের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে মিশর; যেখানে ইখওয়ানুল মুসলিমিন ক্ষমতায় যেয়েও এক বছরের বেশি টিকতে পারেনি এবং তাদেরকে ব্যালট বাদ দিয়ে বুলেটই বুক পেতে নিতে হয়েছে। একই অবস্থা আমরা দেখতে পাই, তিওনিশিয়াতে। ‘ঘানুচি’ যেখানে ইসলামী রাজনীতির ব্যানারে আন্দোলন করে স্পিকার পর্যন্ত হয়েছে। তিওনিশিয়াতেও ঘানুচির পক্ষে ইসলামের পক্ষে একটি আইন পাশ করা সম্ভব হয়নি।
অতএব, বাংলাদেশেও কি তার ব্যতিক্রম কিছু হতে পারে? অবশ্যই এখানেও গনতান্ত্রিকভাবেই বিজয়ী হয়ে কখনোই ইসলামী শরিয়াহ রাষ্ট্র করা সম্ভব নয়; বরং সেটা হতে পারে জি-Ha-দের মাধ্যমে, হতে পারে বিপ্লবের মাধ্যমে। আর সে বিপ্লবটা হতে পারে নিরস্ত্র কিংবা স-শস্ত্র। বাকিটা সময় বলে দিবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেদায়েত দান করুক।