23/11/2025
সালটা ১৯৭৯। ঢাকার আকাশ আজ বড় নীল, ঠিক যেন বহু যত্নে রাখা একটি পুরোনো ছবির মতো। ছবিটি দেখলেই বুকটা হু-হু করে ওঠে, যেন সময়ের সিন্দুক থেকে এক চিলতে সোনা ঝিলিক দিয়ে উঠল। মোড়টা, যা কিনা তখনো অভিজাত 'হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল' নামে পরিচিত (পরে শেরাটন, রূপসী বাংলা হয়ে আবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল), সেখানে তখন কেমন যেন একটা স্নিগ্ধতা ছিল। আজকের মতো হর্ন আর গতির রূঢ় চিৎকার নয়, বরং একটা মন্থরতা, এক ধরনের চাপা আভিজাত্য।
অফিস ছুটি হয়েছে সবে। রমনার সবুজ ছাড়িয়ে শাহবাগ থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাসটা গঙ্গারামপুর ও মৎস্য ভবনের দিক থেকে আসা রিকশার ঘণ্টার আওয়াজের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেত। মোড়ের সেই পুরোনো বিল্ডিংটার দিকে তাকান উপরে জ্বলজ্বল করছে বিশাল বিলবোর্ডগুলো। এয়ারলাইন্স 'এরোফ্লট' এর বিজ্ঞাপন, তার পাশেই মাথা উঁচু করে আছে 'গ্রামীণ ব্যাংক লিমিটেড'-এর লোগো। নীচে ছোট ছোট দোকানগুলোর উপর লেখা 'বাসুরা'। এই নামগুলো যেন শুধু নাম নয়, এক একটা সময়খণ্ডকে ধরে রেখেছে।
বখতিয়ার সাহেব, আমাদের গল্পের নায়ক, তখন সবেমাত্র তাঁর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। হাতে ছাতা, পরনে ফিকে নীল শার্ট, আর চোখে একজোড়া পুরোনো দিনের ফ্রেমের চশমা। প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে তিনি মোড়টা পার হন। রিকশা নিতে তাঁর মন চায় না, হাঁটাটাই তাঁর প্রিয়। হোটেলের বারান্দার নীচে, যেখানে ছোট দোকানগুলোর ছায়া পড়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।
এই মোড়টা তাঁর কাছে শুধু একটা রাস্তা নয়, এক ইতিহাসের সাক্ষী। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি! এই হোটেলকে ঘিরে কত আন্তর্জাতিক ঘটনা, কত সাংবাদিকের আনাগোনা সবই যেন চাপা পড়ে আছে এই পথের ধুলোয়।
আজ মোড়টা যেন একটু বেশি শান্ত। একজন লোক গামছা পরে দ্রুত পায়ে রাস্তা পার হচ্ছেন, হয়তো বা দিনের কাজ সেরে ঘরে ফিরছেন। আরেকজন ধীরেসুস্থে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন। মোড়ের বাঁকে দাঁড়ানো হাতে-টানা রিকশাগুলো তখনো ঢাকার গতির প্রতীক। এই মোড়েই বখতিয়ার সাহেব প্রথম তাঁর স্ত্রী রওশন আরাকে দেখেছিলেন, এক বসন্তের বিকেলে, বইমেলা থেকে ফেরার পথে। রওশন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, খয়েরি রঙের শাড়ি আর চোখে কাজল এক ঝলকেই মন কেড়ে নিয়েছিল তাঁর। আজ তাঁরা দু'জনেই বৃদ্ধ, কিন্তু এই মোড়টা পার হলেই তাঁর কানে রওশনের সেই খিলখিল হাসি আজও যেন শুনতে পান।
বখতিয়ার সাহেব একবার ভাবলেন, একটা রিকশা নেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই থমকে গেলেন। এই মোড়ের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি বিলবোর্ডের অক্ষর, এমনকি 'গ্রামীণ ব্যাংক'-এর লোগোটাও তাঁকে যেন বলছে, "থামুন, আরও একটু দেখুন। এই সময়টা আর ফিরে আসবে না।"
তিনি চশমাটা খুলে মুছলেন, চারপাশটা আরেকবার দেখলে এ্যারোফ্লট, গ্রামীণ ব্যাংক, বাসুরা। সবই তখন ছিল নতুন করে পথচলার ইঙ্গিত। সেই বিকেলে দাঁড়িয়ে বখতিয়ার সাহেব যেন শুধু ঢাকার রাস্তা দেখছিলেন না, দেখছিলেন তাঁর জীবনটা কে যা ছিল ঠিক এই মোড়টার মতোই আলো-ছায়াময়, আশা আর স্মৃতির বুনোটে বোনা। তারপর তিনি ধীরে ধীরে পথ চলতে শুরু করলেন, তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে চাপা পড়ে থাকলো এক হারিয়ে যাওয়া শহরের, এক নস্টালজিক সন্ধ্যার গল্প।