20/10/2025
অফিস থেকে বাসায় ফিরে বেল বাজাতেই সেঁজুতি বেজার মুখে দরজা খুলল। "কী ব্যাপার, মুড অফ নাকি?" জিজ্ঞেস করলেও তার উত্তর না দিয়ে রুমে চলে গেল। সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল আমার মেয়ে দোলা। সে ফিসফিস করে বলল, "সজীব ভাইয়া এসেছে।"
বুঝলাম এই হচ্ছে ওর মার মুড খারাপ হওয়ার কারণ। সত্যি বলতে, আমি নিজেও একটু বিরক্ত হলাম। এভাবে না বলে বাসায় চলে আসার মানে কী! বিশেষ করে যখন আমি বাসায় নেই। একটা ফোন করে তো আসবে। আর ওর আসা মানেই টাকা লাগবে, হয়তো ওর মা দিচ্ছে না।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম। সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সজীব। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতেই মনটা কেমন করে উঠল। মুখটা একদম শুকিয়ে আছে। বাতাসে ঘামের চাপা গন্ধ, হয়তো বাসে চড়ে এসেছে। আমাকে দেখে সালাম দিয়ে একটু নড়ে চড়ে বসল।
সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, "কখন এসেছ সজীব?"
"আধা ঘণ্টা হবে বাবা। ভেবেছিলাম এই সময় তুমি চলে আস।"
"হ্যাঁ, আজ একটু দেরি হয়ে গেল ফিরতে, একটা মিটিং ছিল।"
"কিছু খেয়েছ?" জিজ্ঞেস করে নিজেই বিব্রতবোধ করলাম। কিছু দিলে তো টেবিলেই থাকত। তাছাড়া আমি না বললে সেঁজুতি এক কাপ চাও দিতে চায় না ওরা আসলে।
পর্দার নিচ দিয়ে দোলার পা দেখা যাচ্ছে। আড়ি পেতে কথা শোনে নাকি! এই বয়সে এই স্বভাব!
জোরে ডাকলাম, "দোলা, ভাইয়ের জন্য পানি আর নাস্তা নিয়ে এসো, যাও।"
পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝলাম দোলা দৌড়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর একটা ট্রেতে এক গ্লাস পানি আর কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসল। ছেলেটা সাথে সাথে গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে পানি শেষ করে ফেলল। দেখে বুঝাই যাচ্ছে, খুব পিপাসা পেয়েছিল। ভূতের গলি থেকে গুলশান কম দূরত্ব তো নয়। সরাসরি বাসও তো নেই। নিশ্চয়ই বাসা থেকে ফার্মগেট থেকে বনানী এসে আবার সেখান থেকে রিক্সায় বা হেঁটে এসেছে। দোলাকে বললাম, আরেক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। নাস্তার কথা আর বললাম না, সেধে ছেলের সামনে আর অপমান হতে চাই না।
"তোমরা সবাই কেমন আছ? সায়রা ভালো আছে? ওর সাথে অনেকদিন কথা হয় না।"
"সায়রা ভালো আছে বাবা, এইচএসসি পরীক্ষা সামনে। চাপে আছে। তুমিও তো ফোন করো না।"
ঠিক! আমিও তো ফোন করি না। খুব একটা মনেও হয় না আসলে। সায়রার সাথে থাকলে সে কি নিত্যনতুন বায়না করত আমার কাছে, দোলার মতো? সেদিনও একটা নতুন জামা কিনে দিলাম তাকে, সাথে অ্যাক্রেলিক কালার সেট। সায়রাও খুব ভালো ছবি আঁকে, সে কি আর্টের জিনিসপত্র মনমতো কিনতে পারে? শখ হলেই একটা জামা কিনতে পারে? ওর মা খুব বেশি আয় তো করে না। হয়তো অনেক শখই মেটাতে পারে না। সজীবের হাতে ওর জন্য কিছু টাকা দিয়ে দেবো ভাবলাম।
হঠাৎ দেখি, সজীব কাঁদছে, ওর পুরো গা কাঁপছে। এর মধ্যে দোলা এসে আরেক গ্লাস পানি দিয়ে গেছে। ওকে পানি দিতে গেলে না করল। আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম, "কী হয়েছে বাবা, বলো।"
"মা কেমন আছে জিজ্ঞেস করবে না বাবা?"
শারমিন! শারমিনের কথা তো আমি কখনোই জিজ্ঞেস করি না। প্রাক্তনের কথা জিজ্ঞেস করা কি উচিত? অবশ্য ভদ্রতা করে ওদের মা কেমন আছে, তা তো জিজ্ঞেস করাই যায়। সেই ভদ্রতাটুকু অবশ্য আমি কখনো করিনি।
"তোমার মায়ের কিছু হয়েছে সজীব।"
"মায়ের ক্যান্সার হয়েছে বাবা। স্টমাক ক্যান্সার, স্টেজ ফোর।"
থমকে গেলাম। ছেলেটা হাঁপুস নয়নে কাঁদছে। ওকে কী বলে সান্ত্বনা দেবো আমি?
কোনো মতে জিজ্ঞাসা করলাম, "কবে ধরা পড়ল?"
"গত সপ্তাহে, পরশু থেকে কেমো শুরু করতে হবে, বেশি সময় নেই বাবা।"
ওর কাছ থেকে হাসপাতাল আর কেমোর সময় সব নিয়ে রাখলাম। ছেলেটাকে ছাড়তে মনে চাইছিল না। বললাম, "চলো, তোমাকে উবার ঠিক করে দিচ্ছি।"
"না না, আমি বাসেই যেতে পারব।"
বুঝলাম ছেলেটা ভাড়ার কথা ভাবছে। বললাম, "আরে চলো তো।"
ওকে নিয়ে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসে বাপ-ছেলে রাতের খাবারটা খেলাম। খাবারটা খুব মজার হলেও সজীব তেমন খেতে পারল না। হয়তো ফ্রাইড রাইস ওর পছন্দ না। আচ্ছা! ওর পছন্দের খাবার কি সেটাই তো আমি জানি না। বাসার জন্যও কিছু খাবার প্যাক করে দিলাম। সেঁজুতি আর দোলার জন্যও নিয়ে নিলাম। এখানকার খাবার ওদের দু'জনেরই খুব পছন্দ।
সজীবকে একটা উবার ঠিক করে উঠিয়ে দিলাম, আমার কার্ড থেকে পেমেন্ট হয়ে যাবে। যাওয়ার আগে ওকে বললাম, "তুমি ভেঙে পড়ো না, আমি তো আছি।"
ছেলেকে এ কথা বললেও নিজের মনেই সংশয়, কতটা থাকতে পারব আমি?
বাসায় ফিরে দেখি সেঁজুতি তখনও মুখ ভার করে বসে আছে। আমি এখনও অফিসের পোশাক পাল্টাইনি। একবারে গোসল করতে চলে গেলাম। ওর সাথে রাতে কথা বলব।
সব শুনে সেঁজুতিও থম ধরে গেল। স্বামীর প্রথম পক্ষের সন্তানদের পছন্দ না করলেও সে নিষ্ঠুর তো নয়। ওকে যখন বললাম যে, শারমিনের প্রথম কেমোর দিন আমি হাসপাতালে যাব, সে মানা করল না। তবে খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, "তবে দেখো, টাকা-পয়সার ঝাঁপি খুলে বসো না।"
নির্ধারিত দিনে আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। শারমিনকে তখন ভেতরে নিয়ে গেছে। ওর সামনে গেলাম না। সায়রার পাশে গিয়ে বসলাম, মেয়েটা শুকনো মুখে করিডোরে একটা চেয়ারে বসে আছে। অনেক শুকিয়ে গেছে মেয়েটা, চোখ-মুখ ফুলে আছে। বুঝাই যাচ্ছে, দিন-রাত কান্নাকাটি করছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, "মা ঠিক হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।"
জবাবে সায়রা শুধু মাথা ঝাঁকাল। মেয়েটার সাথে আমার অনেক দূরত্ব। সজীবের সাথে তাও আমি কিছু সময় কাটিয়েছি, সায়রার সাথে একদমই স্মৃতি নেই আমার। ওর দেড় বছরের সময়ই আমার আর শারমিনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আর তার আগের সময়টা আমি নতুন প্রেমে বিভোর ছিলাম। সেঁজুতি ছাডা সেই সময়টা আমার মাথায় কিচ্ছু ছিল না। সায়রা কবে হামাগুড়ি দিল, কবে ওর প্রথম দাঁত উঠল, কবে সে হাঁটতে শিখল, আমি কিছুই বলতে পারব না।
ওয়ার্ডের দরজাটা খুললে শারমিনকে এক ঝলক দেখলাম। শীর্ণ চেহারা, রুগ্ন শরীর, যা শুনেছি, অনেক দিন ধরেই শরীর খারাপ ছিল। কিন্তু সব লক্ষণ অগ্রাহ্য করে শুধু গ্যাসের ওষুধ দিয়ে চালিয়েছে। ডাক্তার দেখায়নি। এ কয়দিন আমি স্টমাক ক্যান্সার নিয়ে বেশ রিসার্চ করেছি। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
"সায়রা, সজীব, এই নাও কফি। খেয়ে নাও, ভালো লাগবে।" আমার বয়সী এক ভদ্রলোক দুই কাপ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, "ওহ! আমি জানতাম না আপনি এসেছেন। কফি খাবেন?"
"না, ধন্যবাদ। কিন্তু আপনি?"
"বাবা, উনি হামিম আংকেল, মার কলিগ। আমাদের খুব হেল্প করছেন।" সজীব বলে উঠল। ছেলে-মেয়েরা কফি নিয়ে নিলে ভদ্রলোকের সাথে হাত মিলালাম। শারমিনের চিকিৎসার নাড়ি-নক্ষত্র উনার জানা। বুঝলাম সব দৌড়াদৌড়ি উনিই করছেন। শারমিনের বাপের বাড়ির দিকে তেমন কেউ নেই। এক ভাই আছে, ইটালি থাকে। হামিম সাহেবকে ধন্যবাদ দিলাম এই বিপদে ওদের পাশে থাকার জন্য।
হামিম সাহেবের উৎকণ্ঠা দেখছি শারমিনের জন্য, বাচ্চাদের প্রতিও অনেক খেয়াল। বিবাহিত জীবনে শারমিনের প্রতি আমি কখনো এতটা খেয়াল দেখাইনি। মনের মিলই হয়নি। শারমিন অবশ্য অনেক চেষ্টা করত আমাকে খুশি রাখার। অফিস থেকে আসলে সেজেগুজে থাকত, পছন্দের খাবার রান্না করত। অভিযোগ করার সুযোগ দিত না আমাকে। কিন্তু ঢাকায় পড়াশোনা করে আধুনিকতার দেখা পাওয়া আমার মফস্বলের মেয়েটিকে মনে ধরেনি। মনে আছে, একবার ও অসুস্থ থাকায় রান্না করতে পারেনি, আমি বলেছিলাম নাটক করছে আমার মনোযোগ পাওয়ার জন্য। এরপর সজীব এলো, শারমিন তার সমস্ত মনোযোগ সন্তানের প্রতি ঢেলে দিল। বছর দুয়েক পর সায়রা আগমনের সংবাদ পাই। সায়রা পেটে থাকতেই আমার সেঁজুতির সাথে পরিচয়। শহুরে, আধুনিকা, যেমন মেধাবী, তেমন চৌকষ, বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে। আমার অফিসের একটা প্রেজেন্টেশন দিতে গিয়ে ওর সাথে পরিচয়। সায়রা যখন পৃথিবীতে এলো, তখন আমি সেঁজুতিতে ভীষণভাবে মগ্ন। ওর জন্য নিজের সন্তানদের ছেড়ে অন্য ঘর বাঁধতে দ্বিধা করিনি আমি।
"তুহিন সাহেব, একটা কথা বলব?" হামিম সাহেব জিজ্ঞেস করেন।
"বলুন।" হামিম সাহেবের সাথে শারমিনের সম্পর্ক আছে কিনা চিন্তা করছি, না হলে এ যুগে কে কার জন্য এভাবে করে?
"কী ভাবছেন?"
"কিছু না, আপনি বলুন।"
"শারমিনকে আমি বেশ ক'বছর ধরে চিনি। খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন, অনেক পরিশ্রমী। পাঁচ বছর আগে আমার স্ত্রী আর মেয়ে একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। সেই থেকে একাই আছি।" এতটুক বলে ভদ্রলোক থামলেন।
এত ইতিহাস বলার উদ্দেশ্যটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি।
হামিম সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন, "একাকী জীবন আর টানতে পারছিলাম না। শারমিনকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম মাস ছয়েক আগে। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবে উনি আমাকে রিজেক্ট করে দেন। আমি মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু উনার এই অবস্থায় দূরত্ব বজায় রাখতে পারিনি। তুহিন সাহেব, আমি উনার আর ছেলে-মেয়েদের পাশে থাকতে চাই।" বলে আমার হাত ধরলেন। আমিও অন্য হাত দিয়ে তার হাতের উপর আলতো চাপ দিলাম। বললাম, "আপনি যা করছেন, তা সত্যি ভাবা যায় না।"
"দেখুন, শারমিনের এখন অনেক সেবা, অনেক যত্নের প্রয়োজন হবে। আমি জানি না বাচ্চারা কতটুকু পারবে। কলিগ হিসেবে আমারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আপনি তো বুঝেন। আজ হোক, কাল হোক, কেউ না কেউ প্রশ্ন করবে, আমি কে, ওদের সাথে আমার কী সম্পর্ক।"
"আপনি কী করতে চাচ্ছেন?"
"আমি পূর্ণ অধিকার নিয়ে শারমিনের পাশে থাকতে চাচ্ছি। হয়তো শারমিনের হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু আমি চাই, ও জানুক, কেউ ওর পাশে আছে, ওর হাতটা ধরে আছে। আপনার কাছে আমার অনুমতি চাওয়ার কিছু নেই। তবুও আপনি পরোক্ষভাবে তাদের পরিবারের অংশ। তাই আপনাকে জানালাম। সজীব আর সায়রারও মত আছে।"
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। শারমিনের মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। বিয়ের সময়কার, যেদিন আমি বললাম আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চাই সেদিনকার, এখনকার। চোখ খুলে আমার সামনে বসা ভদ্রলোককে দেখলাম। প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া, মৃত্যু পথযাত্রী শারমিনের সঙ্গী হতে চাচ্ছেন তিনি। অথচ চোখে-মুখে কী উৎসাহ! আমার বিস্ময় বাঁধ মানছে না, এমনও ভালোবাসা হয়! এভাবেও পাশে থাকা যায়! সজীব আর সায়রা অদূরেই বসে আছে, আড়চোখে ওদের দিকে তাকালাম। সত্যি, ওদের একটা শক্ত সাপোর্ট দরকার, যেটা আমি কখনোই হতে পারব না। আমি হামিম সাহেবের সাথে হাত মিলাই। বলি, "আপনি দারুণ মানুষ হামিম সাহেব, ভালো থাকবেন আপনি, অনেক ভালো থাকবেন।" তাকে বলা হয় না, তার সামনে নিজেকে অনেক ছোটো লাগছে আমার। এখানে বসেও আমি হিসাব করছিলাম শারমিনের চিকিৎসায় কত টাকা দিয়ে আমি দায় সারতে পারব। নিজের ক্ষুদ্রতা নিয়ে শারমিনের সাথে আর দেখা করা হয় না। তার জীবনের এই অন্ধকার সময়েও আলো দেখানোর মানুষ এসে গেছে। আমি যা পারিনি, তা অন্য কেউ করছে তার জন্য। যতদিন বাঁচুক সে, ভালোবাসায় বাঁচুক।
#ইসরাত_মোস্তফা