17/04/2025
প্রিটোরিয়ার এক নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় ছোট্ট ইলন কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে ক্রিকেটের ডাক, কিন্তু তার কানে পৌঁছায় না কিছুই। আঙুলগুলো কী-বোর্ডের উপর দ্রুত ছুটছে, কোডের পর কোড জুড়ে চলেছে এক অদৃশ্য সেতু। বারো বছর বয়সে সে তৈরি করে ফেলেছে 'ব্লাস্টার'—একটি ভিডিও গেম। বিক্রি করে দিয়েছে একটি কম্পিউটার ম্যাগাজিনকে, মাত্র পাঁচশো ডলারে। প্রথম উপার্জন, কিন্তু তার চোখে লোভ নেই, আছে শুধু বিস্ময়। "এটা তো স্রেফ শুরু," সে মনে মনে বলে।
মায়ের বইয়ের তাক থেকে টেনে আনা আইজ্যাক অ্যাসিমভের 'ফাউন্ডেশন' সিরিজ তার বালিশের নিচে লুকোনো। রাতের পর রাত সে পড়ে, কল্পনা করে কীভাবে মানবসভ্যতা নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ছড়িয়ে পড়বে। স্কুলের ক্লাসে যখন শিক্ষক জিজ্ঞাসা করেন, "তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?" ইলন উত্তর দেয়, "যে পৃথিবী বদলে দেবে।" ক্লাসের সবাই হাসে।
-----
কানাডার ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে ইলনের গায়ে কাঁটা দেয়। পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে সে দিনের পর দিন কাজ করে, কিন্তু মন পড়ে থাকে অন্যত্র। স্ট্যানফোর্ডে পিএইচডি শুরু করার মাত্র দুই দিন পর সে সব ছেড়ে দেয়। অধ্যাপকরা অবাক, "পাগল নাকি?" কিন্তু ইলন জানে, ক্লাসরুমের চার দেওয়ালের বাইরে অপেক্ষা করছে বিশাল এক বিশ্ব।
১৯৯৫। ইন্টারনেট তখনও শিশু। ইলন আর তার ভাই কিম্বাল মিলে তৈরি করে 'Zip2'—একটি অনলাইন ডিরেক্টরি। অফিস বলতে এক ভাঙা গ্যারেজ। শীতের রাতে সে সোফায় ঘুমায়, কম্পিউটারকে বালিশ বানিয়ে। ব্যাংক একাউন্টে মাত্র কয়েক ডলার। একদিন সকালে উঠে দেখে, কী-বোর্ডের নিচে এক ইঁদুর মরে আছে। সে হাসে, "এটাও কি কোনো সংকেত?"
-----
Zip2 বিক্রি করে সে পায় ২২ মিলিয়ন ডলার। সবাই ভাবে, এখন সে সুখে থাকবে। কিন্তু ইলন পুরো টাকা ঢেলে দেয় 'X.com'-এ—একটি অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম। ব্যাংকাররা তাকে উপহাস করে, "লোকেরা ইন্টারনেটে টাকা দেবে? পাগলামি!" এক বছর না যেতেই X.com ধসে পড়ে। বোর্ড মেম্বাররা ইলনকে সরিয়ে দেয়।
কিন্তু সে হাল ছাড়ে না। নতুন নামে—'পেপ্যাল'—আবার শুরু করে। ২০০২। ইবে পেপ্যাল কিনে নেয় ১.৫ বিলিয়ন ডলারে। ইলনের ভাগে আসে ১৮০ মিলিয়ন। সবাই চিন্তা করে, এবার সে বিশ্রাম নেবে। কিন্তু সেদিন রাতেই সে ডেকে আনে রকেট ইঞ্জিনিয়ারদের, বলে, "মহাকাশে যেতে হবে। মার্সে কলোনি বানাব।"
-----
স্পেসএক্সের প্রথম তিনটি রকেট বিস্ফোরিত হয়। মিডিয়া তাকে 'টিনফয়েল হিরো' বলে উপহাস করে। ২০০৮। টেসলা ধুঁকছে, আর্থিক সংকটে। ইলনের ব্যক্তিগত সঞ্চয় শেষ। একই সময় তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এক সাক্ষাৎকারে সে কেঁদে ফেলে, "আমি ব্যর্থ হতে পারি। কিন্তু চেষ্টা করব।"
সেই বছরই নাসার চুক্তি আসে। স্পেসএক্সের ফ্যালকন ৯ সফলভাবে উড়ে। টেসলা রোডস্টার বাজারে আনে বিপ্লব। ইলন চুপচাপ একটি নোটবুকে লিখে রাখে, "যারা আমাকে থামাতে চেয়েছিল, তাদের ধন্যবাদ। তোমাদের জন্যই আমি আরও জোরালো হয়ে ফিরেছি।"
-----
২০১৫। এক রাতের গভীরে ইলন তার লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে এক কাপ কফি, চোখ আকাশে। তার ফোন বেজে ওঠে—একটি মেসেজ। নিউরালিংকের টিম লিখেছে, "এবার কাজ করেছে।" সে মুচকি হাসে। এই প্রকল্পটি গোপন। পৃথিবী জানে না, ইলন মানুষের মস্তিষ্ক আর কম্পিউটারের সংযোগ ঘটাতে চায়।
অন্য এক সন্ধ্যায়, টেসলার ফ্যাক্টরিতে এক কর্মী তাকে জিজ্ঞাসা করে, "স্যার, আপনি কিভাবে এত কিছু করেন?" ইলন উত্তর দেয়, "ভয়কে কাজে লাগাও। প্রত্যেক ভোর আমার মনে হয়, আজই সব শেষ হয়ে যাবে। তখনই আমি উঠে পড়ি, আরও কঠোর পরিশ্রম করি।"
-----
আজ ইলন মাস্ক পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ। কিন্তু তার গ্যারেজে এখনও সেই পুরনো কী-বোর্ডটি রাখা আছে—যার নিচে ইঁদুর মরে ছিল। স্টারলিংকের স্যাটেলাইটগুলি আকাশে জাল বুনছে, আর সে স্বপ্ন দেখে মঙ্গলের শহরের। কেউ জানে না, সে রাতে ঘুমের মধ্যে কী বলে। হয়তো বলে, "এখনও অনেক বাকি।"