
05/08/2025
হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিয়ের বয়স: প্রচলিত ধারণা না কী বিকল্প ঐতিহাসিক সত্য?
হযরত আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) ইসলামী ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারী সাহাবী। তাঁর জীবনীতে একটি ব্যাপারকে ঘিরে বহু বিতর্ক ও প্রশ্ন দেখা গেছে, তা হলো—বিয়ের সময় তাঁর বয়স। অনেকেই বলেন, তিনি বিয়ের সময় ৬ বছর বয়সী ছিলেন এবং ৯ বছর বয়সে স্বামীঘরে যান। তবে সাম্প্রতিক অনেক ইসলামি গবেষক ও ঐতিহাসিকদের মতে, এই তথ্যটি একমাত্রিক এবং ঐতিহাসিকভাবে পূর্ণাঙ্গ নয়। বরং, তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বয়স বিয়ের সময় ১৬ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে ছিল।
চলুন, বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখি।
---
প্রচলিত মত কোথা থেকে এসেছে?
প্রচলিত ধারণাটি মূলত সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিম-এর কিছু হাদীস থেকে এসেছে যেখানে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন—“আমি যখন নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই, তখন আমার বয়স ছিল ৬ বছর এবং আমি যখন তাঁর কাছে যাই (বাসর হয়), তখন আমার বয়স ছিল ৯ বছর।” (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫১৩৪)
এ হাদীসটি বহুবার বর্ণিত এবং প্রসিদ্ধ হলেও, একে ঘিরে রয়েছে কিছু ঐতিহাসিক অসামঞ্জস্যতা।
---
বিকল্প ঐতিহাসিক প্রমাণ ও যুক্তি
১. আয়েশা (রাঃ)-এর বড় বোন ও ঘটনাক্রমের বিশ্লেষণ
হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ) ছিলেন আয়েশা (রাঃ)-এর বড় বোন। ইসলামী ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির ও ইবনে আসাকিরের মতে, হযরত আসমা (রাঃ) ছিলেন আয়েশা (রাঃ)-এর চেয়ে ১০ বছর বড়।
হযরত আসমা (রাঃ) ৭৩ হিজরিতে ১০০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন (তবাকাত ইবনে সা’দ)। এ থেকে হিসাব করলে, হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ২৭ বছর, এবং আয়েশা (রাঃ)-এর বয়স ছিল প্রায় ১৭ বছর।
২. আয়েশা (রাঃ)-এর ইসলামের ইতিহাসে অংশগ্রহণ
হিজরতের আগে আয়েশা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং মক্কায় তিনি ধর্মীয় আলোচনা ও শিক্ষায় অংশ নেন। এত অল্প বয়সী (৬ বা ৯ বছর) কোনো শিশু কীভাবে এত গভীরভাবে ধর্মে যুক্ত হতে পারে—এ প্রশ্ন গবেষকদের মনে জাগে।
৩. নবীজির (সা.) আগের বিবাহ ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
নবীজির (সা.) প্রথম স্ত্রী ছিলেন হযরত খাদিজা (রাঃ), যিনি ছিলেন ৪০ বছর বয়সী একজন জ্ঞানী ও প্রভাবশালী নারী। নবীজির (সা.) বৈবাহিক জীবনের ইতিহাস দেখে বোঝা যায়, তিনি কখনোই শিশুকন্যার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না বরং প্রাপ্তবয়স্ক, বিচক্ষণ ও বিশ্বাসী নারীদের বেছে নিয়েছেন।
৪. ইবনে হিশাম ও আল-তাবারীর ব্যাখ্যা
কিছু ঐতিহাসিক, যেমন ইবনে হিশাম এবং আল-তাবারী বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সব সন্তানই ইসলাম গ্রহণের সময় প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। অর্থাৎ, আয়েশা (রাঃ)-ও তখন কৈশোর পার হয়ে প্রাপ্তবয়স্কা হয়েছিলেন।
---
তাহলে আয়েশা (রাঃ)-এর বয়স কত ছিল?
উপরে উল্লিখিত তথ্য ও প্রমাণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় ১৭ বছর।
হিজরতের পরে নবীজির (সা.) সঙ্গে তাঁর বাসর হয়, অর্থাৎ তখন বয়স ছিল ১৮-১৯ বছর।
---
উপসংহার
হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিয়ের বয়স নিয়ে প্রচলিত হাদীসের বর্ণনা থাকলেও, তা একমাত্রিকভাবে গ্রহণ না করে পূর্ণ ইতিহাস, পারিবারিক বর্ণনা, সমাজ ও কালপর্ব বিবেচনায় নিলে দেখা যায়—তার বিয়ের বয়স ১৬ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
এই বিষয়টি শুধুমাত্র ঐতিহাসিক সত্য নির্ধারণ নয়, বরং ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জবাবও বটে। তাই গবেষণাভিত্তিক ও দলিলসমর্থিত আলোচনার মাধ্যমে আমাদের উচিত সত্যকে তুলে ধরা।
---
তথ্যসূত্র (References):
1. Sahih al-Bukhari, Hadith 5134
2. Ibn Hisham’s “Sirah an-Nabawiyyah”
3. Tabari’s “Tarikh al-Rusul wal-Muluk”
4. Ibn Sa’d, “Tabaqat al-Kubra”
5. M. Barakatullah, “Age of Aisha (RA) at Marriage: Re-examined”
6. Dr. Muhammad Hamidullah, “Introduction to Islam.