27/08/2025
মানসিক অত্যাচারের অপর নাম অপরাধ বোধে ভোগানো।
।
অন্যকে অপরাধ বোধে ভুগিয়ে স্বার্থ হাসিল করার কৌশলকে বলা হয় ‘গিল্ট ট্রিপ’।
মানসিক অত্যাচারের অপর নাম অপরাধ বোধে ভোগানো
খেয়াল করেছেন কী, কিছু লোক কখনই নিজে ভুল স্বীকার করতে চায় না। উল্টো অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চায় নির্দোষ।
এই কাজ সাধারণত ‘নার্সিসিস্ট’ বা আত্মমগ্ন মানুষরা করে থাকেন। তারা অন্যের ঘাড়ে দোষ ফেলে নিজের দুর্বলতা ঢাকতে চায়। আর অন্যকে অপরাধ বোধে ভুগিয়ে ফয়দা লুটের চেষ্টা চালায়।
অন্যকে অপরাধ বোধে ভোগানোর এই প্রক্রিয়াকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘গিল্ট ট্রিপিং’।
এই তথ্য জানিয়ে ‘ভেরিওয়েলমাইন্ড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মার্কিন মনোবিজ্ঞানী কেন্ড্রা চেরি বলেন, “অন্যকে ‘গিল্ট ট্রিপ’ বা অপরাধ বোধে ভোগানোর মাধ্যমে তার দায়িত্ব পরিবর্তন বা অন্যের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কারণে সুবিধা আদায় করে নেওয়া হয়। কারণ অপরাধ বোধ এমন একটি শক্তিশালী অনুভূতি, যেটার মাধ্যমে একজন মানুষের চিন্তা, অনুভব ও স্বভাব পরিবর্তন করে ফেলা যায়।”
যে কারও কাছ থেকেই এই আচরণ পাওয়া যেতে পারে। তবে মজার বিষয় হল বেশিরভাগ সময় ‘গিল্ট ট্রিপিং’ বিষয়টা ঘটে, কাছের মানুষের মাধ্যমে।
ধরা যাক- আজকে সঙ্গীর সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে। তবে হঠাৎ করেই পারিবারিক কোনো কারণে আটকে গেলেন; হতে পারে সেটা কারও অসুস্থতা বা জরুরি কোনো বিল দেওয়া।
এই কথা সঙ্গীকে জানানোর পর, তার উত্তর হল- ‘ঠিকা আছে ব্যাপার না, আমার জন্য তো তোমার সময় হয় না, ব্যস্ততা তোমাকে ঘিরেই থাকে। বরং আমি একাই কফি খেয়ে আসবো’।
আবার পারিবারিকভাবেও ‘গিল্ট ট্রিপ’ হতে পারে। যেমন- কোনো অভিভাবক যদি তার সন্তানকে বলে- ‘এতগুলো বছর আমি তোমার জন্য এত কিছু করলাম, আর তুমি একটা এই কাজটা আমার জন্য করতে পারবে না!’
এই ধরনের কথাগুলো একজন মানুষের মনে অপরাধ বোধ জাগিয়ে তোলে। ফলে সে ওই ‘কাজটা’ করার জন্য মরিয়া হয়ে যায়; নিজেকে প্রমাণ করতে চায়- সে ওরকম না। আর এখান থেকেই শুরু হয় মানসিক চাপ।
‘গিল্ট ট্রিপিং’য়ের লক্ষণ
‘টকইয়োরহার্টআউট ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ‘গিল্ট ট্রিপিং’য়ের বেশ কয়েকটি লক্ষণ সম্পর্কে জানানো হয়।
সরাসরি মন্তব্য করে বা ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া আপনি দোষী।
ব্যাঙ্গ করার মাধ্যমে অন্যকে নিচু বোধ করানো।
অস্পষ্ট বা ব্যাখ্যাহীন আচরণ অথবা মন্তব্য।
কথা বা আচরণের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে আক্রমণ করা, বা ঝগড়া।
মনে করিয়ে দেওয়া আপনি তাদের অনুগ্রহ করতে বাধ্য।
বার বার মনে করিয়ে দেওয়া, তারা আপনার জন্য বহু কিছু করেছে, কিন্তু আপনি তাদের জন্য কিছুই করেননি।
অতীতের ভুলগুলোর তালিকা তৈরি করে রাখা, আর সময় সুযোগ পেলেই সেগুলো শোনানো।
পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেওয়া কোনো সমস্যা আছে, তবে মুখে সরাসরি কিছু না বলে চুপ থাকা বা যোগাযোগ করতে অসম্মতি প্রকাশ।
নির্দিষ্ট বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে এড়িয়ে যাওয়া।
সম্পর্ক বা অবস্থা উন্নতির জন্য আগ্রহ না দেখানো বা যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া।
শাস্তি দেওয়ার জন্য যোগাযোগ বন্ধ করা বা স্নেহ মমতা প্রকাশ না করা।
যেভাবে ‘গিল্ট ট্রিপ’ বন্ধ করা যায়
কেন্ড্রা চেরি বলেন, “নানান কৌশলেই এই অবস্থা থেকে বের হওয়া সম্ভব। শুধু দরকার সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ। যেমন-
গুরুত্ব দেওয়া: যে এমন করছে তাকে জানান, সে আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। উপপেক্ষা না করে তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে তাকে ভালো বোধ করানোর চেষ্টা করতে হবে। তার বা তাদের অনুভূতির মূল্য দেওয়ার মাধ্যমে এই আচরণ বন্ধ করা যায়।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ: এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, ‘আমাকে অপরাধ বোধে ভুগিয়ে যেটা করাতে চাও, সেটা না হয় করলাম। কিন্তু এই ধরনের কৌশল খাটিয়ে তোমার মধ্যে কেমন বোধ হচ্ছে।’
এভাবে বলার মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে- তার আচরণ পরিবর্তন করা উচিত। আর ঘুরিয়ে নয়, বরং সরাসরি কথা বললেই ভালো প্রভাব পড়বে।
সীমারেখা টানা: সীমানা টানার মাধ্যমে নিজে কী গ্রহণ করবেন, আর কী করবেন না- সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। পাশাপাশি সীমা টানার পরও যদি তাদের কথায় কিছু করতে হয়, তবে পরিষ্কার-ভাবে জানিয়ে দিতে হবে, সীমার বাইরে গিয়ে কোনো কিছু করার খেসারত তাদেরকে দিতে হবে।
অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে আছে- আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে এই ধরনের মানুষ থেকে দূরে থাকা। যদি ইতিমধ্যেই নিজের মধ্যে বাজে অনুভূতি চলতে থাকে, তবে ‘গ্লিট ট্রিপ’য়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তেই থাকবে।
যদি অন্যজন সুবিধা গ্রহণের জন্য সবসময় আপনার মধ্যে অপরাধ বোধ জাগানোর জন্য কাজ করে যায় তবে তার সঙ্গে যোগাযোগ কম করাই হবে ভালো উপায়। এমনকি এই ক্ষেত্রে সম্পর্ক ভঙ্গ করাও হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
যদি অন্যকে ‘গিল্ট টিপ’ করেন
“এবার নিজেকে নিয়ে ভাবুন” বলেন কান্ড্রা চেরি, “আচ্ছা বলুন তো আপনি নিজে কি অন্যকে অপরাধ বোধে ভোগাচ্ছেন?”
এই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “অনেক সময় নিজের অজান্তেই হয়ত অন্যকে এই অবস্থায় ফেলছি। আর এর জন্য প্রয়োজন সচেতন হওয়া।”
“অসচেতন থাকলে অন্যকে ‘গ্লিট ট্রিপ’য়ে ফেলতেই পারেন। আর সেটা হয়ত নিজে উপলব্ধি করতে পারছেন না”- বলেন এই মনোসামাজিক পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ।
তাই প্রথমে নিজের ভেতরের লক্ষণগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। পরেরবার যদি কাউকে অপরাধ বোধে ভোগাতে চান, তবে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘এই কাজ করার মাধ্যমে আমি কী পেতে চাইছি?
চেরি ব্যাখ্যা করেন, “যেমন- আপনি হয়ত কারও সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতে চান। এই ক্ষেত্রে ‘গিল্ট ট্রিপ’-ধর্মী কথাটা হবে এরকম- ‘আমি তো সবসময় তোমার অনুরোধ রাখি। তোমার কি মনে হয় না এবার অন্তত আমার দিকটা দেখা উচিত।”
বরং এর পরিবর্তে এমনভাবে অনুরোধ করতে হবে, যাতে তার মধ্যে অপরাধ বোধ না জাগে।
যেমন- ‘আমি সিনেমাটা দেখবো বলে পরিকল্পনা করছি। আর তোমার সঙ্গ পেলে আমার আরও ভালো লাগবে। চল আমরা একসঙ্গে যাই’।
যদি ‘গিল্ট ট্রিপ’ করা স্বভাবে দাঁড়িয়ে যায়, তবে এর থেকে বেরিয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগবে।
অন্যভাবে কথা বলা, কাউকে দোষ না দিয়ে বা অপরাধ বোধে না ভুগিয়ে যোগাযোগ করার মতো বিষয়টা আয়ত্তে আনতে একটু হলেও কষ্ট করতে হবে।
আর মনে রাখতে হবে- কোথাও না কোথাও হতে শুরু করতে হয়। ‘বেটার লেট দেন নেভার’ মানে- একেবারে না করার চেয়ে দেরিতে হলেও করা ভালো