18/09/2025
আমার খালু খুবই গম্ভীর ব্যক্তি। রাজনীতি থেকে সবসময় দূরে থাকেন। কেউ রাজনৈতিক আড্ডা শুরু করলেই সেখান থেকে উঠে যান। বলেন এসব আজেবাজে জিনিস নিয়ে উনার আগ্রহ নেই। ডাকসু নির্বাচনে শিবির জেতার পরদিন খালার বাসায় গিয়ে দেখি খালু খুশিমনে টিভিতে ডাকসুর নিউজ দেখতেছেন।
খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'খালু এতো খুশি কেন? ঘটনা কি?'
খালা বললো, 'খুশি হবে না? তোর খালু ছাত্রজীবনে শিবিরের সাথী ছিলো।'
'বলো কি, এই খবর তুমি কিভাবে জানো?'
'আমি জানব না? তোর খালুর সাথে আমার পরিচয় তো এভাবেই।'
'তুমিও শিবির করতে?'
'ধুর পাগল। আমি শিবির করব কেন? আমি ছিলাম ছাত্রীসংস্থা।'
খালা খালুর এই ঘটনায় আমার কিছু কাহিনী মনে পড়ে গেল।
ছোটবেলায় একবার বন্ধুদের সাথে পিকনিকে গিয়েছিলাম। সাথে ছিলো এলাকার কয়েকজন বড়ভাই। তারাই পিকনিকের আয়োজক। সারাদিন অনেক খেলাধুলা, মজা আনন্দ, কুইজ প্রতিযোগিতা হলো। পরে শুনি সেই ভাইয়েরা আসলে শিবির।
ক্লাস সিক্স সেভেনে ওঠার পর ফুলকুড়ি নামে একটা সংগঠনে যোগ দিলাম। ফুলকুড়ি কি করে? ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা, পিটি প্যারেড, প্রতিযোগিতা, আনন্দ উৎসব অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ফুলকুড়ি পত্রিকাও পাওয়া যেত। সেখানে ছোটদের উপযোগী গল্প কবিতা থাকতো। ছোটবেলা থেকেই আমার এসবের প্রতি খুব আগ্রহ ছিলো। একটু বড় হয়ে জানলাম এটা শিবিরেরই আরেকটা অঙ্গসংগঠন।
এইট নাইনে উঠে গল্প উপন্যাস পড়ার নেশা পেয়ে বসলো। টুকটাক লেখালেখিও শুরু করলাম। তখন এক বড়ভাই হাতে তুলে দিলো কিশোরকণ্ঠ নামে এক ম্যাগাজিন৷ তাতে প্রচুর গল্প উপন্যাস কৌতুক কার্টুন আছে। আমি খুশিমনে নিয়মিত গ্রাহক হয়ে গেলাম। পরে শুনলাম এই পত্রিকা শিবিরের।
এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস পাওয়ার পর স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার নামে এক সংগঠন থেকে সংবর্ধনা দিলো। ফুল, ক্রেস্ট, খাওয়াদাওয়া। সাথে সারাদিন বসে ভাষণ শুনলাম। পরে জানতে পারি এটাও শিবিরেরই সংগঠন।
কলেজে যে ভাই সবসময় এসে খোজখবর নিতো। লেখাপড়া নিয়ে পরামর্শ দিতো। গল্পগুজব করতো। উনাদের সাথে আড্ডা দেয়ার আমন্ত্রণ জানাতো। খোজ নিয়ে জানলাম ভাই শিবিরের কলেজ শাখার সেক্রেটারি।
তখন শিবির নিয়ে সবজায়গায় আতংক৷ শিবির করলেই পুলিশ ধরে। বাসা থেকে প্রতিদিন বলে দেয় যেন শিবিরের ধারেকাছে না যাই। এক বন্ধু খবর আনলো যারা শিবির পছন্দ করেনা তারা মিলে একটা সংগঠন করেছে৷ অরাজনৈতিক সংগঠন। তিন চারমাস পরে শুনলাম সেই সংগঠনের পেছনেও নাকি শিবিরের হাত।
ইন্টারের পর কোচিং এ ঢাকা যেতে দেরি হয়ে গেল। গিয়ে কোনো থাকার জায়গা খুজে পাই না। এক ক্লোজ বন্ধুর মাধ্যমে একটা মেসে উঠলাম। মাসখানেক পরে শুনলাম এটা শিবিরের মেস। আড়াইমাস পরে জানলাম যে বন্ধু আমাকে মেসে উঠিয়েছে সেও শিবির করে। তারও কিছুদিন পর জানলাম যে কোচিং সেন্টারে কোচিং করি সেটাও নাকি শিবিরের। যে প্রকাশনীর বই পড়ে প্রস্ততি নিচ্ছি ওটাও শিবিরের প্রকাশনী।
ভার্সিটিতে ওঠার পর ছাত্রলীগের মিছিল মিটিং এ যেতে হতো দুয়েকদিন পরপরই। আমার মিছিলে যেতে একদমই ভালো লাগতো না৷ পরপর দুইদিন মিছিলে গেলাম না। পরে শুনি এই খবর সবাই জেনে গেছে। রাতেরবেলা আমাকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তার রুমে ডেকেছে। আমার শাস্তির ব্যবস্থা হবে। ভয়ে আমার অবস্থা খারাপ।
সাধারণ সম্পাদক ভাই কয়েকটা ধমক দিলেন। মারবে মারবে অবস্থা, কিন্তু মারলেন না শেষপর্যন্ত। তার বদলে সাইডে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, এরপর থেকে মিছিলে যেতে না চাইলে যেন হলে বসে না থাকি৷ অন্য কোথাও চলে যাই। ভাইয়ের কথা শুনে আমি অবাক হলাম।
ভার্সিটি শেষ করার তিন বছর পর শুনি ছাত্রলীগের সেই সাধারণ সম্পাদক ভাইও আসলে শিবিরের নেতা।
দার্শনিকরা সারাজীবন চিন্তা করে এসেছেন মানুষ কে? মানুষের প্রকৃত পরিচয় কি? মানুষ কেন এসেছে দুনিয়াতে। এই জিনিসটাকে এক্সিস্টেনশিয়ালিজম বলে।
এখন আমার মনে হয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তর ফাইনালি পাওয়া গেছে। মানুষের পরিচয় আসলে একটাই-
মানুষ মূলত শিবির।
Courtesy - Sohial Rahman