22/11/2025
চার বছর পর ২০২৯-এ ইংল্যান্ড থেকে যখন দেশে ফিরলাম, প্রত্যাশা ছিল এদেশে হয়তো ব্যাপক পরিবর্তন দেখব। যে ছেলেটি গলায় লেক্সাস বিস্কুটের প্যাকেট জড়িয়ে ছুটে গিয়ে আন্দোলনকারীদের হাতে বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিচ্ছিল, তারপর ৫ আগস্টে শনির আখরায় স্নাইপারের গুলিতে শহীদ হয়, যে বোনেরা ভাইয়ের লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল করেছিল, যে মা ছয় মাস পর্যন্ত ছেলের খোঁজে রাস্তায় বসে থাকত, তাদের স্বপ্ন বোধহয় কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে!
কিন্তু হতাশার সাগরে ডুবলাম।
মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে এদেশের মানুষ সব ভুলে গেল। অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হলো। জুলাই যেন সবার গলার কাঁটা। জুলাইয়ের শহীদদের নাম কোথাও নেই। জুলাই যেটুকু টিকে আছে, তা ‘ব্যাবসা’র স্বার্থে। সত্যিকার স্পিরিট কারও মাঝে নেই।
আমি আলমগীরের বইপত্র ঘাঁটতে গিয়ে চার-পাঁচটি মোটা মোটা নোটবুক পাই। খুলে পড়তে পড়তে আমি মুগ্ধ থেকে মুগ্ধ হতে থাকি। প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। সবগুলো গল্প পড়তে প্রায় এক মাস লেগে যায়। গুণে দেখি, মোট ৬৬টি গল্প। সবগুলো গল্পই অসাধারণ।
একদম শেষ গল্পের সাথে একটা চিরকুট পাই। হলুদ কালারের একটা কাগজ স্ট্যাপলিং করে লাগানো। মোটা কালিতে লেখা-
“ভাইয়া, আমার এ জীবনের জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী। তোমাকে আমি শুধু কষ্টই দিয়েছি। তোমার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। আমার এ গল্পগুলো আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য ছোট্ট উপহার। আমি যদি ফিরে না আসি, এ গল্পগুলো তুমি তোমার নামে ছাপাবে। এটা আমার শেষ অসিয়ত।”
ভাবনার অতল তলে তালিয়ে যাই। আমার ভাই। আমার ভাই। একা একাই চিৎকার করে উঠি। হাউমাউ করে কাঁদি।
প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করব। তবে এমনভাবে করব, যাতে একদিন জুলাই ফিরে আসে। রক্তাক্ত জুলাইকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এক যুগ দুই যুগ পরে হলেও জুলাইকে আবার জাগিয়ে তুলব। জুলাইয়ের সব শহীদ পরিবারের মর্যাদা ফিরিয়ে আনব।
স্বপ্ন দেখলাম, একদিন শুধু আমার ভাই নয়, জুলাইয়ের সব বীরদের মানুষ আবার শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। যে স্বপ্ন আর যে সাহস নিয়ে তারা লড়াইয়ে নেমেছিলেন, সেই স্বপ্নের কথা এদেশের তরুণরা আবার জানবে। আবার উদ্বুদ্ধ হবে।
মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিলাম।
অবশ্য নিজের নামে বই ছাপাতে গিয়ে কিছুটা দ্বিধাও লাগছিল। নিজেকে প্রতারক মনে হচ্ছিল। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, নিয়তের ব্যাপারে তো আল্লাহই ভালো জানেন। সারা পৃথিবীর মানুষ ভুল বুঝলেও আল্লাহ মানুষকে ভুল বোঝেন না।
অধ্যাপক জুবায়েরের পরিচিত এক প্রকাশক ছিল। তার মাধ্যমে ছাপিয়ে দিলাম প্রথম বই। প্রতি বইয়ে তিনটির বেশি গল্প না ছাপানোর পরিকল্পনা করলাম।
বই ছাপানোর পর প্রতিদিন খোঁজ নিতাম। নাহ, কেউ বই কেনেনি। কেনে না।
দেড় মাস পার হলো। একদিন লেখক পরিচিতিতে আমার নাম দেখে ডিপার্টমেন্টের এক ছেলে ক্লাসের সবাইকে বইয়ের কথা জানায়।
এরপরের ইতিহাস সবার জানা। নতুন করে কিছু বলার নেই।
আমি সফল হলাম কি না, তা জানার সুযোগ আমার নেই। কারণ, যেদিন সফলতা বা ব্যর্থতার হিশাব হবে, সেদিন আমি দুনিয়াতে থাকব না।
তরুণ প্রজন্মকে বলব, ২৫ বছর আগে জুলাইয়ে কেন একদল ‘পাগল’ সব পিছুটান ভুলে এভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল, একবার জানার চেষ্টা করো।
বয়স্কদের বলব, তোমরা শহীদদের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ, তোমাদের ক্ষমা নেই। মরেও তোমরা শান্তি পাবে না।
ডায়েরি পড়া শেষ হলো। সবাই বাক্রুদ্ধ হয়ে রইল। কারও মুখে রা নেই। যে যেখানে ছিল, সেখানেই বসে রইল। কী থেকে কী হয়ে গেল কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না। রুমের ভেতর পিনপতন নীরবতা। সবাই সবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিন্তু কারও মুখ হতে কোনো শব্দ বেরুল না।
এ বছরই জুলাইয়ে ‘অবিশ্বাস্য ইতিহাস’ নামে তিনটি গল্প নিয়ে একটি বই বেরুলো। লেখকের নামের স্থলে লালকালিতে লেখা আছে-
শহীদ আওরঙ্গজেব মুহাম্মদ আলমগীর।
প্রচ্ছদে ছাপা হলো সেই চিঠি। ৫ তারিখ সকালে যে চিঠি লিখে বেরিয়ে গিয়েছিলেন লেখক
“ভাইয়া,
তুমি আমাকে ভুল বোঝো না। শাহানা বড়ো দুঃখী মেয়ে। এই দুনিয়াতে ওর কেউ নেই। আমি ওর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আমি যদি না ফিরি, ওকে দেখো। ভালো ছেলে দেখে ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়ো। আমার অনাগত সন্তানের সব দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে গেলাম।
শাহানা,
তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। তোমার দুঃখ ঘোচাতে পারলাম না। যে ভরসা নিয়ে তুমি আমার হাত ধরেছিলে, তোমার সে আশা পূরণ করতে পারলাম না। ভাইয়ার কথামতো চলো।
সন্তানের উদ্দেশে-
(ফাঁকা, কিছুই লেখা নেই। কে জানে! হয়তো লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লেখার ভাষা খুঁজে পাননি। কিংবা নীরবতা দিয়েই বুঝিয়ে গেছেন সব কথা।)”
বই : সূর্যগ্রহণ
লেখক : কাউসার আলম
ধরণ : জুলাই উপন্যাস