
11/05/2025
গ্রামটা খুবই সাধারণ—। কিন্তু এখানে ছিল এক অসাধারণ ভয়।
আর তার নাম ছিল শেফালী বেগম।
তার কোনো জমি-জিরাত ছিল না, নিজের বলতে ছিল একটা টিনের ছাউনি দেওয়া কুড়ে ঘর আর তার একমাত্র মেয়ে—সাবিনা। পেশায় ভিক্ষুক, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষা করতেন। কিন্তু লোকেরা তাকে ভিক্ষা দিতেও ভয় পেত।
কারণ?
তাঁর চোখ।
একটা নীলাভ সাদা ঘোলাটে চোখ, যা দেখে লোকজন কাঁপত। কেউ বলত বেড়ালের চোখ, কেউ বলত অভিশপ্ত চাহনি।
গ্রামের লোকজন বলতো, “শেফালির চোখে যদি চোখ পড়ে, গোটা দিন খারাপ যাবে।”
সেই ভয় এমনই গভীর ছিল যে, কেউ তার দিকে তাকাত না—না ভয়ে, না ঘৃণায়।
তাঁর মেয়েও একই অভিশাপের ভাগিদার হয়ে পড়েছিল—সাবিনা, একটি শান্তশিষ্ট মেয়ে, কম কথা বলত, কারো সঙ্গে বেশি মিশত না। চেহারায় ছিল অস্পষ্ট গ্লানি, চোখে দীর্ঘ একাকিত্বের ছাপ।
বিয়ের বয়স হলেও কেউ তাকে বিয়ে করতে চাইত না। সবাই বলত,
— “এই মেয়েকে বিয়ে করলে ঘরে অমঙ্গল নেমে আসবে।”
এইসব কথা দিনে দিনে তাদের জীবনের গায়ে গ্লানি আর বিষিয়ে তুলেছিল। এমন এক গ্রীষ্মের দুপুরে, যখন ঈদের বাজার জমজমাট, এক গরুর ব্যবসায়ী তার গরু নিয়ে গ্রাম পার হচ্ছিল।
সেই সময় সে দেখে শেফালী বেগম আর সাবিনা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে।
ব্যবসায়ীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “আজ তো গেল দিনটা। যাক, দেখি গরুর বাজারে কি হয়।”
বাজারে গিয়ে ঘটে সেই ভয়াবহ ঘটনা—তার সবচেয়ে দামী গরুটি হঠাৎ করেই পড়ে যায়। হাঁ করে দেখে সবাই, গরুটির মুখ থেকে ফেনা উঠছে, চোখ স্থির, নিথর দেহ।
সে চিন্তা করল , “ওই মহিলার ছায়া পড়েছে!”
ব্যবসায়ী ফিরে এসে ঝাঁঝিয়ে উঠল শেফালীর ওপর।
— “তুই আমার সর্বনাশ করলি? তোর মেয়েটাকে নিয়ে এভাবে চলাফেরা করিস কেন? তোদের চোখেই অমঙ্গল আছে।”
লোকজনও দলে দলে এসে গালাগাল করতে লাগল , ছুড়ে দিল অপবাদ।
শেফালী শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল, তার নীল চোখে কান্না জমে ছিল, কিন্তু গড়িয়ে পড়ল না।
সবাই বলল ," তোদের যেন রাস্তায় না দেখি "
সেই রাতেই ঘর গুটিয়ে তারা গ্রামের বাইরে চলে গেল। কেউ জানে না কোথায়, কিভাবে।
এক সপ্তাহ পরে, কেউ নদীর ধারে শোনে কান্নার শব্দ।
খুব নিঃশব্দ কান্না, যেন কেউ গলা চেপে কাঁদছে।
পরদিন খবর এল—সাবিনা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আ*ত্মহ*ত্যা করেছে।
লোকজন নদীর পাড়ে দেখতে পেল একটা লাল জামা পড়া মেয়ে ভাসছে , আর কচুরিপানার মাঝে তার মাথাটা নিচের দিকে মুখ করা ছিল ।
আর শেফালী?
সে কোথায় যেন হারিয়ে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে শোনা গেল তার একটা অভিশাপ—
“তোমরা সবাই আমার চোখকে ভয় পেলে? এখন দেখবা, সেই চোখই তোমাদের ঘুম কেড়ে নেবে।”
তাঁর একটা গুণ ছিল, গ্রামের ভাষায় বলে "গাছ দেওয়া"।
ভয়ের চিকিৎসা করতেন—ফেন কচুর শেকড় তুলে লাল সুতা দিয়ে বেঁধে দিতেন হাতে।
বলত, "যার ভিতরে ভয় আছে, তার শরীরেই এটা কাজ করে।"
লোকজন হাসত, কিন্তু যারা গাছ নিয়েছিল, তারা জানত—সেই গাছ রাতে একা একা সরে যেত।
এখন অনেকেই শেফালীকে দেখে না, কিন্তু রাতের বেলায় তার ঝাঁটার শব্দ, কান্না, আর ঘরে আলো দেখা যায়—যেখানে সে নেই বহু বছর ধরে।
[4:42 pm, 11/05/2025] Sanzid Ahmed:
শেফালী বেগম আর সাবিনার গল্প মনে রাখে গ্রামের সবাই, কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলে না।
তবে রাত হলে অনেকেই সেই রাস্তা, সেই কুঁড়ে ঘর, সেই জাম গাছটা এড়িয়ে চলে।
এক রাতে, আফজাল নামে এক ছেলে তার বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিল। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল, চাঁদের আলো হালকা, বাতাস থেমে গিয়েছিল।
রাস্তাটা পেরোতে গিয়েই কুঁড়ে ঘরের সামনে এসে সে থমকে দাঁড়ায়।
কেউ যেন কাঁদছে।
চুপচাপ কান পাততেই শোনা গেল সেই ফুঁপিয়ে কাঁদা—না খুব জোরে, না খুব ধীরে, কিন্তু ঠিক এমন যে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।
আফজাল ভয় পায়নি। সে ভাবল, কেউ হয়ত কষ্টে আছে।
এগিয়ে গেল জাম গাছটার নিচে—
সেখানে বসে আছে একটা মেয়ে। মুখ ঢেকে আছে চুলে, মাথা নিচু।
সে ধীরে ধীরে বলে উঠল,
— “এই... তুমি কাঁদছো কেন? এত রাতে এখানে একা কী করছো?”
মেয়েটা কিছু বলল না।
সে শুধুই কাঁদতে লাগল।
©️Sanzid Ahmmed Redoy
আফজাল আবার প্রশ্ন করল, এবার একটু জোরে,
— “তুমি কে? বাড়ি কোথায় তোমার?”
হঠাৎ মেয়েটা মাথা তোলে।
চাঁদের আলোয় সে দেখে,
মেয়েটার মুখ ভয়ংকর বিকৃত—চোখ গুলো বড়, একেবারে ফাঁপা, নীলাভ আলো ছড়াচ্ছে। মুখের একপাশ থেতলে গেছে, যেন কেউ পাথর দিয়ে আঘাত করেছিল।
আফজালের চিৎকার গলায় আটকে গেল। পা চলছিল না।
সে কোনো মতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিল। পেছনে তাকায়নি, কিন্তু একটা অনুভূতি হচ্ছিল—
কেউ পেছন থেকে তাকিয়ে আছে, তাকিয়ে আছে ঠিক তার ঘাড় বরাবর।
✦ একই সময়ে, অন্য এক ঘটনা...
মোবারক নামে এক লোক, যিনি এক বিয়েতে গিয়েছিলেন, সাইকেল চালিয়ে রাতের বেলা ফিরছিলেন। রাস্তার মাঝখানে দেখতে পেল একটা বাঁশ পড়ে আছে।
ভাবল হয়ত বাতাসে পড়ে গেছে। তাই সাইকেল থেকে নেমে বাঁশটা সরাতে গেল।
হাত দিয়ে বাঁশ ধরতেই...
এক ঝটকায় বাঁশটা লাফ দিয়ে উঠে গেল আকাশে!
মোবারক ছিটকে পড়ে যায়। বাঁশ তার হাতে এক ধারালো কোণে লাগায়,
রক্ত ঝরতে শুরু করে।
হাত কাঁপছিল, ভয় চেপে ধরছিল বুকে।
হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল গ্রামের এক পুরনো ঘরের দিকে—সেই শেফালীর কুঁড়ে ঘর, যেখানে এখন কেউ থাকে না, কিন্তু আলো দেখা যায় মাঝেমধ্যে।
ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল, উঠোনে বসে আছে একটা মেয়ে। তার পেছন ঘেঁষে একটা পুরোনো গামছা শুকোচ্ছে।
মোবারক বলল,
— “মা, একটু জল দিবেন? হাতটা কেটে গেছে। কাপড়ের একটা টুকরো লাগবে...”
মেয়েটা ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল।
তাকানোর পর... কিছুই মনে নেই।
পরদিন ভোরে লোকজন দেখতে পেল মোবারক সেই কুঁড়ে ঘরের পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। হাত থেকে রক্ত ঝরছে, চোখ ফাঁকা, আর ঠোঁটের কোণে কেবল একটাই শব্দ ফিসফিস করে বের হচ্ছে—
“চোখ... চোখ... তার চোখ...”
সেই কুঁড়ে ঘরটা এখনো আছে।
চোখে পড়লে মনে হয় সময় থেমে গেছে সেখানে।
ঘরের চাল ছেঁড়া, দেয়াল ছোপ ছোপ ধুলা-মাটি-জীবনের দাগে ভরা। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো—রাতে মাঝেমধ্যে সেখানে আলো জ্বলে।
©️Sanzid Ahmmed Redoy
আর তখন... ভেতরে কেউ থাকে না।
✦ সাবিনার অভিশাপ?
লোকমুখে একটা কথা প্রচলিত,
সাবিনা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরেনি।
কেউ কেউ বলত, গহীন রাতে কেউ একজন তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল নদীর পাড়ে।
আর শেষবার কেউ দেখেছিল তাকে কুঁড়ে ঘরের উঠোনে বসে থাকতে—চোখে জল, ঠোঁটে ফিসফিস করে কিছু বলছিল। কেউ শুনতে পায়নি। শুধু অনুভব করেছিল, চারপাশে বাতাস থেমে গেছে।
তারপর থেকেই ঘটতে থাকে আজব ঘটনাগুলো...
✦ জাহাঙ্গীরের কাহিনি
জাহাঙ্গীর, পাশের গ্রামের এক যুবক, কাজ শেষে রাতে ফিরছিল। রাস্তায় এল এক জায়গায়—যেখানে গাছ নুয়ে পড়ে প্রায় রাস্তা ঢেকে রেখেছে। সে বাঁ দিক দিয়ে ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
এমন সময় একটা কণ্ঠ ভেসে এলো—
“ভাই... একটু দাঁড়াও তো...”
সে থমকে দাঁড়ালো। অন্ধকারে একটা মেয়ের ছায়া দেখতে পেল, বেশ তরুণী।
সে বলল,
— “তোমার সমস্যা কী? এত রাতে এখানে?”
মেয়েটি বলল,
— “আমার মা নেই। কেউ আমাকে ঘরে নেয় না। তোমার বাসা কোথায়?”
জাহাঙ্গীর ভয় পায়নি। মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়ালো। চেহারায় ক্লান্তি, চোখ দুটো যেন কুয়াশা ঢাকা।
কিন্তু সে মুহূর্তেই খেয়াল করল...
মেয়েটার পা নেই।
সে মাটি স্পর্শ না করে ভেসে আছে।
আর তার কণ্ঠটা... হঠাৎ করেই পাল্টে গেল—
কর্কশ, পুরুষালি কণ্ঠে বলল,
— “তুইও আমাকে তাড়াবি?”
জাহাঙ্গীর চিৎকার করে দৌড় দিল। পেছনে তাকাল না, শুধু ছুটতে থাকল যতক্ষণ না আলো দেখল।
✦ শেষবার...
এক ভোরে, হাট থেকে ফেরার সময় রহিম মিয়া নামের এক বয়স্ক লোক দেখল কুঁড়ে ঘরের দরজায় একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছিল সে কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
রহিম সাহস করে এগিয়ে গেল।
মেয়েটা বলল,
— “আমার একটা গাছ বাঁধা ছিল তোমার হাতে। তুমি খুলে ফেলেছিলে... কেন?”
রহিম স্তব্ধ। হঠাৎ করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ১৫ বছর আগের এক রাত—
যখন সে ভয়ে ভয়ে শেফালী বেগমের কাছ থেকে একটা গাছ নিয়েছিল।
সে বলেছিল,
— “মা, আমার উপর কিছু হয়েছে, স্বপ্নে আগুন দেখি...”
শেফালী বেগম তার হাতে লাল সুতা দিয়ে ফেনকচুর শেকড় বেঁধে দিয়েছিলেন।
কিন্তু সে গাছটা খুলে ফেলে দিয়েছিল...
কারণ, লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত।
আজ, সেই মেয়েটি তার সামনে।
রহিম কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি সাবিনা?”
মেয়েটা হাসল না, কাঁদল না। শুধু বলল,
— “আমরা কই যাওয়ার? যেখানে অপয়া বলেছে, ওখানেই থাকি...”
তারপর ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল।
রহিমও আর কখনো কথা বলেনি।
🔚 শেষ কথাঃ
আজ সেখানে ঘরবাড়ি উঠেছে, আলো জ্বলে, মানুষ ঘোরাফেরা করে।
কিন্তু মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বলে—
রাতে যদি জাম গাছের নিচে একা থাকো, হঠাৎ একটা চুলে ঢাকা মেয়ে তোমার পাশে বসে।
সে কিছু চায় না।
শুধু... ফিসফিস করে বলে,
“আমাকে কেউ চাইনি...”
©️Sanzid Ahmmed Redoy