
07/09/2025
বনের নীরব বাসিন্দা: মুখপোড়া হনুমানের আশ্চর্য জীবন
বাংলাদেশের চিরসবুজ বনের গভীরে যে শান্ত ও লাজুক হনুমানটি বাস করে, তার নিরীহ চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির এক অবিশ্বাস্য জৈব-রাসায়নিক কারখানা। মুখপোড়া হনুমান এমন সব গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে, যা অন্যান্য বহু প্রাণীর জন্য বিষাক্ত এবং অপাচ্য। এর রহস্য লুকিয়ে আছে তার পাকস্থলীর জটিল গঠনে। গরুর মতো এদেরও রয়েছে বহু-প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট এক বিশাল পাকস্থলী, যা মূলত এক জীবন্ত গাঁজন বা ফারমেন্টেশন চেম্বার হিসেবে কাজ করে। এই প্রকোষ্ঠগুলোতে বাস করে কোটি কোটি বিশেষায়িত ব্যাকটেরিয়া, যারা সেলুলোজের মতো কঠিন আঁশকে ভেঙে ফেলে এবং পাতার মধ্যে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এক কথায়, এই হনুমানটি নিজের ভেতরে এক বিশাল জীবাণু বাহিনী পুষে রাখে, যারা বিষকে পুষ্টিতে রূপান্তরিত করে, যা এই প্রাণীকে বনের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাতাভোজী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
এই আকর্ষণীয় প্রাইমেটটির বৈজ্ঞানিক নাম Trachypithecus pileatus। এর ইংরেজি নাম ক্যাপড ল্যাঙ্গুর (Capped Langur), যা এর মাথার উপরে থাকা টুপি বা ‘ক্যাপ’-এর মতো দেখতে ঘন ও খাড়া চুলের ঝুঁটির কারণে দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশে এরা ‘মুখপোড়া হনুমান’ নামেই বেশি পরিচিত। এর কারণ হলো, এদের ধূসর বা বাদামী রঙের দেহের বিপরীতে মুখমণ্ডলটি থাকে সম্পূর্ণ কালো, যা দেখে মনে হয় যেন তা পুড়ে গেছে। এদের লম্বা, শক্তিশালী লেজটি দেহের চেয়েও দীর্ঘ হয়, যা গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে পড়ার সময় অসাধারণ ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে। এরা মূলত বাংলাদেশ, ভুটান, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মিয়ানমারের চিরসবুজ ও মিশ্র-চিরসবুজ বনাঞ্চলে বসবাস করে।
মুখপোড়া হনুমান সম্পূর্ণরূপে বৃক্ষবাসী এবং এদের জীবনযাত্রা গাছের চূড়া বা ক্যানোপি কেন্দ্রিক। এরা খুব কমই মাটিতে নামে এবং জীবনের প্রায় সকল প্রয়োজন—খাদ্য, আশ্রয় এবং বিশ্রাম—গাছের উপরেই সম্পন্ন করে। এরা অত্যন্ত সামাজিক প্রাণী এবং সাধারণত ৫ থেকে ১৫ সদস্যের দলে বাস করে। এদের দলগত কাঠামো সাধারণত ‘হারেম’ প্রকৃতির হয়, যেখানে একজন প্রভাবশালী পুরুষ কয়েকটি স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে একটি একক পরিবার গঠন করে। পুরুষটির প্রধান কাজ হলো দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অন্য দলের পুরুষদের থেকে নিজের এলাকা রক্ষা করা। অন্যদিকে, স্ত্রী হনুমানেরা সম্মিলিতভাবে শাবকদের যত্ন নেয়।
এদের প্রজনন এবং শাবক প্রতিপালনের পদ্ধতি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। একটি স্ত্রী হনুমান প্রায় ছয় মাস গর্ভধারণের পর একটিমাত্র বাচ্চার জন্ম দেয়। সদ্যজাত শাবকটির রঙ প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ধূসর হয় না, বরং এটি হয় উজ্জ্বল কমলা বা প্রায় সোনালি বর্ণের। এই উজ্জ্বল রঙটি শাবকটিকে দলের অন্য সদস্যদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে এবং দলের সকল স্ত্রী সদস্যই শিশুটির প্রতি যত্নশীল হয়ে ওঠে। এই আচরণটি ‘অ্যালোম্যাটার্নাল কেয়ার’ বা সম্মিলিত মাতৃত্ব নামে পরিচিত, যেখানে মা ছাড়াও দলের অন্য স্ত্রীরা শাবককে কোলে নেওয়া, পরিষ্কার করা এবং আগলে রাখার দায়িত্ব পালন করে। এই সম্মিলিত যত্ন একদিকে যেমন মায়ের উপর থেকে চাপ কমায়, তেমনই শাবকটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকেও বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। প্রায় ছয় মাস পর এই উজ্জ্বল রঙ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ধূসর হতে শুরু করে।
খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে এরা কঠোরভাবে পাতাভোজী। এদের খাদ্য তালিকার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই হলো কচি পাতা। পাতা ছাড়াও এরা ফুল, ফল, কুঁড়ি এবং গাছের ছাল খেয়ে থাকে। এই বিশেষায়িত খাদ্যাভ্যাসের কারণে এরা বনের বাস্তুতন্ত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা ফল খাওয়ার পর তাদের মলের মাধ্যমে বনের বিভিন্ন স্থানে বীজ ছড়িয়ে দেয়, যা বনের পুনর্জন্মে সহায়তা করে। এছাড়াও, পাতা খাওয়ার মাধ্যমে এরা গাছের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং বনের ক্যানোপির স্বাস্থ্য রক্ষায় পরোক্ষভাবে অবদান রাখে।
বাংলাদেশের এই অনন্য প্রাইমেটটি আজ বিশ্বজুড়ে ‘সংকটাপন্ন’ বা ‘Vulnerable’ হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং এর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রধান এবং সর্বাপেক্ষা বড় হুমকি হলো বাসস্থান ধ্বংস। চা বাগান ও কৃষিজমির সম্প্রসারণ, অবৈধভাবে গাছ কাটা এবং মানব বসতি স্থাপনের কারণে এদের চিরসবুজ বনের আবাসস্থল দ্রুত সংকুচিত এবং খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ছে। বাসস্থান খণ্ডিত হওয়ার ফলে এদের ছোট ছোট দলগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে তাদের জিনগত বৈচিত্র্যকে কমিয়ে আনে এবং তাদের টিকে থাকার ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। এছাড়াও, খাবারের জন্য এবং ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে চোরাশিকারও এদের অস্তিত্বের জন্য একটি বড় হুমকি।
বর্তমানে বাংলাদেশের লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা এবং কাপ্তাইয়ের মতো কয়েকটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এদের অল্প কিছু দল কোনোমতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বনের এই নীরব বাসিন্দাদের যদি রক্ষা করতে হয়, তবে প্রয়োজন কঠোর বন সংরক্ষণ নীতি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, যা মানুষ ও বন্যপ্রাণীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারে।
এই লাজুক প্রাইমেট এবং বনের বাস্তুতন্ত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে আরও জানতে ‘ঘড়িয়াল বাংলা’ পেجটি লাইক ও ফলো করে আমাদের সঙ্গে থাকুন। মুখপোড়া হনুমানকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে বনভূমির সুরক্ষা কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন? আপনার মূল্যবান মতামত কমেন্টস বক্সে আমাদের জানান।
#মুখপোড়াহনুমান #বিপন্নপ্রাণী #বাংলাদেশেরবন্যপ্রাণী