18/07/2022
Taki Hasan Rafi (EEE'38, AUST)
Graduate Researcher, Data Intelligence Lab,
PhD Student, Hanyang University.
Incoming Visiting Researcher, Samsung Electronics Headquarters, South Korea.
আমি যখন আহসানুল্লাহ-তে পড়তাম, আমার বাবা-মা সবসময় বলতেন, "বাবা, তুমি কোনোমতে পাশ করতে পারলেই খুশি, কারণ আমরা জানি ইঞ্জিনিয়ারিং অনেক কঠিন"। আমি যত ক্লিয়ারেন্স/ক্যারি দিতাম সব আমার মা জানতো। ইভেন তারা জিজ্ঞাস না করলেও আমি আমার সিজিপিএ বলতাম।
আমার বাবা-মা এতেই খুশি থাকতো, কারণ আমি পাশ করে এক সেমিস্টার থেকে আরেক সেমিস্টারে উঠি। "এত কম সিজিপিএ কেনো পেয়েছো?", "কেনো ক্লিয়ারেন্স খেয়েছো?" এগুলা কখনো জিজ্ঞেস করতেন না (যদিও ২.১~৪.২ পর্যন্ত কোনো ক্লিয়ারেন্স খাইনি)। শুধু এটা বলতো, "বাবা ক্লিয়ারেন্সে পাশ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আমরা জানি বিষয়টা কঠিন"।
শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফ না, স্কুল-কলেজ লাইফেও আমাকে কখনই অমুক-তমুকের সাথে তুলনা দেন নাই আমার মা-বাবা। আমি বরাবরই এভারেজ ছাত্র ছিলাম। তবে ক্লাস-টু-ক্লাস পাশ করে ফেলতাম। ফলে জীবনেও একাডেমিক গ্যাপের সম্মুখীন হতে হয় নাই। স্কুলের ভালো ছাত্রদের আমার আম্মা খুব আদর করতেন, কিন্তু আমাকে কখনই প্রেশার দিতেন না আমি কেনো ওদের মতো ভালো করি না।
এইচএসসিতে আমার রেজাল্ট সামান্য একটু এদিক সেদিক হয়। আমি ভাবলাম আমার বাবা-মা কষ্ট পাবেন। উলটা রেজাল্টের দিন তারা আমাকে সান্ত্বনা দিলো "বাবা তুমি অনেক ভালো করেছো, আমরা অনেক খুশি"। জীবনেও বুঝতে দেন নাই তারা আপসেট ফিল করেছেন। এটা কোনোদিনই বলেননি, "গোল্ডেনটা মিস হলো কেনো?"। আমি বিশ্বাস করি, সেদিন ফেল করে আসলেও আমাকে তারা অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যেতেন।
তারপর, আহসানুল্লাহ লাইফের ৪র্থ বর্ষের শুরুর দিকে ব্যাচের সবার আগে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি অফার পাই। তখন মাত্র ২.৭৬/৪.০০ সিজিপিএ সাথে ২ টা ক্যারি ওয়ালা ব্যাকব্যাঞ্চার আমি। কোরিয়াসহ মোট ৬ টি ফুল-ফান্ডেড পিএইচডি ও মাস্টার্স অফার পাই এই রেজাল্ট নিয়ে তাও চতুর্থ বর্ষে, গ্রাজুয়েশন এর মেলা আগে। অবিশ্বাস্য হলেও, কঠোর পরিশ্রম, প্রবল ইচ্ছার কারণে আমি সকল ব্যর্থতাকে ছাপিয়ে এসব কিছু অর্জন করি। আমি মনে হয় বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি যে, পিএইচডি অফার হাতে নিয়ে নিয়ে ক্যারি পরীক্ষা দেই।
তারপর পিএইচডি যখন শুরু করি, জীবনে প্রথম বারের মতো আমি নিজ বাসার গন্ডি থেকে বের হই। বাসার গন্ডি থেকে সরাসরি আরেক দেশ। একটা ওয়াইল্ড জার্নি। কারণ গ্রাজুয়েশন এর আগ পর্যন্ত মা-বাবার আশ্রয়স্থলে ছিলাম।
পিএইচডি শুরু করার পর বুঝলাম, লাইফ ভীষণ কঠিন। ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফ থেকে যোজন যোজন গুণ কঠিন। গবেষণার প্রেশার, একাডেমিক কোর্সওয়ার্কের প্রেশার, সাথে পারসোনাল লাইফ যেমন রান্না-বান্না, ঘর সামলানো। সবকিছু জানি আমাকে প্রতিদিন গ্রাস করতো। এসময়েও বাবা-মা অশেষ অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এ বছরের শেষে, আমি স্যামসাং এর হেডকোয়ার্টার এ পিএইচডি গবেষণার জন্য যোগদান করছি ডিভাইস সলিউশান দলের সাথে। এক্সপ্লেইনেবল এআই-র মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টর প্রসেস ও ফেইলিউর এনালাইসিস নিয়ে পরবর্তী ৩ বছর গবেষণা করবো।
সবকিছুর উর্দ্ধে, স্যামসাং এ যোগদান ও পিএইচডি গবেষণা আমার মা-বাবাকে উৎসর্গ করলাম। কারণ জীবনের প্রত্যকটি ব্যর্থতার দিনে সেই ছোটবেলা থেকে এইবেলা পর্যন্ত অতুলনীয় এক অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। আমি জানি ভবিষ্যতের যেকোনো ব্যর্থতার দিনেও তারা পাশে থাকবেন। হয়তবা মা-বাবা সেই ছোটবেলায় আমাকে এক্সপেকটেশনের বারে ঝুলিয়ে দিলে অনেক আগে হারিয়ে যেতাম। এতদূর আসা হতোনা। তাদের একমাত্র দোয়া, ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, সাহসে আজ এখানটায় আসা।
তারা হয়তবা আগেই জেনে গিয়েছিলেন, সকল ব্যর্থতা শেষে আমি ভবিষ্যতে একদিন ভালো করবো। এবং তাই হচ্ছে। আমিও তাদেরকে নিরাশ করিনি। ব্যাচের সবার আগে পিএইচডি শুরু করি, সাথে স্যামসাং এর হেডকোয়ার্টার এও গবেষণার পদে যোগদান করছি। আমার জীবনে অনেক ইচ্ছে ছিলো, আমি বিশ্বসেরা কোম্পানির জন্য গবেষণা করবো। এবং আমি তাই পারলাম, সেই ২.৭৬ সিজিপিএ-র আমি, শেষমেশ পেরেই ফেললাম।
আমি মনে করি "ভালোকিছু করবো" এই মানসিকতাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবনে। রেজাল্ট যেমনই হতো ছোটবেলা থেকেই আমার মাথায় ঘুরতো যে আমি ভালো করবো। এখনকার ছেলেমেয়েরা একটু খারাপ রেজাল্ট হলেও খুব হতাশায় ভুগে। তবে এখান থেকে লড়াই শুরু। একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি, ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্রদের একটা স্কিলসেটে মনোনিবেশ করতে হবে।
আমার ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফে এমন অনেক দিন ছিলো, আমি ল্যাব ভাইবাতে পুরো সেকশনে একাই শূন্য পেয়েছি। বাকি সবাই মোটামুটি ভালো করেছে। ৩য় বর্ষের ম্যাটল্যাবের কোর্সে পুরো ব্যাচের মধ্যে লোয়েস্ট গ্রেড (D) নিয়ে পাশ করা লোকটা আমি। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফের এমন এক সেমিস্টার ছিলো যেখানে আমি ২.৩৭ সিজি নিয়ে ড্রপ খাওয়া বাচাঁই। জীবনের এমন অনেক সেমিস্টার ফাইনাল ছিলো যেখানে ব্যাচমেটদের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনায়, আমার তাকায় থাকা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা। আমি আমার সর্বশেষ ব্যাকলগ পরীক্ষা দেই ৪.২ এর লাস্টে। তবে এতকিছুর পড়েও মন খারাপ করি নি। হতাশা আমার গ্রাস করতে "চাইতো", তবে এই হতাশাকে কখনই আমার কাছে আসতে দেইনি।
মনে রাখতে হবে, রেজাল্ট যেমনই হোক, ব্যাকলগ যতগুলাই থাকুক, জীবনে যতগুলা ড্রপ থাকুক, তোমার জীবনে সুযোগ আছেই। তোমার রেজাল্ট যতটুক, তোমার স্কিল যতটুক ওটা নিয়েই ক্যারিয়ার প্লান করতে হবে। ভালো রেজাল্ট মানেই জীবনে ভালো করবা, খারাপ রেজাল্ট মানেই জীবন শেষ এমন কিছুই না। আমি জীবনেও ক্লাসে ফার্স্ট হইনি, ইভেন টপ প্লেস ও করিনি, তাও সবার থেকে ভালো করলাম।
কিভাবে? কারণ হেরে যাওয়ার জন্য কাউকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়নি।
আমার ইচ্ছা পিএইচডি-র পর বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করা। তার জন্যেই পিএইচডি করতে আসা। এখানে গবেষণার একটা ভালো ট্রেনিং পাচ্ছি। আশা করি ভালোমানের একজন গবেষক হিসেবে এই জার্নি শেষ করতে পারবো। ইনশাআল্লাহ, হয়তবা কোনো একদিন আমার বাবা-মা কে এটা বলার সুযোগ করে দিবো,
আমাদের ছেলে একজন বড় বিজ্ঞানী....
ওইদিনের অপেক্ষায়...