
10/08/2025
আমি খুব ছোটবেলায় জীবনের অন্ধকার সব দিক দেখে ফেলেছিলাম। বাবা-মা'র সরকারি চাকরির সুবাদে কখনো কোন এক জায়গায় স্থায়ী হওয়া হয়নি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন পোস্টিং, নতুন জায়গা আর আমার জন্য নতুন ইশকুল। স্বভাবতই বন্ধু বানাতে পারিনি কখনো কাউকে। সারাদিন একলা ঘরে আমার সময় কাটতো বই পড়ে, বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে একটা প্রশ্নই করতাম সবসময়- ‘কেন?'
টিনেজের শুরুর দিকে এসে একটা মফস্বল শহরে স্থায়ী হয়ে গেলাম আমরা। ততোদিনে অল্পবিস্তর বই পড়ে আমার মাথায় যতোসব ফিলোসফিকাল চিন্তা কিলবিল করতে শুরু করে দিয়েছে। অল্প দু'একজন বন্ধু যা জুটিয়ে ফেলেছিলাম, তারা যখন রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলায় কীভাবে আরও বেশিক্ষণ ব্যাটিং করা যায় সে চিন্তায় ডুবে থাকতো তখন আমি আবুল হাসানের কবিতা আওড়াতাম। ওই বয়েসে আমার কোনমতেই আবুল হাসানের নাম জানার কথা নয়। অথচ আমি রীতিমতো নিৎসে আর কাম্যু পড়ে বসে আছি।
কোন জায়গায় স্থায়ী হয়ে থাকাটা বোধহয় আমার জন্য কখনোই ঠিক হয়নি। বন্ধুত্ব থেকে বাজে সঙ্গোপাঙ্গ এবং তারপর মাদকের পথ ধরতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমার। হাইস্কুল পার করার বছরখানেক পর একদিন মনে আবার প্রশ্ন জেগেছিলো- ‘কেন?'
উত্তর খুঁজে না পেয়ে এক লহমায় ছেড়ে দিয়েছিলাম সবকিছু। মাদক, নারী, বন্ধু, পরিবার, শহর- সবকিছু। ঢাকায় এসে উঠলাম। শুরু হলো আমার জীবনের অন্ধকারতম অধ্যায়ের। পালপিটিশন, অস্থিরতা এবং খুবই ভয়ঙ্করভাবে একাকীত্ব। সারা জীবন একলা বদ্ধ ঘরে বড় হওয়া একজন মানুষকে একাকীত্ব গ্রাস করতে পারে ওভাবে এ ব্যাপারটা এখনো কেন যেন ঠাহর করতে পারি না আমি সেভাবে। বেঁচে থাকার উৎসাহে এন্টি ডিপ্রেসেন্টে ডুব দিয়েছিলাম তখন।
শুরুর দিকে বেশ ভালো কাজে দিতো। তারপর শুরু হতে লাগল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। শূন্যতার তীব্র অনুভূতি নিয়ে আমি ফাঁসির দড়ি টানাতে শুরু করে দিয়েছিলাম ফ্যানের আঙটায়। কিবোর্ডে হাত রেখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম রাতের পর রাত অথচ লিখতে পারতাম না। যার ভেতর অনুভূতি বলে কিছু নেই সে লিখবে কী করে? কিন্তু একবছর আগেও ওই লেখাটা ছিলো আমার একমাত্র মুক্তির পথ।
তারপর একদিন দার্জিলিংয়ের এক পাবে পরিচয় দ্রুকির সাথে। প্রচণ্ড মাতাল আমাকে মুখের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মেয়েটা শুনিয়েছিলো গৌতম বুদ্ধের নির্বাণের গল্প।
পরিচয়ের তৃতীয় দিনে, দার্জিলিং থেকে প্রায় শতকিলোমিটার দূরের এক পাহাড় চূড়োয় ঠিক ভোর চারটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। স্লিপিং ব্যাগে মুড়ে নেয়া শরীরটা শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে। বাইরে শন শন শব্দ করে হিমেল হাওয়া বয়ে চলে, বের হওয়া মাত্র হাড় কাঁপিয়ে দেবে। তবু কেন যেন ভেতরে থাকতে পারি না আর, দম বন্ধ হয়ে আসে। স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে উইন্ডব্রেকার গায়ে চাপাই। কানটুপি ব্যাগের ভেতর, বের করতে ইচ্ছে করে না। তাঁবুর চেইন খুলে বাইরে বের হয়ে যাই। আকাশে চাঁদের সাথে মেঘেরা খেলা করে। দূরে, যেখানে পাহাড়ি খাদ নেমে গিয়েছে অতল গহ্বরে- সেখানে এক পাথরের চাতালের ওপর দ্রুকি বসে আছে। আরও দূরে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়– চাঁদের আলো পড়ে চক চক করছে শ্বেত শুভ্র দানবগুলো। কাছে যেতে যে খাদটাকে অতল গহ্বর মনে হচ্ছিল সেটাকে আর অতল গহ্বর মনে হয় না। অন্ধকারের স্থান দখল করে নিয়েছে ধব ধবে সাদা মেঘ। আর মাঝের পাহাড়গুলো দেখে মনে হয় যেন সফেন সমুদ্রের বুকে দ্বীপ জেগে উঠেছে।
কানটুপি ছাড়া বের হওয়া যে ভুল হয়ে গিয়েছে সেটা টের পেতে দেরী হয় না। তাপমাত্রা নেমে এসেছে শূন্যেও ষোল ডিগ্রি নিচে। দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে বারবার। সে শব্দে দ্রুকি আমার দিকে ফিরে তাকায়, মুখে স্নিগ্ধ হাসি। আমি যে ব্যগ খুলে আলসেমি করে নিয়ে আসব না এ যেন আগে থেকেই জানতো এই মেয়েটা। পকেট থেকে কানটুপি বের করে এগিয়ে দেয় সে আমার দিকে।
ওর পাশে গিয়ে বসি আমি। মিডিওকোর ম্যাটারিয়েলিস্টিক জীবন যাপন আমাদের ছুঁতে পাচ্ছে না, এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নেই। ভোর হয় খানিক পরে। সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়ে পৃথিবীতে। স্বর্ণালি পৃথিবীটাকে দেখে সাররিয়েলিস্টিক মনে হয়। দ্রুকি ক্যামেরা বের করে বলে, সামনে দাঁড়াও, এই সাররিয়েলিস্টিক পৃথিবীর সাথে তোমার একটা স্মৃতি রেখে দিই। সেই স্মৃতি নিয়ে আমি আবার ম্যাটারিয়েলিস্টিক পৃথিবীতে ফিরে আসি। কোন মানে হয় এর?
তারপর আসে কবিতা-
দূরপাল্লার গাড়িতে করে ছুটে চলা এইসব গোধূলিবেলায় ওমন হয়
দিগন্ত ভেসে আছে রাজসিক হলদে রঙা আলোতে, বাসে খুব ভীড়
জানালা দিয়ে ফুরফুরা বাতাস আসছে আর কানে সাইকোডেলিক রক
হঠাৎ করে ডিএনএ-র ভেতর থেকে অস্তিত্বের প্রশ্ন ছুটে আসে মনে।
এনজাইমের সাথে এনজাইম জুড়ে যে শরীরাবয়ব তৈরি হয়েছে, তার
সূত্রপাত হয়েছিলো কতগুলো ক্রমোজোম মিলে অথচ আমার শরীরের
অস্তিত্ব আমার সৃষ্টি নয়। পারিবারিক আর সামাজিক মিথস্ক্রিয়া
সৃষ্টি করেছে আমার মানসিক জগতে অস্তিত্বের প্রশ্ন— একটা দর্শন।
ধরা যাক, মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত নয়, সভ্যতার চাদরে নিজেদের বাঁধা
হয়নি আমাদের। বরং পাহাড় পাহাড় কোন বুনো প্রান্তরে তক্ষক আর বুনো
হাতির ডাক শুনে আমরা সঙ্গমে লিপ্ত হই। তাহলে আমাদের মাঝে
প্রেম হতো? পরীযায়ী প্রাণী যদি হয়েও যেতাম জাগতো কি মনে কোন
প্রশ্ন কোন ঝিরিতে বুনো মোষের মতো মুখ ডুবিয়ে পানি পানের সময়—
গোধূলিবেলায়? অথচ তবু আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে থাকতো এনজাইমের
সাথে এনজাইমের রাসায়নিক বিক্রিয়া— ডিএনএ। আমাদের সৃষ্টি হতো আরও
দুই সৃষ্টির সঙ্গম থেকে। কেবল স্তনে মুখ ডোবানোর আনন্দ নিতে হতো না।
ধরা যাক আমি আজরাইল, মৃতদের তালিকা কেবল লম্বা করেই যাচ্ছি, মাটিতে
মিশিয়ে দিচ্ছি জৈব শরীর। ডিএনএ-র লেখা মুছে গিয়ে সেখানে সৃষ্টি
হচ্ছে ঘাসেদের খাবার, পোকাদের বাসস্থান। মিকাইল মিটিয়ে চলেছে ক্ষুধা।
আর যে ক্ষুধায় এই ডিএনএ-র প্রতিলিপিরা সৃষ্টিকর্তার কথা ভুলে মত্ত
হচ্ছে নিষিদ্ধ অজস্র ভাবনা ও ক্রিয়ায়— তাদের কাছে ওহী নিয়ে আসতে
ব্যস্ত জিব্রাইল। জিব্রাইলের দায়িত্ব অবসান হলে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন মুছে যাবার
অপেক্ষায় ইস্রাফিল— অনন্তকাল ধরে হাতে শিঙ্গা নিয়ে। অথচ দেখো,
ওরা কেউ বন্দী নয় ডিএনএ-র কাছে, প্রবৃত্তির কাছে; নেই কোন ক্রাইসিস।
এইসব পাপ-শোক-অস্তিত্ব-ডিএনএ-ক্রমোজোম-প্রবৃত্তি ভুলে বা মেনে নিয়ে
আমি মানুষ হতে চাই না। কিন্তু সবার মতো আমিও বন্দী আমাদের ডিএনএ-র কাছে।
- গুপ্ত, মার্লবরো এ. হাসান