Paranormal Society BDS

Paranormal Society BDS এটি একটি ভৌতিক, রহস্য গল্প উপন্যাসের পেইজ।এখানে সকল ধরনের গল্প উপন্যাস এবং হরর মুভি দেখতে পারবেন।

ড্রাকুলার অতিথি  ( শেষাংশ)......প্রথম পর্বের পরকথাটা শুনে গলায় হাত দিলুম, ছুঁতেইব্যথায় চিৎকার করে উঠলুম। সবাই পিছনফিরে...
01/10/2025

ড্রাকুলার অতিথি ( শেষাংশ)......প্রথম পর্বের পর

কথাটা শুনে গলায় হাত দিলুম, ছুঁতেই
ব্যথায় চিৎকার করে উঠলুম। সবাই পিছন
ফিরে তাকাল। কেউ কেউ ঘোড়া
থেকে নেমে এল। তরুণ অফিসারটি
আবার শান্ত গলায় বললেন, “আমি বলছি,
কুকুর। অন্য কিছু বললে, লোকে আমাদের
কথা শুনে হাসবে।”
তারপর এক জওয়ানের পিছনে ঘোড়ায়
উঠে পড়লুম। এগিয়ে চললুম মিউনিখের
শহরতলির পথ ধরে। এখানে একটা
ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া গেল। তাতে
উঠে আমার হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা
হলুম। তরুণ অফিসারটি আমার সঙ্গে
চললেন। একজন জওয়ান ঘোড়ায় চড়ে
আমাদের অনুসরণ করল। অন্যেরা
ব্যারাকে ফিরে গেল।
আমরা ফিরতেই হের ডেলব্রুক ছুটে
এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। মনে
হল, উনি আমাদের পথ চেয়েই ছিলেন।
আমার দুই হাত ধরে তিনি আমাকে
এগিয়ে নিয়ে চললেন। অফিসারটি
আমাকে স্যালুট ঠুকে বিদায় নিতে
চাইলেন। ব্যাপার বুঝে তাঁকে আমার
কামরায় আমন্ত্রণ জানালুম। এক গ্লাস
পানীয় দিয়ে তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদের
আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা
জানালুম। তিনি শুধু বললেন, হের
ডেলব্রুক প্রথমেই খোঁজ-পার্টি নিয়োগ
করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন।
হোটেল-মালিক এই কথায় একটু হাসলেন
মাত্র। তারপর অফিসারটি ডিউটির
কথা জানিয়ে বিদায় নিলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কিন্তু, হের
ডেলব্রুক, আপনি কেমন করেই বা আর
কেনই বা আমাকে খোঁজার জন্য ওই
জওয়ানদের নিয়োগ করলেন?”
তিনি কাঁধ নাচিয়ে নিজের কাজটা
একটু খাটো করে দেখানোর চেষ্টা
করলেন, বললেন, “আমি যে
রেজিমেন্টে আছি তার কম্যান্ডারের
কাছে কিছু স্বেচ্ছাসেবক
চেয়েছিলাম; ওঁর সহায়তা ভুলব না।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কিন্তু আমি
যে হারিয়ে গেছি, সেকথা আপনি
জানলেন কী করে?”
“আরে মশাই, ঘোড়াগুলো পালিয়ে
গেল। ড্রাইভার অনেক কষ্টে ভাঙা
গাড়িটা নিয়ে ফিরে এল।”
“কিন্তু সেজন্য নিশ্চয়ই আপনি আমার জন্য
সামরিক খোঁজ-পার্টি পাঠাননি?”
“ওহো, না!” তিনি জবাব দিলেন, “কিন্তু
কোচোয়ান ফিরে আসার আগে, আপনি
যে বোয়ারের অতিথি, তাঁর থেকে
একটা টেলিগ্রাম পাই।” উনি পকেট
থেকে একটা টেলিগ্রাম বের করে
আমার হাতে দিলেন। পড়ে দেখলুম:
বিস্ট্রিজ। আমার অতিথি সম্পর্কে
সাবধান–তাঁর সুরক্ষা আমার কাছে
সবচেয়ে মূল্যবান। তাঁর কিছু হলে, তিনি
হারিয়ে গেলে, তাঁকে খোঁজার জন্য
সব কিছু করবেন। তাঁর সুরক্ষার সবরকম
ব্যবস্থা করবেন। তিনি ইংরেজ, এবং
সেই জন্য একটু অ্যাডভেঞ্জার-প্রিয়। বরফ,
নেকড়ে আর রাত খুব বিপজ্জনক। তাঁর
ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে, সময় নষ্ট করবেন
না। খরচপত্র নিয়ে ভাববেন না, ওটা
আমি দেখব। –ড্রাকুলা।
টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে আমার
মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগল। হোটেল-
মালিক আমাকে না ধরলে বোধহয়
পড়েই যেতুম। পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত আর অকল্পনীয় মনে হল। আমার এই অস্তিত্ব
যেন আমার বিরুদ্ধ শক্তির এক খেলা
মাত্র–কথাটা ভেবেই আমার হাত-পা
অবশ্য হয়ে এল। নিশ্চয় কোনো রহস্যময়
রক্ষাকবচ ঘিরে ছিল আমাকে। নয়তো
তুষার আর নেকড়ের মুখ থেকে আমাকে
রক্ষা করতে বহু দূরের এক দেশ থেকে
একেবারে সঠিক সময় এমন বার্তা
কীভাবে এল!

সমাপ্ত

Next season coming soon

ড্রাকুলার অতিথিযাত্রা শুরু করার সময়ও মিউনিখের আকাশে জ্বল জ্বল করছিল মধ্যাহ্নসূর্য; বাতাসে ভাসছিল নববসন্তের উচ্ছ্বাস। রও...
01/10/2025

ড্রাকুলার অতিথি

যাত্রা শুরু করার সময়ও মিউনিখের আকাশে জ্বল জ্বল করছিল মধ্যাহ্নসূর্য; বাতাসে ভাসছিল নববসন্তের উচ্ছ্বাস। রওনা হওয়ার ঠিক আগে হের ডেলব্রুক (যে হোটেলে উঠেছিলাম, তার মালিক) নগ্নশিরেই ছুটে এলেন আমাদের গাড়ি অবধি। আমাকে শুভ যাত্রা জানালেন। তারপর গাড়ির দরজার হাতলে হাত রেখে কোচোয়ানকে বললেন, “রাত পড়ার আগেই ফিরে আসিস কিন্তু। আকাশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু উত্তুরে হাওয়ায় একটা কাঁপুনি লাগছে। মনে হচ্ছে, ঝড় উঠবে। তাই, দেরি করিসনি।” তারপর একটু হেসে বললেন, “আজকের রাতটা কি, সে খেয়াল আছে তো!”
জোহান দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলে, “Ja, mein Herr.” (“হ্যাঁ, কর্তা।”) তারপর নিজের টুপিটা চেপে ধরে গাড়ি ছুটিয়ে দিলে। শহর ছেড়ে বেরিয়ে এসে ওকে থামতে নির্দেশ করলুম। জিজ্ঞাসা করলুম:
“আজকের রাত্তিরটা কি হে জোহান?”
সে বুকে ক্রুস এঁকে ছোট্ট করে জবাব দিলে: “Walpurgis nacht.” (“ওয়ালপারজিস রাত।”) তারপর একটা সেকেলে, টার্নিপের আকার-বিশিষ্ট, জার্মান সিলভারের ঘড়ি বের করলে; সেটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা অস্থিরভাবে কাঁধ নাচালে; বুঝলুম, অকারণে সময় নষ্ট করছি দেখে সে একটা সশ্রদ্ধ প্রতিবাদ জানালে। তাই ফিরে এসে গাড়ি হাঁকাতে বললুম। সেও সময় নষ্ট করল না। নষ্ট সময়টুকু পুষিয়ে নিতে দিল ছুট। এদিকে ঘোড়াগুলো মাঝেমধ্যেই মাথাঝাঁকানি দিয়ে উঠে খুব রহস্যজনকভাবে বাতাসে কি একটা শুঁকতে লাগল। আমিও ভয় পেয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলুম। রাস্তার ধারে জনবসতি সেরকম ছিল না। জায়গাটা একধরনের বায়ুতাড়িত মালভূমির মতো। যেতে যেতে দেখলুম, পাশে একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে নেমে গিয়েছে নিচের উপত্যকার দিকে। মনে হল, সেই রাস্তায় লোক-চলাচল বিশেষ হয় না। ভারি ভাল লাগল। কোচোয়ানকে বিরক্ত করে আরেকবার তাকে থামালুম; বললুম ওই রাস্তায় একটিবার যেতে। সে নানা ওজরআপত্তি তুলে বারবার বুকে ক্রুস আঁকতে লাগল। এতে আমার কৌতুহল গেল বেড়ে। তাকে নানা প্রশ্ন করতে লাগলুম। সেও নাছোড়। বার বার ঘড়ি-দর্শন প্রতিবাদ চালিয়ে গেল।
শেষে বললুম, “আচ্ছা, জোহান, শোনো। আমি ওই রাস্তায় যাচ্ছি। তুমি যেতে না চাইলে তোমাকে জোরাজুরি করব না। কিন্তু কেন ওখানে যাবে না, সেটা তো বলবে।” এবার সে বক্স থেকে নেমে এল মাটিতে। হাতজোড় করে আমাকে সেখানে না যেতে অনুরোধ করতে লাগল। তার জার্মানের মধ্যে মোটামুটি ইংরেজি মেশানো ছিল, তাতে ওর কথা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। সে আমাকে একটা কিছু বলতে চাইছিল–এমন একটা কিছু যা ওর কাছে খুবই ভয়ের ব্যাপার; কিন্তু প্রতিবারই ওই “Walpurgis nacht!” ছাড়া আর কিছুই বলে উঠতে পারছিল না সে।
ওর সঙ্গে খানিক তর্ক করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু যার ভাষা জানি না, তার সঙ্গে তর্ক করা মুশকিল। ওর বরং একটু সুবিধেই ছিল। যদিও সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারত, কিন্তু তখন এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, নিজের ভাষা ছাড়া আর কিছুই তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। প্রত্যেকবার কথা বলতে বলতে সে ঘড়ি দেখছিল। তারপর ঘোড়াগুলোও অশান্ত হয়ে বাতাসে কি যেন শুঁকতে লাগল। তাতে সে আরও ভয় পেয়ে গেল। চারদিকে তাকাতে লাগল। তারপর হঠাৎ সামনে দিকে লাফিয়ে এসে ঘোড়ার লাগাম ধরে এগিয়ে নিয়ে তাদের প্রায় কুড়ি ফুট দূরে গিয়ে রাখল। আমি পিছন পিছন গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ও অমন করল কেন। জবাব দেওয়ার আগে সে একবার বুকে ক্রুস আঁকলে। তারপর গাড়িটা রাস্তার অন্য দিকে রাখতে রাখতে আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম, সেই জায়গাটা দেখাল। তারপর চৌমাথাটা দেখিয়ে প্রথমে জার্মানে ও পরে ইংরেজিতে বলল, “তাকে কবর দিয়েছে–যে নিজেকে মেরেছিল।”
আত্মহত্যাকারী! মনে পড়ল, আত্মহত্যাকারীদের রাস্তার চৌমাথায় কবর দেওয়া হত: “ওহ্! তাই বলো, আত্মহত্যা। ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে!” অবশ্য মুখে যাই বলি, ঘোড়াগুলি কেন অমন করছিল, তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না।
কথা বলতে বলতে কুকুরের কান্নার মতো একটা ডাক শুনতে পেলাম। দূর থেকে আসছিল আওয়াজটা। কিন্তু ঘোড়াগুলো তাতে খুব অশান্ত হয়ে উঠল। জোহান অনেক কষ্টে তাদের শান্ত করল। সে নিজেও ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বলল, “নেকড়ের ডাক–অথচ এদিকে এখন নেকড়ে নেই।”
“নেই?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু অনেক কাল আগে তো নেকড়েরা শহরের কাছেই থাকত, তাই না?”
সে জবাব দিল, “অনেক অনেক আগে। তাও বসন্তে আর গ্রীষ্মে। কিন্তু বরফের মরসুমে নয়।”
ঘোড়াগুলির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সে তাদের শান্ত করতে লাগল। আকাশে একটা কালো মেঘ দ্রুত এগিয়ে এল। রোদ পড়ল ঢাকা। একটুখানি ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগল। একটুখানিই। বোধহয় সতর্ক করে গেল। কারণ খানিক বাদেই আবার সূর্য মুখ দেখালেন।
জোহান দিগন্তের দিকে আঙুল তুলে বলল, “বরফের ঝড়। অনেক দিন আগে এসেছিল।” তারপর আর একবার ঘড়ি দেখল। লাগামটা শক্ত করে ধরে রইল। কারণ ঘোড়াগুলো মাটিতে খুরের আঘাত করতে করতে অস্থির হয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছিল। এবার সে বক্সে উঠে গেল। বলতে চাইল, যাওয়ার সময় হয়েছে।
আমার ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত লাগল। তখনই গাড়িতে চড়লুম না।
আমি রাস্তাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, “ওই রাস্তাটা কোথায় গেছে?”
সে আর একবার বুকে ক্রুস এঁকে খানিকটা বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে বলল, “ওটা অপবিত্র।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি অপবিত্র?”
“গ্রামটা।”
“ও! ওখানে গ্রাম আছে?”
“না না। ওখানে কয়েকশো বছর কেউ থাকে না।”
আমার কৌতুহল বেড়ে গেল, “তবে যে বললে ওখানে গ্রাম আছে।”
“ছিল।”
“এখন কোথায় গ্রামটা?”
জার্মান-ইংরেজি মিশিয়ে সে আমাকে একটা লম্বা গল্প শোনাল। তার সবটা যদিও বোধগম্য হল না–কিন্তু এটুকু বুঝলুম, অনেকদিন আগে, মানে বেশ কয়েকশো বছর আগে, এখানে কিছু লোক মারা যায় এবং তাদের কবর দেওয়া হয়। কিন্তু মাটির তলা থেকে আশ্চর্য শব্দ শুনে লোকেরা কবর খুঁড়ে দেখে, সেখানে শায়িত নরনারীর দেহে হৃদয়ের স্পন্দন আর মুখে লাল রক্ত লেগে। তখন তারা ভয় পেয়ে যায়। নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য (এবং অবশ্যই নিজেদের আত্মাকেও বাঁচানোর জন্য! একথা বলে জোহান আর একবার বুকে ক্রুস আঁকল।) তারা সবাই সেই জায়গা ছেড়ে পালিয়ে এমন জায়গায় চলে যায় যেখানে জীবিতরা জীবিত আর মড়ারা মড়াই–অন্য কিছু না। শেষ কথাটা সে বেশ ভয়ে ভয়ে বললে। গল্পটা বলতে বলতে সে ভারি উত্তেজিত হয়ে পড়ল। মনে হল যেন, কল্পনাই ভর করেছে থাকে। শেষকালটায় দেখি ভয়ে তার মুখখানা সাদা হয়ে গেছে; ঘামতে ঘামতে আর কাঁপতে কাঁপতে চারপাশে এমন করে তাকাচ্ছে যেন এই প্রকাশ্য দিবালোকেই কোনো অশরীরী আতঙ্ক তার চারপাশে সে ঘুরতে দেখছে।
শেষকালে সে মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠল “Walpurgis nacht!” বলেই আমাকে গাড়িতে ওঠার জন্য অঙ্গুলিনির্দেশ করল।
এতে আমার ইংরেজ-রক্ত উঠল টগবগিয়ে ফুটে। পিছিয়ে এলুম। বললুম, “তুমি ভয় পাচ্ছ, জোহান–আচ্ছা, তাহলে বাড়ি ফিরে যাও। আমি একাই ফিরব। একটু হাঁটাহাঁটি করা আমার পক্ষে ভালই।” গাড়ির দরজা খোলা ছিল। আমার ওক কাঠের লাঠিটা সিট থেকে বের করে নিলুম–ছুটিছাঁটায় হাঁটতে বেরোলে এই লাঠিটা সঙ্গে নিয়ে বের হই–তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে মিউনিখের দিকে নির্দেশ করে বললুম, “বাড়ি যাও, জোহান–ইংরেজ ওয়ালপারজিস রাতকে ডরায় না।”
ঘোড়াগুলি ততক্ষণে ভীষণই অশান্ত হয়ে উঠেছে। তাদের ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতেই জোহান আমাকে মিনতি করে বলতে লাগল, বোকার মতো কাজ না করতে। বেচারিকে দেখে দয়া হচ্ছিল–কুসংস্কার মাথাটি খেয়ে বসেছিল তার; আবার না হেসে ও পারছিলাম না। উত্তেজনার বশে সে ভুলেই গিয়েছিল যে, তার ভাষা আমি বুঝি না; সে ইংরেজি ছেড়ে কথ্য জার্মানেই বকরবকর করে যেতে লাগল। শেষটায় যখন আর সহ্য হল না তখন রাস্তার দিকে দেখিয়ে বললাম, “বাড়ি!” বলেই পিছন ফিরে চৌমাথায় নেমে উপত্যকার দিকে এগিয়ে চললাম।
সে হতাশ হয়ে শেষে ঘোড়া ঘোরালো মিউনিখের দিকে। আমি লাঠিতে ভর দিয়ে একবার পিছন ফিরে দেখলাম। প্রথমটা সে রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে চলেছিল। তারপরই পাহাড়ের মাথায় একটা লম্বা রোগা লোকের আবির্ভাব ঘটল। দূর থেকে এটুকুই দেখতে পেলাম–লোকটা ঘোড়ার দিকে এগোতেই, ঘোড়াগুলো লাফিয়ে উঠে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ভয়ে চিৎকার করতে লাগল। জোহান আর তাদের ধরে রাখতে পারল না। তারা তীরবেগে ছুট দিল পথ ধরে। দেখলাম, তারা দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল। আগন্তুকের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, সেও ততক্ষণে চলে গিয়েছে।
জোহান যে নিচু উপত্যকায় যেতে আপত্তি করছিল, পথ ধরে তার দিকেই চললুম নিশ্চিন্ত মনে। জোহানের আপত্তির কোনো কারণই খুঁজে পেলুম না। কয়েকঘণ্টা ঘোরাঘুরি করলুম। কত সময় বয়ে গেল, কত দূর এলুম–এসবের খেয়াল রইল না। তবে বাড়ি বা লোকজন কিছু চোখে পড়ল না। কেমন নির্জন পরিত্যক্ত গোছের জায়গা। এই ব্যাপারটা আগে খেয়াল হয়নি। রাস্তার বাঁকে এসে কয়েকটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঠের বাড়ির ধ্বংসস্তুপ দেখে বুঝলাম যে আমাকে যা মুগ্ধ করছিল, তা এই জায়গাটার পরিত্যক্ত রূপটি ছাড়া আর কিছুই না।
বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসে চারপাশটা একবার দেখে নিলুম। মনে হল, হাঁটা শুরুর আগে যতটা ঠান্ডা ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা তখন বোধ হচ্ছিল। একটা ফিসফিসানি শব্দ আমার চারপাশে মাঝেমাঝেই শোনা যাচ্ছিল। মাথার উপরেও কেমন একটা হালকা গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। উপরে তাকিয়ে দেখি, বিরাট ঘন মেঘ দ্রুত উত্তর থেকে দক্ষিণে আকাশে ছেয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ঝড়ের পূর্বাভাস। ঠান্ডা লাগছিল। ভাবলাম, বসে থাকা ঠিক হবে না। তাই আবার চলতে শুরু করলুম।
এবার যে জায়গাটায় এলুম, সেটা ভারি সুন্দর। বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু যদিও ছিল না, কিন্তু সব কিছুর মধ্যে একটা সৌন্দর্যের ভাব ছিল। সময়ের খেয়াল ছিল না। তারপর গোধূলির আলো ক্ষীণ হয়ে এলে মনে হল, এবার পথ খুঁজে বাড়ি ফিরি কি করে? বাতাস ঠান্ডা। মাথার উপর মেঘও ঘনীভূত হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে গম্ভীর মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে। যে গর্জনকে ভেদ করে আবার মধ্যে মধ্যে রহস্যজনক এক চিৎকার শোনা যাচ্ছে–যেটাকে ড্রাইভার বলেছিল নেকড়ের চিৎকার। খানিক ইতস্তত করলাম। আসার পথে একটা পরিত্যক্ত গ্রাম দেখেছিলাম। সেদিকেই হাঁটা দিলাম। উপস্থিত হলাম একটা খোলা প্রান্তরে। চারদিকে তার পাহাড় দিয়ে ঘেরা। গাছে ঢাকা প্রান্তভাগ নেমে গিয়েছে সমভূমির দিকে। তবে ঢাল কম। এখানে সেখানে ঝোপঝাড় আর গর্ত। একটা রাস্তা দেখলাম এঁকেবেঁকে একটা ঘন ঝোপের দিকে এগিয়ে গেছে, তারপর তার পিছনে গিয়ে হারিয়ে গেছে।
সেদিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় কনকনে ঠান্ডা বাতাস লাগল গায়ে। বরফ পড়া শুরু হল। মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ। কাছেই কোনো কাঠের স্তুপে আশ্রয় নিতে গেলুম। এদিকে আকাশ কালো হয়ে এল। মুষলধারে বরফ পড়া শুরু হল। দেখতে দেখতে আমার চারপাশে সাদা গালচে বিছিয়ে গেল, তার শেষ কোথায় দেখতে পেলুম না। পথের ধারগুলো ঠিক চিহ্ন দেওয়া ছিল না। তাই সেটাও আর দেখতে পেলুম না। খানিক বাদেই পায়ের তলায় ঘাস আর শ্যাওলার স্পর্শে বুঝলুম, পথ থেকে সরে এসেছি। বাতাসের গতি জোর হল। তার বিরুদ্ধে হাঁটাও কষ্টকর হল। সেই বাতাস আবার হিমশীতল। হেঁটেও ঠান্ডার কাঁপুনি থেকে রেহাই পেলুম না। এত জোরে বরফ পড়ছিল যে চোখ খোলা রাখাও দুষ্কর হল। মাঝে মধ্যেই আকাশ বিদীর্ণ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সেই আলোয় দেখলুম আমার সামনে এক ঘন জঙ্গল–মূলত ইউ আর সাইপ্রাস গাছের বন, সবটাই বরফে ঢাকা।
শিগগিরই আশ্রয় নিলাম সেই গাছের ছায়ায়। জায়গাটা তুলনামূলকভাবে নিঃস্তব্ধ। মাথার অনেক উপরে বায়ুর গর্জন শোনা যাচ্ছিল। ঝড়ের অন্ধকার তখন মিশে গিয়েছিল রাতের অন্ধকারে। তারপর এক সময় ঝড় থেমে গেল। শুধু মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া বইতে লাগল। এই অবস্থায় সেই নেকড়ের অদ্ভুত শব্দটা আমার চারপাশের নানা শব্দের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
মাঝেমাঝে ভাসমান কালো মেঘের ফাঁক গলে একটু আধটু জ্যোৎস্না গলে পড়ছিল। সেই আলোয় দেখলুম, আমি সেই গভীর সাইপ্রাস আর ইউ গাছের বনের শেষভাগে এসে দাঁড়িয়েছি। বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এলুম। চারপাশটা ভাল করে ঘুরে দেখলুম। মনে হল, যে সব ভগ্নস্তুপ পেরিয়ে এসেছি, তার মধ্যে একটা বাড়ি রয়েছে যেখানে আমি খানিকের জন্য আশ্রয় নিলেও নিতে পারব। যদিও সেই বাড়িটাও ভাঙাই। ঝোপের ধারে আসতেই দেখি একটি নিচু পাঁচিল সেটাকে ঘিরে আছে। তারপরে খানিকটা খোলা জায়গা। এখানে একটা সরু পথ চলে গিয়েছে একটা চৌকো বাড়ির মতো স্থাপনার দিকে। পথটা আসলে সাইপ্রাস-বীথি। বাড়ির মতো জিনিসটা দেখার পরই আবার মেঘ এসে চাঁদকে আড়াল করে দিল। আমি অন্ধকারেই পথটা পেরিয়ে এলুম। হাওয়া বোধহয় আরও ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কাঁপতে কাঁপতে হাঁটতে লাগলুম। আশ্রয়ের আশায় কোনোক্রমে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেলুম।
সেখানে কেমন একটা হঠাৎ-স্তব্ধতা অনুভূত হল। দাঁড়িয়ে পড়লুম। এদিকে ঝড় থেমে গেছে। সম্ভবত প্রকৃতির স্তব্ধতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার বুকের ধুকপুকুনিও থেমে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা সাময়িক। হঠাৎ চাঁদের আলো ফুটে উঠল। দেখলাম, আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা কবরখানায়। আমার সামনে ওই চৌকো বস্তুটা আসলে একটা বিরাট শ্বেতপাথরের সমাধিসৌধ। তার চারপাশের মাটিও বরফে বরফে সাদা। চাঁদের আলোর সঙ্গে বয়ে এল ঝোড়ো বাতাসের ফিসফিসানি একটা শব্দ। যেন অনেকগুলি কুকুর বা নেকড়ে একসঙ্গে চিৎকার করছিল। ভয় পেয়ে গেলুম। সারা শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। শ্বেতপাথরের উপর পড়েছিল চাঁদের আলো। এমন সময় নতুন করে ঝড় ওঠার তোড়জোড় শুরু হল। মোহমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল সমাধিফলকটির দিকে। ওটা কি, কেন এভাবে একা এখানে দাঁড়িয়ে–তা জানার আগ্রহ জাগল। চারদিকে ঘুরে ডোরিক তোরণটার উপর দেখি জার্মানে লেখা–
কাউন্টেস ডোলিনজেন অফ গ্রাটজ
স্টাইরিয়া-তে
তাঁকে অনুসন্ধান করা হয় ও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়
১৮০১
সমাধিসৌধের উপর পাথরের চাঙড় ভেদ করে উঠেছে একটা বড়ো লোহার বর্শা বা শূল। পিছনে গিয়ে দেখি রাশিয়ান হরফে বড়ো বড়ো করে লেখা রয়েছে: “মৃতেরা ভ্রমণ করে দ্রুত।”
একটা গা-ছমছমে অনুভূতি হল। হাত পা অবশ হয়ে এল। প্রথম বার মনে হল, জোহানের কথা শুনলেই ভাল করতুম। আরও একটা ভাবনা আমার মনে উদয় হল– কথাটা মনে এল নাটকীয়ভাবে আর একটা নাড়া দিয়ে গেল মনটাকে–আজ ওয়ালপারজিস রাত্রি!
লক্ষ লক্ষ লোক মনে করে, ওয়ালপারজিস রাত হল সেই রাত, যে রাতে শয়তান ঘুরে বেড়ায় বাইরে–যে রাতে কবরের ঢাকা যায় খুলে; মৃতেরা উঠে এসে হেঁটে চলে বেড়ায়। যে রাতে জলে স্থলে আকাশে সর্বত্রই সব কিছুর উল্লাস শুরু হয়। ড্রাইভার এখানে এসেই ভয়ে পেয়েছিল। এই সেই গ্রাম যেটি ব হুশতাব্দী আগে জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। এখানে লোকে করেছিল আত্মহত্যা। এমন এক জায়গায় আমি একা, সম্পূর্ণ একা। তার উপর মাথার উপর দানা বাঁধছে ঝড় আর আমি কাঁপছি বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে। আমার পড়া সব দর্শন, ধর্মশিক্ষা আর সাহস একত্রিত করে দাঁড়ালাম, যাতে ভয়ে অজ্ঞান না হয়ে যাই।
তারপরই এক মহাঝড় আছড়ে পড়ল আমার উপর। মাটি কেঁপে উঠল। যেন হাজারে হাজারে পাগলা ঘোড়া ছুটে বেরিয়ে গেল। এবার আর বরফ নয়, ঝড় তার হিমশীতল ডানায় বয়ে আনল শিলাবৃষ্টি–ভয়ানক এক শিলাবৃষ্টি। সাইপ্রাসের গাছগুলো দাঁড়িয়ে রইল বটে, কিন্তু তার পাতা আর ডাল ভেদ করে পড়তে লাগল শিল। একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিয়েছিলুম। কিন্তু গাছের তলায় দাঁড়ানো নিরাপদ বোধ হল না। তখন ভরসা শুধু সেই শ্বেতপাথরের সমাধিমন্দিরের ডোরিক তোরণটি। সেই বিশাল ব্রোঞ্জের দরজায় হেলান দিয়ে শিলাবৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পেলুম। শিল পড়তে লাগল আমার চারপাশের পাথরে।
দরজায় হেলান দিয়েছিলুম বলে সেটা পিছন দিকে খুলে গেল। এই নির্দয় ঝড়ের হাত থেকে রেহাই পেতে তখন কবরের আশ্রয়ই সই। সেখানেই ঢুকতে যাচ্ছিলুম, এমন সময় প্রচণ্ড জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল–সেই আলোয় দেখলুম সমাধিগৃহের অন্ধকারে এক সুন্দরী নারী শায়িত, তার গালদুটি সুডৌল, ঠোঁটদুটি লাল। মনে হল সে বেদির উপর কফিনে শায়িত। চমকে উঠলুম। মাথার উপর আকাশ গর্জে উঠল। যেন দুটো দৈত্যের হাত আমাকে টেনে বাইরে বের করে আনল ঝড়ের মধ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শিলাবৃষ্টির আঘাতে পড়ে গেলাম। কিন্তু সেই সঙ্গে কেন জানি মনে হতে লাগল যে আমি একা নই। সমাধিসৌধটার দিকে তাকালুম। সৌধের মাথার উপর শ্বেতপাথর ফুঁড়ে যে লৌহফলকটা উঠেছিল, তার উপর বাজ পড়ল। সমাধিসৌধটার পাথর ফেটে তাতে আগুন লেগে গেল। মৃত রমণীটি এক মুহুর্তের জন্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। তার চিৎকার ডুবে গেল ঝড়ের গর্জনে। শেষ যে শব্দটা শুনলাম, তা অনেকগুলো ভয়ংকর শব্দের মিশ্রণ। আবার কোনো দৈত্যের হাত আমাকে ধরে টেনে নিয়ে চলল। আমার উপর শিল পড়তে লাগল। চারদিক থেকে নেকড়ের গর্জন শোনা যেতে লাগল। শেষ যা দেখলাম, মনে আছে, একটা অস্পষ্ট, সাদা, চলমান পুঞ্জ। মনে হল আমার চারপাশের কবরখানা তার সব মৃতের প্রেতাত্মাদের পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তারা যেন সেই শিলাবৃষ্টির সাদা অন্ধকারের মধ্যে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
একটুখানি হুঁশ ফিরতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলুম। খানিকক্ষণের জন্য আবার জ্ঞান হারালুম, আবার একবার ফিরে এল চেতনা। পায়ে প্রচণ্ড বেদনা অনুভূত হল, নড়তে পারলুম না; মনে হল পা দুটো অসাড় হয়ে গেছে। ঘাড়ে একটা হিমশীতল স্পর্শ টের পেলুম, শীতল ভাবটা আমার শিরদাঁড়া ধরে নেমে এল। পায়ের মতো কানদুটোও অসাড় হয়ে এসেছিল যন্ত্রণায়। শুধু বুকের কাছে একটা গরম ভাব পাচ্ছিলাম, যাতে তুলনামূলকভাবে একটু আরাম পাচ্ছিলুম। পুরো ব্যাপারটাই মনে হল দুঃস্বপ্ন–শারীরিক দুঃস্বপ্ন। মনে হল, আমার বুকের উপর এমন কিছু চেপেছে, যাতে করে আমার নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে।
এই অর্ধ্বচৈতন্যাবস্থা স্থায়ী ছিল অনেকক্ষণ। সেটা কেটে গেলে মনে হল আমি বোধহয় ঘুমাচ্ছিলাম। তারপর একটা গা-বমি ভাব এল–ঠিক সি-সিকনেসের প্রথম ধাপের মতো। নিজেকে কিছুর থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রবল বাসনা দেখা দিল–কিন্তু কিসের থেকে সেটাই বুঝলুম না। এক প্রকাণ্ড স্থবিরতা গ্রাস করল আমাকে। মনে হল, সারা পৃথিবীটা হয় ঘুমাচ্ছে, নয় মরে গেছে–শুধু আমার কাছে বসে থাকা কতকগুলো জানোয়ারের নিঃশ্বাসের আওয়াজ সেই নৈঃশব্দের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। গলার কাছে একটা উষ্ণ বিচ্ছিরি শব্দ পেলুম, তারপর ব্যাপারটা টের পেলুম; সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিণ্ডটা ঠান্ডা হয়ে এল ভয়ে। একটা বিরাট জন্তু আমার উপর শুয়ে আমার গলাটা চাটছিল। ভয়ে নড়তে পারলাম না। আমার সহজাত প্রবৃত্তি আমাকে চুপটি করে পড়ে থাকতে বলল। কিন্তু মনে হল, জন্তুটা আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন টের এল। সে তার মাথা তুলল। চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখলুম, আমার উপর এক দৈত্যাকার নেকড়ের দুটো বড়ো বড়ো চোখ জ্বল জ্বল করছে। তার ফাঁক হয়ে থাকা বিরাট মুখের মধ্যে চকচক করছে ধারালো সাদা দাঁত। তার গরম জান্তব ক্ষুরধার নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার উপর।
তারপর আবার খানিকক্ষণ কিছু মনে ছিল না। তারপর একটা নিচু গলায় গোঙানির আওয়াজ শুনে হুঁশ ফিরল। খানিকবাদে একটা কুকুরের কান্নার মতো আওয়াজ শুনলাম। বারবার নতুন করে আওয়াজটা উঠতে লাগল। তারপর অনেক দূর থেকে অনেক মানুষের গলায় একটা “Holloa! holloa!” আওয়াজ শুনতে পেলুম। সাবধানে মাথা তুলে যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল, সেদিকে তাকালুম। কিন্তু কবরখানাটা আমার দৃষ্টিপথের বাধা হতে লাগল। এদিকে নেকড়েটা অদ্ভুতভাবে ডেকেই চলল। তার লাল দৃষ্টি ঘুরে গেল সাইপ্রাসের ঝাড়ের দিকে; যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল, সেই দিকে। কণ্ঠস্বরগুলো কাছাকাছি আসতেই নেকড়ের গর্জনও তীব্র হয়ে উঠল। ভয়ে চুপ করে কাঠ হয়ে পড়ে রইলুম। আমার চারপাশের অন্ধকারের সাদা আস্তরণের উপর একটা লাল আলোর আভাস দেখতে পেলুম। তারপর হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে একদল মশালধারী অশ্বারোহী বেরিয়ে এল। এইবার নেকড়েটা আমার বুকের উপর থেকে উঠে কবরখানার পথ ধরল। একজন অশ্বারোহী (তার টুপি ও লম্বা সামরিক পোষাক দেখে তাকে জওয়ান বলে চিনলুম) নিজের কারবাইন তুলে তাক করল। তার এক সঙ্গী তার হাতটা সরিয়ে দিল। শুনলাম মাথার উপর দিয়ে বুলেটটা হুস শব্দ করে বেরিয়ে গেল। আগের লোকটা বোধকরি আমার শরীরটাকে নেকড়ের শরীর বলে ভুল করেছিল। আরেকজন জানোয়ারটাকে পালাতে দেখে গুলি চালাল। তারপর ঘোড়ার টগবগ শুনলুম। অশ্বারোহীর দল এগিয়ে এল–একদল এল আমার দিকে, অপর দলটা তুষারাবৃত সাইপ্রাস বনে নেকড়েটার পিছনে ধাওয়া করল।
তারা কাছে আসতে আমি উঠতে চেষ্টা করলুম, কিন্তু শরীরে বল ছিল না। যদিও আমার চারপাশে কী চলছিল, সবটাই দেখতে- শুনতে পাচ্ছিলুম। দু-তিনজন জওয়ান তার ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে আমাকে ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসল। তাঁদের একজন আমার মাথাটা তুলে নিজের হাতটা আমার বুকের উপর রাখলেন।
তারপর চেঁচিয়ে উঠে বললেন, “সব ঠিক আছে, বন্ধুরা! উনি বেঁচে আছেন!”
আমার গলায় খানিকটা ব্র্যান্ডি ঢেলে দেওয়া হল। তাতে খানিকটা বল পেলুম। এবার চোখ খুলে তাকালুম। চারদিকটা দেখলুম। গাছের আড়ালে আলোছায়া খেলা করছিল। শুনলাম, সবাইকে ডাক দেওয়া হল। সব তাড়াতাড়ি কবরখানা থেকে বেরিয়ে এল। সকলের চোখেমুখে আতঙ্ক। যে লোকগুলো আমার কাছে বসেছিল, তারা জিজ্ঞাসা করল, “তাকে পেলে?”
জবাবে সবাই একবাক্যে বলে উঠল, “না! না! এখুনি চলে আসুন, শিগগির-শিগগির! এখানে থাকা নিরাপদ নয়, আর আজকের রাত্তিরটাও ভাল না!”
তারপর সবাই নানা ভাবে যে প্রশ্নটা করল, সেটা হল, “ওটা কী?” উত্তরটাও এল নানা ভাবে। মনে হল, সবাই একটা কিছু দেখে ভয় পেয়েছে–সেই ভয়ের দ্বারা তাড়িত হয়েই কথা বলছে।
“ওটা–ওটা–অবশ্যই!” একজন বিড়বিড় করে কী বলতে গেল, কিন্তু কোনো কথা খুঁজে পেল না।
“নেকড়ে–আবার নেকড়ে নয়!” আর একজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল।
তৃতীয়জন সাদামাটাভাবে বলল, “পবিত্র বুলেট ছাড়া তাকে মারার চেষ্টা করা বৃথা।”
চতুর্থ জন বললে, “আজকেড় রাতে যেটুকু করতে পেরেছি তাই অনেক–লাখ টাকার কাজ করেছি!”
আর একজন বললে, “ভাঙা শ্বেতপাথরে রক্ত দেখলুম। নিশ্চয়ই বাজ পড়ে ওখানে রক্ত আসেনি। আর উনি–উনি কী নিরাপদ? ওঁর গলাটা দেখুন! বন্ধুরা দেখো, নেকড়েটা ওঁর বুকের উপর বসে ওঁর রক্তকে গরম রেখেছিল।”
অফিসার আমার গলা পরীক্ষা করে উত্তর দিলেন, “উনি ঠিক আছেন, চামড়ায় ফুটো নেই। কিন্তু এর মানে কী? ওই নেকড়েটা চিৎকার না করলে আমরা ওঁকে খুঁজেও পেতাম না।”
“ওটার কী হল?” যে লোকটি আমার মাথা ধরেছিলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। এঁকে ততটা ভীত মনে হল না–তাঁর হাত শক্ত ছিল, কাঁপুনির কোনো লক্ষণ দেখা দেয়নি। তার স্লিভে দেখলাম জুনিয়র অফিসারের শেভরন।
একটা লোক তার ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে ভয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে বলল, “ওটা ঘরে ফিরে গেছে। এখানে ওর শোয়ার জন্য অনেক কবর রয়েছে। চলে এসো, বন্ধুরা–শিগগির! এই জায়গাটা অভিশপ্ত!”
অফিসারটি আমাকে বসালেন। তারপর তাঁর আদেশে কয়েকজন এসে আমাকে ধরে ধরে একটা ঘোড়ার উপর বসালো। তিনি আমার পিছনে বসে আমাকে ধরে রইলেন। এগোনোর নির্দেশ দিলেন। সাইপ্রাস বন ছাড়িয়ে আমরা সামরিক ছন্দে এগোতে শুরু করলুম।
কথা বলতে পারছিলুম না বলে চুপ করে রইলুম। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। যখন ঘুম ভাঙল, দেখি আমি দুপাশে দুজন জওয়ানের কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে আছি। দিনের আলো ফুটে উঠেছে। বরফের অবশেষের উপর উত্তরের পথে রোদের আলো পড়ে পথটাকে রক্ত-রাঙা মনে হচ্ছে। অফিসারটি লোকেদের বলছেন, যা দেখেছো, সে সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতে হবে না, শুধু বলবে একজন আগন্তুক ইংরেজকে খুঁজে পেয়েছো, একটা কুকুর তাকে পাহারা দিচ্ছিল।
ভয়-পাওয়ার দলের একজন বলে উঠল, “কুকুর! ওটা কুকুর নাকি? আমি জানি, নেকড়ে চিনি নে!”
তরুণ অফিসার শান্তভাবে বললেন, “আমি বলছি, ওটা কুকুর।”
দিনের আলো দেখে লোকটির হারানো সাহস ফিরে আসছিল, সে ব্যঙ্গভরে বলল, “কুকুর! দেখুন ওঁর গলাটা, ওটা কি কুকুরের কাজ, কর্তা?”
কথাটা শুনে গলায় হাত দিলুম, ছুঁতেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠলুম। সবাই পিছন ফিরে তাকাল। কেউ কেউ ঘোড়া থেকে নেমে এল। তরুণ অফিসারটি আবার শান্ত গলায় বললেন, “আমি বলছি, কুকুর। অন্য কিছু বললে, লোকে আমাদের কথা শুনে হাসবে।”
তারপর এক জওয়ানের পিছনে ঘোড়ায় উঠে পড়লুম। এগিয়ে চললুম মিউনিখের শহরতলির পথ ধরে। এখানে একটা ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া গেল। তাতে উঠে আমার হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলুম। তরুণ অফিসারটি আমার সঙ্গে চললেন। একজন জওয়ান ঘোড়ায় চড়ে আমাদের অনুসরণ করল। অন্যেরা ব্যারাকে ফিরে গেল।
আমরা ফিরতেই হের ডেলব্রুক ছুটে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। মনে হল, উনি আমাদের পথ চেয়েই ছিলেন। আমার দুই হাত ধরে তিনি আমাকে এগিয়ে নিয়ে চললেন। অফিসারটি আমাকে স্যালুট ঠুকে বিদায় নিতে চাইলেন। ব্যাপার বুঝে তাঁকে আমার কামরায় আমন্ত্রণ জানালুম। এক গ্লাস পানীয় দিয়ে তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদের আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানালুম। তিনি শুধু বললেন, হের ডেলব্রুক প্রথমেই খোঁজ-পার্টি নিয়োগ করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। হোটেল-মালিক এই কথায় একটু হাসলেন মাত্র। তারপর অফিসারটি ডিউটির কথা জানিয়ে বিদায় নিলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কিন্তু, হের ডেলব্রুক, আপনি কেমন করেই বা আর কেনই বা আমাকে খোঁজার জন্য ওই জওয়ানদের নিয়োগ করলেন?”
তিনি কাঁধ নাচিয়ে নিজের কাজটা একটু খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করলেন, বললেন, “আমি যে রেজিমেন্টে আছি তার কম্যান্ডারের কাছে কিছু স্বেচ্ছাসেবক চেয়েছিলাম; ওঁর সহায়তা ভুলব না।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কিন্তু আমি যে হারিয়ে গেছি, সেকথা আপনি জানলেন কী করে?”
“আরে মশাই, ঘোড়াগুলো পালিয়ে গেল। ড্রাইভার অনেক কষ্টে ভাঙা গাড়িটা নিয়ে ফিরে এল।”
“কিন্তু সেজন্য নিশ্চয়ই আপনি আমার জন্য সামরিক খোঁজ-পার্টি পাঠাননি?”
“ওহো, না!” তিনি জবাব দিলেন, “কিন্তু কোচোয়ান ফিরে আসার আগে, আপনি যে বোয়ারের অতিথি, তাঁর থেকে একটা টেলিগ্রাম পাই।” উনি পকেট থেকে একটা টেলিগ্রাম বের করে আমার হাতে দিলেন। পড়ে দেখলুম:বিস্ট্রিজ। আমার অতিথি সম্পর্কে সাবধান–তাঁর সুরক্ষা আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। তাঁর কিছু হলে, তিনি হারিয়ে গেলে, তাঁকে খোঁজার জন্য সব কিছু করবেন। তাঁর সুরক্ষার সবরকম ব্যবস্থা করবেন। তিনি ইংরেজ, এবং সেই জন্য একটু অ্যাডভেঞ্জার-প্রিয়। বরফ, নেকড়ে আর রাত খুব বিপজ্জনক। তাঁর ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে, সময় নষ্ট করবেন না। খরচপত্র নিয়ে ভাববেন না, ওটা আমি দেখব। –ড্রাকুলা।
টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে আমার মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগল। হোটেল-মালিক আমাকে না ধরলে বোধহয় পড়েই যেতুম। পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত আর অকল্পনীয় মনে হল। আমার এই অস্তিত্ব যেন আমার বিরুদ্ধ শক্তির এক খেলা মাত্র–কথাটা ভেবেই আমার হাত-পা অবশ্য হয়ে এল। নিশ্চয় কোনো রহস্যময় রক্ষাকবচ ঘিরে ছিল আমাকে। নয়তো তুষার আর নেকড়ের মুখ থেকে আমাকে রক্ষা করতে বহু দূরের এক দেশ থেকে একেবারে সঠিক সময় এমন বার্তা কীভাবে এল!

।। লরা।। ( অসম্পূর্ণ উপন্যাসিকা) মূল কাহিনী : ড্রাকুলার আবির্ভাবলেখক : ব্রাম স্টোকারভাষান্তরে : সব্যসাচী রায় এবং সুবোধ চ...
01/10/2025

।। লরা।। ( অসম্পূর্ণ উপন্যাসিকা)
মূল কাহিনী : ড্রাকুলার আবির্ভাব
লেখক : ব্রাম স্টোকার
ভাষান্তরে : সব্যসাচী রায় এবং সুবোধ চক্রবর্তী
যে বই দুটি থেকে গল্পটি কালেক্ট করা হয়েছে : ড্রাকুলা অমনিবাস এবং ড্রাকুলার আতঙ্ক
প্রকাশক : কামিনী প্রকাশনালয়

৯ ম এবং শেষ পর্ব

আঃ! এতক্ষণে পার্কটা ফাঁকা হয়েছে!

কি আনন্দ!

কি মজা!

আমি এখন একা, সম্পূর্ণ একা - কেউ নেই আমার আশেপাশে। এতবড় পার্কটা একেবারে জনশূন্য।

কিন্তু আমি কি বাসায় যাব না? রাত তো হয়ে এল। আমার হাতঘড়িটা তো রয়েইছে দেখছি - রাত ন'টা!

আমি কেন এখানে বসে থাকব, এই ঝোপের ভেতর?

আমি বাসায় যাব। ডক্টর হেনরীকে সব খুলে জানাব - বলব, আমি জানি না মিঃ রিচার্ডসনের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কেন অমন করে ওর গলার চামড়া ফুটো করে পর পর তিনদিন রক্ত টেনে খেলাম! সব বলব, হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন যেন গুড়গুড় করে ওঠে, মাথাটা কেমন ভার ভার মনে হয় আর তারপরেই যেন নাকে কাঁচা টাটকা রক্তের গন্ধ পেতে থাকি। আর রক্ত টেনে খাবার জন্য প্রাণটা আইঢাই করতে থাকে। এরপর আর কিছু মনে থাকে না। যখন আবার খেয়াল হয় তখন বুঝতে পারি আমার মুখে ঠোঁটে রক্ত লেপ্টে রয়েছে - বাচ্চাটার ঘাড়ের ওপর আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছি।

আমি নিজেই বুঝতে পারি না - কখন বীভৎস কাজটা করে ফেলেছি... আহাহা, কচি শিশুর গলায় অমন করে কোনো মানুষ দাঁত বসিয়ে ফুটো করতে পারে?

আমি সব খুলে বলব ডক্টর হেনরীকে। জানতে চাইব, কেন আমার অমন হয়, কেন আমি এই কাজ করে বেড়াচ্ছি?

তাঁকে গিয়ে সব না বলতে পারলে আমি যে বাসায় ফিরতে পারব না।

কিন্তু এই জনহীন নিরালা পার্কটাতে আজ এত ভাল লাগছে কেন আমার?

চারপাশে গাছের নিচে নিচে কেমন ছায়াগুলো জমে জমে রয়েছে - তবু তো ভয় করছে না এতটুকু।
....ও কিসের শব্দ হল?

ওকি? আবার সেই কালো বেড়ালটা! ওটা এখানেও আমার পিছু নিয়েছে!

ওটাকে দেখেই বোধ হয় খানিক আগে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম - হ্যাঁ, মনে পড়েছে... ওকি! আমার দিকে কিরকম করে তাকিয়ে আছে বেড়ালটা!
....আয় মেনী আয়....আয়।

তুই আমি দুজনেই এই পার্কে থাকব। কি মজাই হবে! আয়...আয়।

না বাপু আর এখানে নয়.... ডক্টর হেনরী লোকটা ভয়ানক পাজি....আমায় ধরতে পারলেই সোজা পুলিশে ধরিয়ে দেবে।

না, না,পাগল! আর ওমুখো হই আমি? এই বেশ আছি।

হ্যাঁ, মিঃ রিচার্ডসনের বাড়ি থেকেও কেউ আমার পিছু নিতে পারে। একটা সুবিধামতো আস্তানা আমায় নিতেই হবে।

এই মেনী, ওকি তুই কোথায় গেলি?

যাকগে খুশি যেখানে। আমি তো উঠি।

এদিকে তো দেখছি আরও কয়েকটা বেশ ঝাঁকড়া মতো ঝোপ রয়েছে। না বাপু ঝোপের ভেতর নয় - দেখি না পার্কের চারপাশটা ঘুরে। ও বাবা, চৌকিদার না আবার দেখে ফেলে!

সরে গিয়ে গাছের ছায়ায় ছায়ায় হাঁটাই ভাল।
...ওপাশে আবার ওগুলো কি দেখা যাচ্ছে....
....বাঃ জলের পাইপ মনে হচ্ছে। পরপর সার দিয়ে রেখেছে.... ওহ, ভালোই হল...হ্যাঁ, দিব্যি গলে গিয়ে ভেতরে শুয়ে থাকা যাবে। কেউ দেখতেই পাবে না বাইরে থেকে। ওই তো সামনের দিকেই গায়ে গায়ে লাগানো ঝাঁকড়া ঝোপ কয়েকটা।

এই ভাল হয়েছে....মিঃ রিচার্ডসন বা তাঁর লোকজন অথবা ডক্টর হেনরী কেউই আর খুঁজে পাবে না আমায়।
....ওমা! মেনী তুই দেখছি এখানেও চলে এসেছিস। কোথায় গিয়েছিলিস এতক্ষণ? আমি আবার খুঁজলাম কতক্ষণ। ভালোই হল - দেখ এখানে থাকব এখান থেকে - তুই কিন্তু আবার গুল মেরে দিস না বাপু। থাকিস কাছাকাছি। বসে থাক এখানটায়। আমি এই পাইপটার পেটের ভেতর খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিই।
..........আঃ! কি শান্তি!

বুকটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল!

রক্তের স্বাদ কি মিষ্টি।

উমহ! ঠোঁটেও অনেকটা লেগে রয়েছে।

বাচ্চাটার বাপ-মা বোধহয় এতক্ষণে ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়েছে। বেরোক। আমাকে তো আর পাবে না। কেউই পাবে না - কেউ দেখতেই পায়নি কখন নিঃসাড়ে পাইপের পেটের ভেতর ঢুকে পড়েছি!

কিন্তু কাল তো আর পার্কে কোনো মা তার বাচ্চাকে ছেড়ে রাখবে না।

সবাই সতর্ক হয়ে যাবে।

নাঃ! কাল আর পার্কে নয় বাপু।

আশপাশে বেরোতে হচ্ছে।

একবার অন্তত খানিকটা রক্ত গলায় দিতে না পারলে গলাটা শুকিয়ে কেমন কাঠ হয়ে যায় যে।

কাল এদিককার কোনো পাড়ায় খুঁজে দেখতে হবে - শিকার ঠিক পেয়ে যাব।

আঃ! আজ রাতটা কি আনন্দের!

সন্ধ্যারাতেই বেশ খানিকটা টাটকা তাজা রক্ত গিলতে পেরেছি।

বাচ্চাটার মা-বাপ টেরও পায়নি কখন ওদের ঘরে ঢুকে খাটের তলায় লুকিয়ে ছিলাম।

ওরা খাবার ঘরে চলে যেতেই....

রোমকূপগুলো পর্যন্ত যেন আজ আনন্দে নাচছে। গাছগুলোর মাথায় মাথায় আবছা অন্ধকারে গুটিসুটি মেরে বসে কারা যেন আমায় দেখে হাসছে মনে হচ্ছে......

ঝোপগুলো অমন লকলক করে জিভ বার করছে কেন? নাকি হাসছে?

হাওয়াও কেমন খুশির চোটে থেকে থেকে গুঙিয়ে উঠছে দেখ।

আমিও খুশি বাপু।

আজ ভরপেট রক্ত গিলেছি।

মেনীটা কোথায়? ওই বাড়ি পর্যন্ত তো সামনে সামনে গিয়েছিল।

ওই তো - কেমন জিভ দিয়ে থাবা চাটছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে দেখ।

যেন খিলখিল করে হাসছে।

খুব মজা না - ল্যাজ চুমড়ে মিউ মিউ করা হচ্ছে আবার।

নাঃ। অনেকক্ষণ বসে আছি ঝিলের এপাশটায়।

অনেক রাতও হল - এবার উঠে পড়া যাক।

আগামীকাল সারা দিনটা আর বেরোব না।

আবার সেই সন্ধ্যার পর।

বাগানের চৌকিদারের ঘরে একটা বাচ্চা আছে দেখতেই পেয়েছি -

বেশ নাদুসনুদুস।

সুযোগ বুঝে ঢুকতে হবে ঘরে। তবে পার্কের লোকজন কমে এলে, তার আগে নয়।
....ওকি....ওপাশের গাছতলায় বেঞ্চিটার ওপর....
....আরে একটা মানুষ তো....
....দিব্যি বসে আছে যে.....
....ও কি আমায় দেখতে পেয়েছে মনে হচ্ছে....এগিয়ে আসছে যে....এতরাতে পার্কে কে ওই লোকটা?

মাথায় টুপি না থাকলে মুখের আদলটা দেখা যেত....চিনতে পারতাম।

কে লোকটা?

ওকি! লোকটা এগিয়ে আসছে মনে হচ্ছে!

আমি পিছিয়ে পড়ি। এখুনি ঝোপের আড়াল নিয়ে পাইপের আস্তানায় ঢুকে পড়তে হবে।

নইলে ধরা পড়ে যাব!

একবার ধরা পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই।
....আরে....মেনী....তুই!

ভালোই হল মেনী লোকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে....

এই সুযোগে আমি গা ঢাকা দিই।

বাপরে!

***********************************************************

ঢং... ঢং.... ঢং

গীর্জার ঘড়িতে রাত তিনটে ঘোষণা হল।

নিঝুম নিস্তব্ধ চারদিক।

সন্ধ্যার কলরব-চঞ্চল পার্কটা যেন গা মেলে দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

এপাশ ওপাশের উঁচু গাছের ডালে মাঝেমাঝে দু-একটা পাখির ডানা ঝটাপটি। শব্দ উঠছে কেবল।

সেই শব্দে মনে হচ্ছে যেন আড়মোড়া ভাঙছে।

হঠাৎ একটা প্যাঁচা কর্কশ চিৎকারে চারদিক সচকিত করে কোন দিকে উড়ে গেল।

আজ পার্কের দুপাশে দুজন।

গতরাতে যে জায়গায় নিশাচরীকে দেখা গিয়েছিল - সে জায়গাটাকে মাঝখানে রেখে ডক্টর হেনরী এবং ফাদার দু'পাশে দুটি ঝোপের পাশে আড়াল নিয়েছেন।

আকাশে একফালি বাঁকা চাঁদ।

তারই ফিকে আলোয় যতটুকু সম্ভব নিজেদের চারপাশে সতর্ক সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে দেখবার চেষ্টা করছেন।

নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই দুজন দুপাশে এভাবে বসেছেন।

গোটা রাত একইভাবে মসৃণ নিস্তব্ধতায় গড়িয়ে যেতে লাগল!

দুজন দুপাশে যেভাবে বসেছিলেন সেভাবেই বসে থেকেছেন।

কেবল চঞ্চল সন্ধানী দৃষ্টি এপাশে ওপাশে নাড়াচাড়া করেছেন।

কিন্তু বসে থাকাই সার হল।

যার সন্ধানে এই বিনিদ্র রজনী যাপন তার আভাস কারোরই চোখে পড়ল না।

রাতের শেষ প্রহর ঘোষণা করে যখন গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলি জেগে উঠল ধীরেধীরে দুজনে উঠে দাঁড়ালেন।

পায়ে পায়ে ডক্টর হেনরী এগিয়ে এলেন ফাদারের দিকে।

ফাদার তাঁর নিয়মিত প্রভাতী প্রার্থনা নির্জন পার্কের ঘাসের আসনে বসেই সমাধা করে নিয়েছেন ততক্ষণে।

ডক্টর হেনরী এগিয়ে আসতে তাঁকে প্রভাতী অভিবাদন জানালেন ফাদার।

প্রত্যভিবাদন জানিয়ে ডক্টর হেনরী এসে বসলেন তার পাশে।

".....কিছু অনুমান করতে পারছেন ফাদার?"

".....ভাবছি"।

".......গতরাতে আমি ওর নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে সে কারণেই সে পার্ক ছেড়ে অন্য কোথাও আস্তানা নিয়েছে "।

"......অসম্ভব নয়। সন্ধ্যারাতে মিঃ পার্কারের বাড়িতে তো হানা দিয়েছিল। হয়তো ওপাশেই কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে - রাতে আর পার্কে আসেনি। নিরাপদে আত্মগোপন করে থাকবার মতো আস্তানা তো দরকার"।

".....ব্যারিয়াল গ্রাউন্ডের পাশেই তো মিঃ পার্কারের বাড়ি। তাহলে তো কবরভূমিতেই ঢুকে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে"।

".....যেখানেই যাক - আশপাশেই থাকবে নিশ্চয় কিছুদিন। আমাকে হাল ছাড়লে চলবে না। ড্রাকুলা এক দুরন্ত পিশাচ - জ্যান্ত মানুষকে দেখতে দেখতে পিশাচে পরিণত করে। যখন তাকে দিয়ে কাজ হাসিল হচ্ছে না মনে করবে - নির্মম ভাবে শেষ করে দেবে। মেয়েটির কি নাম যেন - লরা....হ্যাঁ খুব স্বচ্ছন্দে এখানে পিশাচের রক্ততৃষ্ণা মেটাবার সুযোগ নেই তার। লুকিয়ে থাকতে চেষ্টা করলেও বেশী দিন পারবে না। একসময় আপনা থেকেই তাকে শোচনীয় মৃত্যু বরণ করতে হবে কিন্তু তার আগেই তাকে নাগালে পাওয়া দরকার আমাদের"।

"......কবরের আশেপাশে নজর রাখা যেতে পারে আজকের রাতে"।

".....এভাবে কত রাত জেগে থাকবেন আপনি?"

".....ফাদার, মুমুর্ষু রোগীর পাশে রাতের পর রাত আমাকে জেগে থাকতে হয় অনেক সময়। লরার সন্ধানে না হয় সে ভাবেই রাত জাগব। তার অবস্থান যখন অনিশ্চিত তখন এছাড়া তো আর উপায় দেখছি না"।

উঠে দাঁড়ালেন এবার দুজনে।

নিঃশব্দে পাশাপাশি হেঁটে বেরিয়ে এলেন পার্কের বাইরে।

**************************************:***********;***::::

পরপর আরও দুটো ঘটনা ঘটল এরপর।

পার্কের চৌকিদারের বাচ্চা ছেলেটিকে এক রাতে নটা নাগাদ প্রায় নির্জন পার্কের এক কোণে ঝোপের আড়ালে পাওয়া গেল।

বাচ্চাটিকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে মা বাবা দুজনেই লোকজন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল চারপাশে।

সেইসময় অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়।

কিন্তু কে যে কখন কিভাবে শিশুটিকে ঘর থেকে নিয়ে এসেছে কেউ বুঝতে পারেনি।

এ ঘটনার পর থেকেই শহরময় ড্রাকুলার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।

খবরের কাগজে শিশুটির ছবিসহ রিপোর্ট প্রকাশ পেল।

কিন্তু শহরবাসীকে চমকে দিয়ে পরদিনই ঘটল একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

ঘটনাস্থল মিঃ পার্কারের পাশের বাড়ি।

এবারে রীতিমতো চাঞ্চল্য জাগল।

পাশাপাশি দুটি বাড়িতে দু'দিনের ব্যবধানে ঘটেছে ড্রাকুলার ভয়াবহ আবির্ভাব।

ডক্টর হেনরী অস্থির হয়ে পড়লেন।

এদিকে প্রকাশ্যে লরার সন্ধানও তিনি নেবার চেষ্টা বজায় রাখলেন। কিন্তু শত অনুসন্ধানেও তার কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি।

ফাদারের কথার পর অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন এভাবে লরা'কে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

লরা এখন আর মানুষ নেই।

মানুষের শরীরে সে এখন জীবন্ত পিশাচী। রাতের অন্ধকারে সে তার গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে চোখের আড়ালে নররক্ত পান করে চলেছে।

সেদিন ফাদার নিজেই বিকেলে চলে এলেন ডক্টর হেনরীর চেম্বারে।

রোগীর ভিড় ছিল না সেদিন।

দু-চারজন যারা বসেছিল তাদের একে একে বিদায় করে দিয়ে দুজনে চলে এলেন পার্কের একটা নিরিবিলি কোণে।

ডক্টর বললেন, "ফাদার, যা অবস্থা শুরু হয়েছে, কাজটা আমাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে মনে হচ্ছে কিছু করে ওঠা সম্ভব হবে না। লরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে "।

".....কিন্তু ডক্টর, রহস্যটা সাধারণ মানুষ বিশেষ জানে না। তারা ড্রাকুলার আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে আছে। আত্মরক্ষার বাইরে তাদের দিয়ে বিশেষ কোনো সাহায্য পাবার আশা দুরাশা। ঘরের কোণ ছেড়ে পুলিশই বলুন আর সাধারণ নাগরিকই বলুন, ড্রাকুলার পিছু নেওয়ার সাহস কারোরই হবে না। যা করবার আমাদের দুজনকেই করতে হবে এবং গোপনীয়তা বজায় রেখেই"।

".....তা না হয় হল, লরাকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে তা তো বুঝতে পারছি না। তবে আজ রাতে আমি ঠিক করেছি এই পার্কেই টহল দিয়ে বেড়াব"।

".....একথা বলবার জন্যেই আমি এসেছি ডক্টর। আজ একটা বিশেষ ব্যবস্থা নেব। যদি পার্কের কোথাও সে আত্মগোপন করে থাকে তবে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে"।

ডক্টর হেনরী এ কথায় উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন, " এরকম কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন - এটাই আশা করেছিলাম, ফাদার। তাহলে কখন আমায় আসতে হবে?"

ফাদার বললেন, " সেদিনের মতো রাত এগারোটার পরে এলেই তো মনে হয় সুবিধে - পার্কের চৌকিদারের কোয়ার্টারের আলোও জ্বলে না তখন"।

পূর্বব্যবস্থা মতো রাত এগারোটাতেই দুজনে এসে মিলিত হলেন পার্কের দক্ষিণ দিকে।

ফাদারের হাতে একটা ছোট পুঁটলি। সেটা বেঞ্চিতে নামিয়ে রেখে বসলেন ডক্টর হেনরীর পাশে।

ফাদার বললেন, " ডক্টর, লক্ষ্য করুন তো বাতাস কোনদিকে বইছে?"

ডক্টর হেনরী কথাটা শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকালেন ফাদারের দিকে।

ফাদার বললেন, " হাওয়ার গতিটা সঠিকভাবে জানা ডরকার। গুগগুল আর ধুনো জ্বালতে হবে। এবং পোড়া গুগগুলের গন্ধ যাতে গোটা পার্কে ছড়িয়ে পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। অশুভ আত্মা গুগগুলের পবিত্র ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না। লরা যেখানেই আত্মগোপন করে থাকুক না কেন, এই পার্কের কোন দিকে থাকলে আর গুগগুলের গন্ধ তার নাকে একবার ঠেকলে তার গায়ে জ্বালা ধরে যাবে। বেরিয়ে না এসে পারবে না। আমি গুগগুল আর ধুনো নিয়ে এসেছি। যে দিক অভিমুখে হাওয়া বইছে, সেই দিক অভিমুখে জ্বালাতে হবে।"

ডক্টর হেনরী উৎসাহে ঔৎসুক্যে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হাওয়ার গতি অনুভব করে বললেন, "মনে হচ্ছে আমরা ঠিক জায়গাতেই বসেছি, ফাদার। হাওয়া উত্তরে বইছে"।

"......আমারও তাই মনে হচ্ছে। বেশ ভারী হাওয়া - সামান্য কুয়াশা রয়েছে যেন"।

".....হ্যাঁ। তাতে অসুবিধা হবে?"

"......বিশেষ না। গন্ধটা এগোবে মন্থর গতিতে। আমাদের সুবিধাও হবে তাতে। অন্ধকারে চারদিকটা ধীরেসুস্থে দেখে নেবার সময় পাব। বসুন এখানে। রাতটা আরও একটু বাড়ুক"।

( সমাপ্ত)

Address

Dhaka

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Paranormal Society BDS posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Paranormal Society BDS:

Share

Category