30/07/2025
‘হাকিমিয়াতে আলা’র পরিচয়
খালিদ : এখন আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন করি—হাকিমিয়াতে আলা বা সার্বভৌমত্ব বলতে কী বোঝায়?
আসলাম : সর্বোচ্চ সার্বভৌমত্বের অর্থ হলো—যার জন্য এই সার্বভৌমত্ব সাব্যস্ত হবে, তার নির্দেশের ঊর্ধ্বে কেউ থাকবে না এবং তার আদেশ-নিষেধ পাওয়ার সাথে সাথেই সবাই আত্মসমর্পণ করবে এবং কেউই অস্বীকার বা অমান্য করার দুঃসাহস দেখাবে না।
খালিদ : পাকিস্তানের সংবিধান কি এটিই বলে?
আসলাম : পূর্ববর্তী উদাহরণের মাধ্যমে তো বোঝা যায়—এটি একদমই সত্য নয়, দাবি যাই করুক না কেন।
খালিদ : আগের উদাহরণগুলো নিজের স্মৃতিতে ধরে রাখো, আরও কিছু আলোচনার প্রয়োজন আছে।
আসলাম : জি, আলোচনা চলুক। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
খালিদ : যদি বলা হয়—পাকিস্তানের সংবিধানে ‘হাকিমিয়াতে আলা’ অর্থাৎ সর্বোচ্চ সার্বভৌমত্ব আল্লাহর বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এর কারণ কী? তখন উত্তর হবে—মূলত তা কেবল বরকত (?) অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং এর মাধ্যমে নিজেদের তথা সংসদ ও সংসদ-সদস্যদের কুফরির ফতোয়া থেকে মুক্ত রাখার একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
আসলাম : যদি আপনি দলিল সহকারে প্রমাণ করেন, তাহলে আপনার জন্য অনেক ভালোবাসা থাকবে।
খালিদ : নাউজুবিল্লাহ! আমি যদি বলি যে, তাদের কাছে ও এই সংবিধান অনুসারে ‘হাকিমিয়াতে আলা’ বাক্যটি ক্ষমতাহীন অবস্থায় রয়েছে, যা কাউকে জেল থেকে মুক্তি দিতে পারে না বা কাউকে জেলে ঢুকাতেও পারে না। বরং এটি সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামতের ওপর নির্ভরশীল। তাহলে সংবিধানে এটির অবস্থান হল প্রাণহীন বস্তুর মতো।
আসলাম : এটা কীভাবে?
খালিদ : যদি শরিয়তের কোনো আইনকে দেশের প্রচলিত আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে এর জন্য কোন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে?
আসলাম : সংসদ সদস্যরাই তো দেশের আইন তৈরি করবেন।
খালিদ : এটা কীভাবে করবে?
আসলাম : আপনিই এর ব্যাখ্যা করেন। কারণ, হয় আমি আপনার প্রশ্ন বুঝতে পারিনি, অথবা উত্তরটি আমার জানা নেই।
খালিদ : এটি সংসদ সদস্যদের অনুমোদন ছাড়া আইনে পরিণত হতে পারে না। বরং সংসদ সদস্যরা যদি অনুমোদন করে, তবেই এটি আইনে পরিণত হবে, অন্যথায় নয়। যদিও আল্লাহ হলেন সর্বোচ্চ বিচারক ও ‘হাকিমে আলা’। কিন্তু তাঁর হুকুম-আহকামকে আইনের মর্যাদা দেওয়া আবশ্যক, এ-জন্য যে তিনি হাকিমে আলা বা সর্বোচ্চ বিচারক এবং এই অনুচ্ছেদ অনুসারে তার সকল আদেশ-নিষেধ নিঃসন্দেহে কোনো আপত্তি ছাড়াই আইন হওয়া উচিত। তবে উপর্যুক্ত স্থানে অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিধিবিধান এই কালো সংবিধান ও তাদের সামনে অসহায়। তাঁর নির্দেশকে আইনে পরিণত করার ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টি থাকে সংসদের দিকে। তিনি এই সকল সাংসদের সামনে আইনি প্রস্তাব করবেন এবং সংসদ সদস্যরা এটি যতক্ষণ পর্যন্ত অনুমোদন না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার আইন মাউকুফ থাকবে। আবেদনের পর এই আইন সম্পর্কে দুই ধরনের ফলাফল (পাস এবং ফেল) আসতে পারে, যা অন্য যেকোনো বিলের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এরপর যদি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধান মঞ্জুর হয়, তাহলে তো ঠিক আছে। আর যদি এটি মঞ্জুর না হয়, তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিধানের মর্যাদা একজন ব্যক্তির আইনি প্রস্তাবের মতোই হবে।
আসলাম : এটি তো খুবই বিপজ্জনক একটা ব্যাপার এবং আমার মনে হয় এটি ঈমানের শেষ পরিণতির লক্ষণ।
এই বিবেচনায় আল্লাহর সার্বভৌমত্ব তো বহু দূরের বিষয়, শুধু একজন পরামর্শকের মর্যাদা প্রমাণিত হতে পারে, একজন নির্দেশদাতার মর্যাদা কিছুতেই নয়। তবে আপনি যদি পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে এটি আমাকে প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।
খালিদ : ঠিক আছে, আপনি কি জানেন সংবিধানে ‘আইন প্রণয়ন’ পদ্ধতি নামে একটি অধ্যায় আছে?
আসলাম : হ্যাঁ, অবশ্যই! আর্টিকেল-৭০ থেকে নিয়ে আর্টিকেল-৭৭ নং পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে।
খালিদ : এখন আমি আপনাকে আর্টিকেলের অনুবাদ উদ্ধৃত করছি—
ফেডারেল আইনের অধীনে বা যৌথ আইনের অধীনে প্রথমে যেকোনো একটি বিল কোনো এক কক্ষে উপস্থাপিত হবে এবং যদি এটি যে কক্ষে উপস্থাপিত হয়েছিল সেই কক্ষ থেকে অনুমোদিত হয়, তবে এটি অন্য কক্ষে প্রেরণ করা হবে। এবং যদি অন্য কক্ষও কোনো সংশোধন ছাড়াই এটি অনুমোদন করে, তবে এটি অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে।
আপনি এই বাক্যগুলো স্মরণ রাখবেন। সামনে কাজে লাগবে।
আসলাম : ঠিক আছে। তারপর?
খালিদ : আপনি কি কখনো শুনেছেন—পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে শরিয়া বিল পেশ করা হয়েছে?
আসলাম : হ্যাঁ, আমার বয়স তখন কম, কিন্তু আমি জানি—এই বিলটি পাকিস্তানে তিনবার পেশ করা হয়েছিল এবং আমার মনে আছে সর্বশেষ এটিকে ‘হাসবা বিল’ নামে পেশ করা হয়েছিল।
খালিদ : যে-কোনো শরয়ি আইন দেশের আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, এই বিলটি কোনো একটি কক্ষে (উচ্চকক্ষ বা নিম্নকক্ষ) পেশ করতে হবে।
আসলাম : ঠিক!
খালিদ : কিন্তু আপনার কি জানা আছে, এই বিলটি কীসের জন্য পেশ করা হয়েছে?
আসলাম : যেকোনো বিল (শরিয়া বিল হোক বা অন্য কোনো বিল) সংসদে এ-জন্যই পেশ করা হয়, যাতে সংসদ সদস্যরা তা মঞ্জুর করে।
খালিদ : শরিয়া সংক্রান্ত বিল কি এভাবেই উপস্থাপন করা হয়?
আসলাম : অবশ্যই, ধারা-৭০ (১) এ বলা হয়েছে—‘যে-কোনো বিল’ অর্থাৎ যে বিলই হোক না কেন। এবং আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে হিসবাহ বিলটিও আছে, যা একই নিয়মে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছিল।
খালিদ : যাদের সংবিধানের কপালে ‘সর্বোচ্চ শাসক আল্লাহ ও সার্বভৌমত্ব আল্লাহর’ লেখা আছে, তাঁর কোনো আইন মঞ্জুরের জন্য বিল হিসেবে প্রস্তাব করা বিরাট অপরাধ নয় কি? হাকিমে আলা বা সর্বোচ্চ শাসকের আদেশ ও আইন কি কোনো অনুমোদন ছাড়াই আইনে পরিণত হওয়ার কথা নয়? সর্বোচ্চ শাসকের পদে অধিষ্ঠিত থাকার পরও, তিনি কি এই পার্লামেন্ট সদস্যদের সামনে তার আইনকে আইনের মর্যাদা দেওয়ার জন্য মুখাপেক্ষী হবেন? এবং যখন তারা অনুমোদন করবে, তখন এটি আইনে পরিণত হবে আর যদি তারা তা না করে, তাহলে এটি একটি সাধারণ আইনি প্রস্তাবের মতোই প্রত্যাখ্যাত হবে? এমনটা কি সর্বোচ্চ শাসকের পদের সঙ্গে উপহাস নয়?
আসলাম : তা ঠিক, এটা তো উপহাসই।
খালিদ : চৌদ্দশ বছর আগে নাজিল হওয়া আইন, শুধু ‘আল্লাহর পক্ষ হতে নাজিল হওয়া’ এ-কথার দলিল নয় যে, এটি পূর্ব থেকে অনুমোদিত একটি আইন?
আসলাম : কেন নয়, এটাই আমাদের আকিদা বা বিশ্বাস। এটাই আমাদের ঈমান।
খালিদ : তাহলে এই আইনটি মানুষের সামনে পেশ করা এবং তাকে বলা, যদি আপনি চান, এটিকে আইনের মর্যাদা দান করতে পারেন আর যদি আপনি না চান, তবে তা নাও করতে পারেন। এটা কি আল্লাহর আইনের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা নয়?
আসলাম : অবশ্যই।
খালিদ : আপনার কি মনে আছে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু কেন একজন মানুষের শিরশ্ছেদ করেছিলেন?
আসলাম : হ্যাঁ, সে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফয়সালা প্রদানের পরও উমারের কাছে দ্বিতীয়বার ফয়সালাটি উপস্থাপন করেছিল।
খালিদ : এটা কি সম্ভব ছিল না যে, উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেন এবং সেই ব্যক্তিকে বলে দিতেন—‘এই সিদ্ধান্ত মেনে নাও, এটা আমারও সিদ্ধান্ত?’
আসলাম : অবশ্যই সম্ভব ছিল।
খালিদ : তাহলে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে কেন হত্যা করলেন?
আসলাম : আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিদ্ধান্তকে উমারের কাছে এ-জন্যই পেশ করেছিল, যাতে কোনো ফাঁক-ফোকর বা সুযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। উমারের কাছে এটি অনুমোদন, অ-অনুমোদন বা সংশোধনের জন্য উপস্থাপন করা এবং উমারকে এতে কর্তৃত্ব প্রদানকারী হিসেবে বিবেচনা করাকে তিনি ওই লোকের কুফরি এবং বিরাট অপরাধ বলে মনে করেন। ফলে শুধু তরবারিই ছিল তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি।
খালিদ : আসলাম ভাই, এখন যদি কেউ কোনো মানুষের সামনে অনুমোদনের জন্য শরিয়তের কোনো আদেশ-নিষেধ উপস্থাপন করে এবং তাকে এই কর্তৃত্ব দেয়, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য উপযুক্ত মুআমালা কী হতে পারে?
আসলাম : শুধু উমারি তরবারি ছাড়া আর কিছুই না।
খালিদ : এবার আরেকটি অবিচার দেখেন—হাকিমে আলা বা সর্বোচ্চ শাসকের আইন এবং একজন সাধারণ ব্যক্তির আইনি প্রস্তাবের মধ্যে তারা কি পরিমাণ সমতা রক্ষা করেছে।
এই বিলটি উপস্থাপনকারী ব্যক্তির জন্য এমন কী কী শর্ত রয়েছে, যে শর্ত পূরণ হলে সে বিল উপস্থাপন করতে পারবে?
আসলাম : অন্তত কোনো-না-কোনো কক্ষের নির্বাচিত সদস্য তো হতেই হবে।
খালিদ : তাহলে আমাদের গ্রামের একজন দরিদ্র ব্যক্তি, যিনি কোনো সংসদের সদস্য নন, তার জন্য বিলের খসড়া তৈরি করে সংসদে উপস্থাপন করা বৈধ নয়?
আসলাম : না, ভাই। এর জন্য কোনো এক কক্ষের নির্বাচিত প্রতিনিধির সুপারিশ জরুরি।
খালিদ : আর আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনো আইনের ক্ষেত্রে কি এটা এমনই হবে না?
আসলাম : একদম তাই, যেকোনো বিল পেশের জন্য এই শর্ত (সদস্যপদ) একদম অপরিহার্য।
খালিদ : এই শর্তের দ্বারা মনে হচ্ছে যে, তাদের কাছে আল্লাহর আইনের কোনো বিশেষ মর্যাদা বা অবস্থান নেই।
যদি এটির কোনো মর্যাদা বা অবস্থান তৈরি করতে হয় (সংসদের অভ্যন্তরে আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়ার স্তর লাভ করা) তাহলে সংসদ সদস্যের সুপারিশের ভিত্তিতে তৈরি হবে। এবং যদি তিনি এর পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে এটি আলোচনার বিষয় হবে। আর যদি কোনো সাধারণ ব্যক্তি এটি নিয়ে যায়, তবে তাকে শরিয়া বিলসহ সংসদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।
আসলাম : ঠিক এমনটাই।
খালিদ : তাহলে একজন হাকিমে আলা বা সর্বোচ্চ শাসক এবং একজন সাধারণ আইন প্রণেতার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে?
আসলাম : না ভাই, তারা এই পার্থক্য মিটিয়ে দিয়েছে।