12/10/2025
ইসলাম ও রাজনীতি
ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি একই মুদ্রার দুই পিঠ হিসেবে বিবেচিত হয় না; বরং ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা, যেখানে ধর্ম ও রাজনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। জন এসপোসিটো বলেছেন-“প্রচলিত ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি একটি সামগ্রিক জীবনের নির্দেশনা দেয়, যেখানে ধর্ম রাজনীতি, আইন ও সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত” (মোটেন ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ২০)। অনুরূপভাবে কাব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন-“ইসলাম, সরকার ও জনগণ হলো একটি তাঁবুর খুঁটি, দড়ি ও খিলের মতো। তাঁবু হলো ইসলাম; খুঁটি হলো সরকার; দড়ি ও খিল হলো জনগণ। একটির অভাবে অন্যটি টিকে থাকতে পারে না” (মোটেন ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ২০)।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্র হলো ইসলামের মৌলিক নীতিমালা বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান। ইসলামে কাউকে নিজস্ব ক্ষমতায় আইন প্রণয়নের অধিকার দেওয়া হয়নি এবং কাউকে তা মানতে বাধ্যও করা হয়নি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-“ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই, তিনি নির্দেশ দেন তোমরা তিনি ব্যতীত অন্য কারও কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। এটাই সঠিক পথ” (সূরা ইউসুফ ১২:৪০)। “তারা বলে, আমাদেরও কি ক্ষমতা আছে? বলুন, সব ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই” (সূরা আলে ইমরান ৩:১৫৪)। “যারা আল্লাহ কর্তৃক প্রকাশিত আইন অনুযায়ী বিচার করে না, তারা কাফির” (সূরা আল মায়িদা ৫:৪৪) (মোটেন ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ২০)।
ইসলামী রাষ্ট্র সব ধরনের বর্ণবাদ ও জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্ত থাকার কথা। এটি একমাত্র ইসলামী নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র। আবুল আ’লা মওদূদীর মতে-“প্রত্যেক সদস্য তার দায়িত্ব পালন করে আল্লাহর কাছে, যিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের আদেশ করেন এবং সব ধরনের শোষণ, অন্যায়, বিশৃঙ্খলা ও অসমতা নিষিদ্ধ করেন” (মোটেন ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ২১)। ফলে এমন সমাজ যেখানে মুসলিমদের আধিক্য রয়েছে, সেখানে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে ইসলামের মূল্যবোধ উপেক্ষা করা বা ইসলামে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করা কঠিন, দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষিত না হলেও। ইতিহাসের কোনো পর্যায়ে কিছু মুসলিম দেশ ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তবে একটি মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে রাজনৈতিক জীবন সাধারণত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনের বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত হয়। ইসলামের মৌলিক নীতিমালা থেকে গুরুতর বিচ্যুতি একটি শাসনব্যবস্থার অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশ সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে ঐতিহ্যবাদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গ্রামে বসবাস করে, আর সংখ্যালঘু অংশটি উপনিবেশবাদী শাসনের কারণে শাসকশ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। গুনার মিরডাল উল্লেখ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্ম এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে “এমনকি কমিউনিস্টরাও ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না” (মিরডাল ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১৪১)। এমনকি কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা, যেমন মহাত্মা গান্ধি বলেছেনÑ“আমার কাছে রাজনীতি ও ধর্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই” (মিরডাল ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১৪২)। সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রশিদুজ্জামান মন্তব্য করেছেন-
“যখন পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে রূপান্তরিত হয়, তখন অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়া অপরিবর্তনীয়ভাবে ধর্মীয় গোষ্ঠীবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের পথে অগ্রসর হচ্ছে, যা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভক্তির পটভূমি ছিল। তবে পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে দেয়, তারা ভুল ধারণা পোষণ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইসলামী ঐতিহ্য ও অনুভূতিকে উপেক্ষা করেছিল, যা পরে নতুন বাংলাদেশের সরকার দ্বারা সচেতনভাবে চর্চা করা হয়। এটি পরে একটি দৃঢ় ও ব্যাপক রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে ফিরে আসে” (রশিদুজ্জামান ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৫৫)।
এই প্রেক্ষাপটে এই অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে প্রতিটি শাসনামলে ইসলামকে কীভাবে এবং কেন একটি বৈধতার মূল্যবোধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে; আর এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী কী ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত প্রশ্ন : একটি গণতন্ত্র-উত্তর দেশে
ইসলাম, রাজনীতি ও সমাজ
সম্পাদনা
সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম
মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
অনুবাদ : রোকন উদ্দিন খান