13/10/2025
ছবিতে আফগানিস্তানের পাক্তিয়া প্রদেশের গার্দেজ জেলায় সোভিয়েত বাহিনীর গোলাবারুদ ডিপো উড়িয়ে দিচ্ছে আফগান মুজাহিদীনরা। সেই দৃশ্য উপভোগ করে চা পান করছেন ISI এজেন্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ ডোগার।।
১৯৭৯ সাল। ১০ লক্ষ সেনার বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নেয় পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর সোভিয়েতরা তাদের পুতুল সরকার বাবরাক কারমালকে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসায়।
সোভিয়েতের লক্ষ্য ছিলো আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা, সমগ্র মধ্য এশিয়াতে কমিউনিস্ট চিন্তা-ধারার উগ্র প্রসার বিস্তার করা এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও আরব দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করা।
এই যুদ্ধে সোভিয়েতের প্রত্যক্ষ সহযোগী ছিলো ভারত সরকার এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থা 'র'। ক্ষমতা দখলের পর সোভিয়েতরা আফগানের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন ঠেকাতে গনহত্যা, বর্বর তান্ডব শুরু করে। ১০ বছর চলা এই যুদ্ধে সোভিয়েতরা ২০ লক্ষের বেশি আফগানকে হত্যা করে। গ্রামের পর গ্রাম মানবশুন্য করে ফেলে।
সোভিয়েতের এই আগ্রাসন ঠেকাতে পাকিস্তান "অপারেশন সাইক্লোন" নামে এক মিশন শুরু করে, যা পরবর্তীতে পুরো অঞ্চলের ইতিহাস ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করে দেয়।
অপারেশন সাইক্লোনের আওতায় পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা ISI আফগান মুক্তিবাহিনী গুলোকে সংগঠিত করে ট্রেনিং দেয়া শুরু করে। ছোট ছোট মুক্তিকামি গ্রুপ গুলোকে একত্রিত করে গঠন করে পশ্চিমাদের ত্রাস সংগঠন- "আফগান মুজাহিদীন"
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে মুজাহিদীনের ট্রেনিং ক্যাম্প গঠন করা হয়। সেখানে ISI এর পাশাপাশি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA এর এজেন্টরাও মুজাহিদীনের ট্রেনিয়ে অংশ নেয়।
সোভিয়েত আফগান যুদ্ধের এক্স-ফ্যাক্টর ছিলো ISI এর গুপ্তচরবৃত্তি। ISI এজেন্টরা রাজধানী কাবুল, কান্দাহার থেকে শুরু করে পুরো আফগানিস্তান ব্যাপি মাকড়সার জালের মত বিস্তৃত এক গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। সোভিয়েতের প্রযুক্তিগত ফাদ এড়াতে তারা আদিম পদ্ধতিতে তথ্য আদান-প্রদান করতো। ISI এর গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে অসংখ্য আফগান নাগরিকও ছিলো, যারা মুজাহিদীনদের সাথে ISI এজেন্টদের যোগাযোগ রক্ষা করতো।
যুদ্ধে CIA গোপনে পাকিস্তানকে রাইফেল, FIM-92 স্টিংগার ম্যানপড, রকেট লঞ্চার, মর্টার সহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সর্বরাহ করে। ISI এজেন্টরা সোভিয়েত সেনা, গুপ্তচর বাহিনী KGB এবং RAW এর নজর এড়িয়ে পাহাড়ি অধিবাসীদের ছদ্মবেশে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের দুর্গম পাহাড়ি পথে গাধার পিঠে করে সেসব অস্ত্র মুজাহিদীনদের নিকট পৌঁছে দিতো।
এই যুদ্ধে পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলগুলো ছিল মুজাহিদীনদের নিরাপদ আশ্রয়। মুজাহিদীনরা সোভিয়েত সেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমনের পর পাকিস্তানের দুর্গম অঞ্চল গুলোতে এসে আশ্রয় নিতো। এভাবে আমেরিকা ও পাকিস্তানের সহায়তায় আফগানরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
এছাড়া ISI এজেন্টরা স্যাবেটাজ মিশন চালিয়ে সোভিয়েত সেনাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে। তারা সোভিয়েত বাহিনীর ভিতর মিশে গিয়ে সেনা মুভমেন্ট, যুদ্ধ কৌশল, অস্ত্রের চালান, সেনা কনভয়ের গোপন খবরাখবর সংগ্রহ করে মুজাহিদীনদের নিকট প্রেরন করতো। মুজাহিদীনরা সেই অনুযায়ী এম্বুস করে সোভিয়েত সেনাবহর গুড়িয়ে দিতো।
ISI কে কাউন্টারে এবং তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা KGB এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW ব্যাপক তৎপরতা চালায়। শুধুমাত্র ISI ইনফর্মার সন্দেহেই বহু আফগান নাগরিককে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। কিন্তু এতকিছুর পরও আফগানিস্তানের দুর্গম পার্বত্য গোলকধাঁধায় তারা ISI নেটওয়ার্কের ছায়াও খুঁজে পায়নি। KGBর কাছে ISI ভুতের মত হয়ে উঠে, সব যায়গায় থেকেও কোথাও নাই। ১০ বছরের যুদ্ধে সোভিয়েতরা ১জন ISI এজেন্টকেও ধরতে পারেনি।
পাকিস্তানের অস্ত্র সর্বরাহ বন্ধ করা, ISI এর গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা এবং মুজাহিদীন সেনাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার লক্ষে ১৯৮৮ সালে সোভিয়েতের ৪০ তম আর্মির জেনারেল বরিস গ্রমভ "অপারেশন ম্যাজিস্ট্রাল" শুরু করেন- আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সীমান্তবর্তী পাকটিয়া প্রদেশে।!
এই হামলার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিলো গার্ডেজ থেকে খোস্ট প্রদেশে যাওয়ার রাস্তা পুনরায় দখল করা।! সেই সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২৩৪ মিটার উচ্চতায় একটি পাহাড় এর অধিকার নিয়ে- শুরু হয় এক বিশাল যুদ্ধ।! যা ইতিহাসের পাতায়, "ব্যাটল অফ হাইট ৩২৩৪" নামে অধিক পরিচিত।
সোভিয়েত ৩৪৫ তম, ইন্ডিপেন্ডেন্ট গার্ডস এয়ারবোর্ন রেজিমেন্ট এর উপর দায়িত্ব পরে- এই পাহাড়ে, কব্জা করার জন্য।! সর্বমোট, রাশিয়ান স্পেৎস্নাজ কমান্ডোর সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩৯ জন এর অধিক।! যদিও তাদের সঙ্গে ছিলো সোভিয়েত আর্মির আধুনিক গোলন্দাজ এবং বিমান বাহিনীর পরিপূর্ণ সহযোগিতা।!
সোভিয়েতের এই হামলা প্রতিরোধে আফগান মুজাহিদীন ও পাকিস্তান আর্মীর এসএসজি কমান্ডো মিলে একটা যৌথ গ্রুপ গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত বহু সেনা ও যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষয়ক্ষতির মুখে সোভিয়েত সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
এছাড়া সোভিয়েত বিরোধী এই যুদ্ধে পাকিস্তান বিমান বাহিনীও সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি বিমানগুলো সীমান্তবর্তী সোভিয়েত ঘাটিগুলো বম্বিং করে উড়িয়ে দেয়। এছাড়া আকাশ যুদ্ধে ডগফাইটে পাকিস্তানের হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ৭ টি যুদ্ধবিমান শুটডাউন হয়।
পাকিস্তান ও মুজাহিদীনের দ্বীমুখী হামলায় টিকতে না পেরে ১৯৮৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী প্রবল পরাক্রমশালী সুপারপাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন লেজ গুটিয়ে আফগান ছেড়ে পালায়। পতন হয় সোভিয়েতের বসানো পুতুল সরকারের।
আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত অর্থনীতি এতেটাই দুর্বল হয়ে যায়, যার ১ বছরের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। মুলত ১৯৭১ সালে ভারতকে অস্ত্র ও কুটনৈতিক সহায়তা দিয়ে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করায় সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। আফগান যুদ্ধে সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে, পাকিস্তানের কারনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫ টুকরো হয়ে যায়।
সোভিয়েতের পতনের পর মুজাহিদীনরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল শাসন করতে শুরু করে। তবে রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকার ঘোষণা করে তাজিক বংশদ্ভূত মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ। তখন পুরো দেশ জুড়ে অস্থিরতা, অরাজকতা, সহিংসতা ছড়িয়ে পরে।
১৯৯৪ সালে মুজাহিদীনের কয়েকজন নেতা মিলে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে "তা'লে'ban" নামক নতুন একটা গ্রুপ গঠন করে। তা'লে'banএর জন্ম থেকে শুরু করে সরকার গঠন পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছে ISI.
১৯৯৪ সালের অক্টোবরে ISI এবং তা'লে'ban যৌথ অপারেশনে আহমদ শাহ মাসউদ গ্রুপের ১৭ ট্রাক অস্ত্রের বড় একটি চালান দখল করে নেয়। নভেম্বরে তা'লে'ban যোদ্ধারা কান্দাহার এয়ারপোর্ট দখল করে সেখানে থাকা ৬টি মিগ-২১ ও ৪টি Mi-17 হেলিকপ্টার নিয়ে নিজেদের বিমান বাহিনী গঠন করে। তা'লে'ban এর অনুরোধে ISI পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একদল টেকনিশিয়ান এনে বিমানগুলোকে রক্ষনাবেক্ষনের ব্যাবস্থা করে।
সৌদি সরকার তা'লে'banকে ইরান বিরোধী শক্তির উথান হিসেবে স্বাগত জানায়। তারা তা'লে'banকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্যও প্রদান করে।
১৯৯৬ সালে তা'লে'banরা কাবুল দখল করে নিজেদের সরকার ঘোষণা দেয়। ১৯৯৭ সালের ২৬ মে বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র দেশ হিসেবে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক ভাবে তা'লে'ban সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। এরপরই সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও তা'লে'ban সরকারকে সমর্থন জানায়। বিপরীতে ইরান, রাশিয়া, ভারত এবং আমেরিকা তা'লে'ban সরকারের তিব্র বিরোধিতা করে।
© #অনির্বাণ
যুদ্ধ ও সমরাস্ত্র সম্পর্কিত আপডেট সব তথ্য পেতে আমাদের গ্রুপে যুক্ত থাকুন https://www.facebook.com/share/g/177P5GFde1/