বাংলাদেশ

বাংলাদেশ অতীতের শিকড় খুঁজি, জানি বাংলাদেশকে নতুন করে
(536)

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত একটি ছোট দেশ, উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্বে মায়ানমার। এর একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতি রয়েছে যা হাজার হাজার বছর আগের। দেশটির জনসংখ্যা 160 মিলিয়নেরও বেশি, এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে।

দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর থেকে, দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন

্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যদিও এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি দ্বারা চালিত হয়, ধান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসল। দেশটি টেক্সটাইল এবং পোশাকের একটি প্রধান রপ্তানিকারকও বস্ত্র শিল্প এর রপ্তানির একটি বড় শতাংশের জন্য দায়ী।

বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন সহ বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত, যা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। পাহাড়পুরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ এবং বাগেরহাটের মসজিদ শহর সহ দেশের অসংখ্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন রয়েছে।

অনেক অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এমন কয়েকটি বিষয় যা দেশকে অবশ্যই সমাধান করতে হবে। যাইহোক, বাংলাদেশী জনগণের স্থিতিস্থাপকতা এবং দৃঢ় সংকল্প দেশটিকে অনেক ক্ষেত্রে অগ্রগতি করতে দিয়েছে, এবং আশা করা যায় যে বাংলাদেশ আগামী বছরগুলিতে বৃদ্ধি ও বিকাশ অব্যাহত রাখবে।

01/12/2025

ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ১৯৭২। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, চারদিকে নতুনের গন্ধ, আর বুকভরা আশা।

এটা আজকের কংক্রিটের জঞ্জালে ঢাকা গুলিস্তান নয়। মাথার ওপর তখনো হানিফ ফ্লাইওভারের ছাদ নেই, আকাশটা কী বিশাল আর উদার! রাস্তায় রিকশার রাজত্ব, টুং-টাং শব্দে মুখর চারপাশ। মানুষগুলোর পোশাকে, চলনে কেমন একটা সাদামাটা ভাব, অথচ কী ভীষণ প্রাণশক্তি!

তখন গুলিস্তান মানেই ছিল আভিজাত্য আর বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। গুলিস্তান সিনেমা হল, নাজ সিনেমা হল সিনেমা প্রেমীদের ভিড়, আর ফুটপাতে সস্তায় বই বা ক্যাসেট খোঁজা। হয়তো ছবির ওই ভিড়ের মাঝেই কেউ একজন হেঁটে যাচ্ছেন পকেটে প্রিয় মানুষের জন্য একটা চিঠি নিয়ে, কিংবা কেউ বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ভাবছেন নতুন দেশটাকে কীভাবে গড়বেন।

আজকের এই হট্টগোল আর যান্ত্রিক শহরের ভিড়ে এই ছবিটা দেখলে বুকের ভেতরটা হু-হু করে ওঠে। মনে হয়, ইশ! যদি একবার টাইম মেশিনে করে সেই বাহাত্তরের ঢাকায় ফিরে যাওয়া যেত! এক কাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে দেখতাম সেই সময়টাকে।

শহরটা বদলে গেছে, হারিয়ে গেছে সেই গুলিস্তান সিনেমা হল, হারিয়ে গেছে সেই খোলা আকাশ। কিন্তু এই ছবিটা সাক্ষী দিচ্ছে আমাদের একটা সোনালী অতীত ছিল।

30/11/2025

সালটা ১৯৬৭। তখনো তো পার্কের নাম ভিক্টোরিয়া। যদিও দেশের মানুষ ততদিনে একে বাহাদুর শাহ পার্ক বলেই ডাকতে শুরু করেছে, কিন্তু ওই নামটা যেন একটা পুরনো অভ্যাসের মতো জিভে লেগে ছিল।

ঐ যে দেখছো রাজকীয় প্রবেশদ্বার, আর তার পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো গম্বুজ আর তোরণ; ওগুলো দেখলেই আমার মনটা কেমন যেন হু-হু করে ওঠে। মনে পড়ে যায় ইসমাইল মিয়ার কথা।

ইসমাইল মিয়া সে আমাদের মহল্লার সবচেয়ে ফুর্তিবাজ রিকশাওয়ালা। দুপুর রোদে পিচের রাস্তাটা যখন তাপে চিকচিক করতো, ঠিক তখনি তার সবুজ রঙের রিকশাটা ঘণ্টি বাজিয়ে আসতো। রিকশার পিছনে সে এঁকে রেখেছিল একটা জলরঙের শাপলা ফুলের ছবি, আর উপরে হাতে লেখা "পুবালী হাওয়া"।

ঐ ছবিতে, ডানদিকে যে রিকশাটা দেখা যাচ্ছে, ওটা হয়তো ইসমাইল মিয়ার নয়, কিন্তু ঐ যে চালকটি, তার মুখটাও তো সেই ক্লান্তি আর নীরবতার ভাষা বলতো। ১৯৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিস্তম্ভটা তখন পার্কে নতুন, কিন্তু তার নিচে চাপা পড়ে থাকা ১৮৫৭-র ফাঁসিকাঠের ইতিহাসটা কেমন যেন একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসের মতো পার্কের বাতাসে ঘুরে বেড়াত।

ঐ সময়টা ছিল বড় অস্থির, বড় উত্তেজনার। ঢাকার এই মোড়টা ছিল যেন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। মানুষ আসছে, মানুষ যাচ্ছে। রিকশা, হাতে টানা ঠেলাগাড়ি, আর দু'একটা টেম্পো তাদের অবিরাম শব্দ। পথের ধারে গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো মানুষগুলো হয়তো জগন্নাথ কলেজের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্র, যারা কোনো বড় মিছিল বা জমায়েতের জন্য অপেক্ষা করছে। অথবা হয়তো সদরঘাট থেকে মালপত্র নিয়ে আসা কোনো ক্লান্ত কুলি, যে একটু জিরিয়ে নিতে চাইছে।

কিন্তু ইসমাইল মিয়ার রিকশায় চড়ে আমি যখন ঐ তোরণের পাশ দিয়ে যেতাম, আমার চোখে পড়তো পার্কে বসা তরুণ-তরুণীদের। তারা চাপা গলায় কথা বলতো, হয়তো স্বপ্ন বুনতো একটি নতুন দেশের। হয়তো তাদের হাতে থাকতো পুরোনো কোনো বাংলা বই, যা তখনকার দিনের নতুন দিনের বার্তা বহন করে এনেছিল।

ঐ টাওয়ার ঘড়িটা সেন্ট থমাস চার্চের কাছে তখনও তার সময় ভুলতো না। তার গম্ভীর ঢং-ঢং শব্দে যেন ঢাকা শহরের হৃৎস্পন্দন শোনা যেত। ঐ সময়কার ঢাকার রাস্তায় এত ব্যস্ততা ছিল, কিন্তু একটা নিস্তব্ধতাও যেন মিশে ছিল। একটা চাপা উদ্বেগ, একটা স্বপ্ন দেখার সাহস, আর একটা ইতিহাসের ভার।

আর আমি? আমি শুধু ঐ তোরণের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, কত শত বছরের গল্প জমে আছে এই ধুলোমাখা রাস্তায়! ইসমাইল মিয়া তার রিকশার প্যাডেলে চাপ দিত, আর "পুবালী হাওয়া" আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত সদরঘাটের কোলাহলের দিকে, যেখানে বুড়িগঙ্গার জল তখনও ইতিহাসের কথা বলতো।

29/11/2025

নভেম্বর, ১৮৭২। সন্ধ্যা নামার আগে বুড়িগঙ্গার জলে যখন সোনালী আভা, ঠিক সেই সময়কার কথা। হাওয়া বইছে আলতো করে, জলের ঢেউয়ে দুলছে দুটো ছোট, পাতা-ছাউনি দেওয়া নৌকা। মাঝিরা হয়তো দিনের কাজ শেষে তীরে ফিরেছে, অথবা হয়তো শেষ খেপের জন্য তৈরি হচ্ছে।

​বুড়িগঙ্গার এই বিশেষ বাঁকটি ছিল প্রাচীন ঢাকার দুটি ভিন্ন ইতিহাসের মিলনক্ষেত্র।
​নদীর এক কিনারায়, আকাশ ফুঁড়ে মাথা তুলে আছে এক কোণাকৃতি চূড়ার মন্দির সময়ের সঙ্গে তার রং ফিকে হয়ে এলেও, তার গাম্ভীর্য বিন্দুমাত্র কমেনি। মন্দিরের চূড়ায় লেগে থাকা শেষ আলোটুকু যেন জানান দেয়, এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শঙ্খ আর উলুধ্বনি বাজে, যা শতকের পর শতক ধরে এই শহরের আধ্যাত্মিকতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার নিচে, মাটির পাড় ঘেঁষে হয়তো দু-একজন পুণ্যার্থী বা সাধারণ মানুষ হয়ে বসে আছে, তাদের চোখে দিনের শেষ ক্লান্তি।
​আর ঠিক তার কাছাকাছি, অথবা নদীর পার ধরে একটু হেঁটে গেলেই, দেখা যায় লাল ইটের তৈরি বিশাল, দীর্ঘ স্থাপত্যটি। তার সারিবদ্ধ তোরণ (arches) আর ছোট গম্বুজগুলো মোগল বা দেশীয় ধনী স্থাপত্যের পরিচয় বহন করছে। এটি হয়তো কোনো নবাবের কাটরা, বড় সরাইখানা বা পুরোনো রাজবাড়ি যেখানে দিনের বেলায় সওদাগরদের হাঁকডাক আর ব্যবসার ব্যস্ততা ছিল। এখন সেই তোরণগুলোর ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন মানুষ, তাদের ভঙ্গিতেও যেন এক দীর্ঘদিনের অবসাদ।

​নদীর জল এই দুটি কাঠামোকেই ছুঁয়ে যায়। নৌকাগুলো প্রথমে মন্দিরকে ছোঁয়, তারপর লাল দালানকে। মাঝির কানে আসে মন্দিরের ঘণ্টার শব্দ, আবার এই দালানের অন্দরের কোনো পুরোনো গানের সুর।

​এই দুটি স্থাপত্য ধর্ম ও আভিজাত্যের প্রতীক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল বুড়িগঙ্গার জলের ওপর নিজেদের প্রতিচ্ছবি ফেলে। তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ ছিল না। নৌকা ছিল তাদের যোগাযোগের সেতু, আর বুড়িগঙ্গার জল ছিল তাদের জীবনরেখা। ১৮৭০-এর দশকের ঢাকা এইভাবেই বাস করত বহুত্বের মাঝে এক অবিচ্ছিন্ন স্রোত নিয়ে। এই জল, এই স্থাপত্য আর এই মানুষগুলো মিলেমিশে তৈরি করেছিল এক হারানো দিনের গল্প যার প্রতিটি ফ্রেমে মিশে আছে গভীর নস্টালজিয়া।

28/11/2025

ধুলো ওড়া দুপুর, ১৯৭৫ সাল। ঢাকা শহরের নীলক্ষেত মোড়। ভিডিওটি সেই সময়কার বলাকা সিনেমার সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রধান রাস্তার দৃশ্য। বাতাসে তখনও যেন নতুন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন আর সদ্য ঘটে যাওয়া ইতিহাসের ভার মেশানো এক চাপা উত্তেজনা।

গরমকালের শেষ। শ্রাবণের ভেজা ভাবটুকু মুছে গিয়ে এখন চারপাশে রুক্ষতা। নীলক্ষেত মোড়ের ধুলো ওড়া চওড়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে আসিফ। পরনে তার পাটভাঙা শার্ট আর পাঞ্জাবি। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, তাতে কিছু পুরনো বই আর কিছু নতুন ভাবনা। তার চোখ রাস্তার ধারের চায়ের দোকান, ছেঁড়া পোস্টার আর বলাকা সিনেমার বিশাল হলুদ দালানটিকে ছাড়িয়ে যায় না।

সিনেমা হলের উপরে তখনও জ্বলজ্বল করছে বিশাল অক্ষরে লেখা "বলাকা"। পাশে আরও দু-একটা সিনেমার অস্পষ্ট ছবি। সে সময়ের সাদামাটা বিজ্ঞাপনগুলো যেন এক পুরনো দিনের গান। আসিফের মনে পড়ল, কতবার রেহানার সাথে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে, শেষ মুহূর্তের টিকেট পাওয়ার আশায়।

বলাকার সামনের চত্বরটা সবসময়ই যেন এক মিলনমেলা। রিকশা, সাইকেল আর হাতে টানা গাড়ির ভিড়। মানুষজন মাথা নিচু করে চলছে, কেউ ব্যস্ত হাতে ছাতা খুলে ধরেছে রোদের তেজ থেকে বাঁচতে। এদের মধ্যেই আসিফ খুঁজে নেয় রেহানাকে।

রেহানা দাঁড়িয়ে আছে হলের একটু দূরে, একটা পুরনো ইলেকট্রিক পোলের কাছে। তার হাতে একটি বই, সম্ভবত জীবনানন্দের। রেহানাকে দেখে আসিফের ঠোঁটে হাসি ফোটে, "কী রেহানা, আজকাল তোকে দেখাই যায় না। সব বই কি নীলক্ষেতের মোড়েই শেষ করে দিবি নাকি?"

রেহানা মৃদু হাসে, "তোদের মতো রাজনীতির ঝোড়ো হাওয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, আসিফ। এই বইগুলোই আমার আশ্রয়। তাছাড়া, জানিস তো আগস্ট মাসের পর থেকে শহরটার চেহারা কেমন যেন বদলে গেছে।"

আসিফ মাথা নাড়ে। আগস্টের ১৫ তারিখের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা, যখন স্বাধীন বাংলার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, তারপর থেকে যেন শহরের বাতাস ভারী হয়ে গেছে। হাসি-খুশি মানুষজনও কেমন যেন তটস্থ। বলাকার আলো ঝলমলে ছবিগুলোও এখন যেন একটু ম্লান।

তারা হাঁটতে শুরু করে। নীলক্ষেতের ফুটপাতের দিকে। এখানে পুরোনো বইয়ের হাজারো দোকান। এই মোড়টা শুধু একটি সংযোগস্থল নয়, এটা যেন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক আড্ডা আর স্বপ্নের আঁতুড়ঘর।

হাঁটতে হাঁটতে আসিফ বলল, "শোন, একটা নতুন নাটক নিয়ে কথা বলছিলাম। স্বাধীনতাটা তো শুধু কাগজে কলমে নয়, রেহানা। আমাদের ভেতরের শক্তিটা জাগাতে হবে। সংস্কৃতিই পারবে আবার সেই সাহসটা ফিরিয়ে আনতে।"

রেহানা এক লহমায় রাজি হয়ে গেল, "বলাকাতেই হবে, কেমন? এই সিনেমা হলটা শুধু সিনেমা দেখানোর জায়গা নয়, এটা আমাদের তারুণ্যের প্রতীক। কাল সন্ধ্যায় দেখা করিস। আমরা ঠিক এই মোড়েই দাঁড়াব। এই শহরের সব হতাশা আর গুমোট ভাব একদিন কাটবে। আমরাই কাটাব।"

সন্ধ্যার পর, মোড়ের কোলাহল যখন কমে এলো, তখন আসিফ একা দাঁড়িয়ে থাকে। বলাকা হলের নিয়ন আলোয় শহরের ধুলো আরও সোনালী দেখায়। দূরে বিদ্যুতের তারগুলো মিশে গেছে আকাশের সাথে, যেন এক অসম্পূর্ণ কবিতা।

আসিফের মনে হলো, এই মোড়টা শুধু ইট-পাথরের নয়। এটা প্রজন্মের পর প্রজন্মের আশা-স্বপ্ন, বিদ্রোহ আর ভালোবাসা বহন করে চলেছে। ১৯৭৫ সালের এই ম্লান দুপুরে, এই নীলক্ষেত মোড়ই তাকে আগামীকালের জন্য নতুন করে বাঁচার প্রেরণা যোগালো।

27/11/2025

১৯০৪ সালের ধোলাইখাল, ধোলাই খালের উপর এই লোহার পুল, যার বয়স এক শতাব্দীরও বেশি, সে শুধু ক'টা ইস্পাতের কাঠামো নয়, সে হলো এক জীবন্ত সাক্ষী। এই ছবিটি যখন তোলা হয়েছিল, সালটা ১৯০৪। ঢাকা শহর তখন ঘুম ভাঙা এক কিশোরীর মতো, আস্তে আস্তে সেজে উঠছে।

পুলটার দিকে তাকান দু'পাশে শক্ত পাথরের গাঁথুনি, মাঝখানে তির তির করে কাঁপা তারের বাঁধন। নিচে ধোলাই খাল, এখনকার মতো শীর্ণ নয়, তখন সে ছিল আরও প্রাণবন্ত। খাল দিয়ে ছোট ছোট নৌকা যেত, পাল তুলে নয়তো বৈঠার ছপ ছপ শব্দে। মাঝি হাঁক দিত, আর ঢেউগুলো শান্তভাবে দু'পাশের মাটির পাড়ে লুটিয়ে পড়ত।

পুলটার ওপর দেখুন! কী ভিড়! কিন্তু আজকের মতো ব্যস্ততা নেই তাতে। মানুষজন হেঁটে চলেছে, তাদের চালচলনে এক ধরণের স্থিরতা। হয়তো ওনারা ফার্সিগঞ্জ থেকে গেন্ডারিয়ার দিকে যাচ্ছেন, কিংবা আসছেন শাঁখারিবাজারের পথে।

কেউ মাথায় করে নিয়ে চলেছে ডাল-ভাতের চাল, কেউ কাঁধে গামছা ফেলে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। মেয়েদের পরনে চওড়া পাড়ের শাড়ি, ছেলেদের গায়ে ফতুয়া বা আচকান। তাদের পায়ে নেই আধুনিক জুতো, ধুলো মাখা খালি পায়ে বা চটিতেই তাদের পথচলা। সেতুর প্রতিটি তার যেন শত শত মানুষের পায়ের স্পর্শে গুনগুন করছে এক পুরোনো দিনের গান।

সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো খালের ধারে, নিচে। শুকনো পাড় ধরে একজন মানুষ, হয়তো সেদিনের ঢাকা শহরের কোনো সাধারণ বাসিন্দা নদীর ধারে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। শান্ত, সবুজ বনানীর ছায়া পড়েছে খালের ঘোলাটে জলে। তখনো ইট-পাথরের জঙ্গল এমন করে শহরটাকে গিলে খায়নি। বাতাস ছিল শুদ্ধ, আর সন্ধ্যা নামতো জোনাকিদের আলো নিয়ে।

আজ হয়তো এই খাল প্রায় বিলীন, সেতুর জায়গায় হয়তো আধুনিক কোনো ব্যস্ত সড়ক। কিন্তু এই ছবিটা, এই লোহার পুলটা, আজও আমাদের কানে ফিসফিস করে বলে যায় সেই সময়ের কথা যখন জীবন ছিল সরল, পথচলা ছিল ধীরে, আর প্রতিটি দিন কাটত প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। এই পুল শুধু দু'পাড়ের মানুষের মিলনক্ষেত্র ছিল না, এ ছিল ঢাকা শহরের স্নেহময় আলিঙ্গন।

26/11/2025

১৯৬৯ সালের এই ছবিটি খুঁজে পেলাম, আর মনটা যেন এক নিমিষে পঞ্চাশ বছর পেছনে চলে গেল। ১৯৬৯-এর উত্তাল সময়, সঠিক তারিখ হয়তো নেই, কিন্তু পরিবেশটা বলে দিচ্ছে এটা হরতালের ঢাকা, তৎকালীন জিন্নাহ এভিনিউ। আজকের প্রাণবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ।

দেখুন, রাস্তাটা কী ভীষণ ফাঁকা! যেখানে আজকের দিনে তিল ধারণের জায়গা থাকে না, সেখানে এই রাজপথ যেন হাঁসফাঁস করছে এক অসহ্য নীরবতায়। হরতাল শুধু একটা কর্মসূচী ছিল না, ছিল আমাদের প্রতিবাদের ভাষা, ন্যায্য অধিকারের দাবি জানানোর এক অমোঘ প্রতীক।

রাস্তার ঠিক মাঝে পড়ে থাকা ঘোড়ার গাড়ির পিছনের অংশ। এই গাড়ি শুধু পণ্য বহন করত না, বহন করত এ শহরের জীবনধারণের ভার। আজ সে স্থির, কারণ শহর থমকে গেছে এক বৃহত্তর দাবির সামনে।

এভিনিউয়ের পাশে উঁচু দালানগুলো আজও আছে, কিন্তু তখন তাদের গায়ে লেগে ছিল পুরোনো ঢাকার এক অদ্ভুত ধূসরতা। দালানে সাঁটা সেই পুরোনো বাংলা সাইনবোর্ডগুলো প্রতিটি অক্ষর যেন প্রতিধ্বনিত করত ভাষার অধিকার আর স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা।

আর পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কয়েকজন মানুষ... তাদের চোখে হয়তো উদ্বেগ, হয়তো বা দৃঢ় প্রত্যয়। তারা জানে, আজকের এই নীরবতা কাল নতুন কোনো দিনের সূচনা করবে।

এই ছবিটি আমার কাছে শুধু একটি ঐতিহাসিক দলিল নয়। এটা সেই সময়ের আবেগ, সাহস আর স্বপ্নের প্রতীক। যে জিন্নাহ এভিনিউ একদিন অচেনা শাসকের নামে পরিচিত ছিল, এই হরতাল আর প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই তা ধীরে ধীরে আমাদের হয়ে উঠছিল, বাঙালীর আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছিল।

পরবর্তীতে এই পথই সাক্ষী হয়েছে কত সংগ্রাম, কত রক্ত আর অবশেষে বিজয়ের। জিন্নাহ এভিনিউ থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে রূপান্তর শুধু একটা নাম বদল নয়, এটা আমাদের জাতির ইতিহাসের পালাবদল।

আজ এই পথে হাঁটতে গেলে আমি মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করি। চেষ্টা করি শুনতে সেই থমকে থাকা নীরবতার মাঝে লুকিয়ে থাকা মুক্তির ডাক।

স্মৃতির পাতায় ধরে রাখা সেই দিনগুলো, যা আমাদের আজকের ঠিকানা।

25/11/2025

তোপখানা রোড। শুধু একটি রাস্তার নাম নয়, আমার কৈশোর আর তারুণ্যের স্মৃতিতে আঁকা এক জীবন্ত ছবি। বিশেষ করে ১৯৬৯ সালের কথা মনে পড়লে, এক ফালি রোদ আর ধুলোমাখা বাতাসের গন্ধ যেন আজও নাকে আসে।

তখনও ভোরের আলো সবেমাত্র ঢাকা শহরের বুকে নিজের উষ্ণতা ঢেলে দিচ্ছে। ছবিটি যেন সেই সময়েরই এক ঝলক ফাঁকা রাজপথে গরুর গাড়ির চাকার ক্যাঁচকোঁচ শব্দ আর তার সাথে হেঁটে চলা মানুষগুলোর পদধ্বনি।

জানেন, প্রেস ক্লাবটা তখন ছিল এক তীর্থস্থান। শুধু সাংবাদিকদের জন্য নয়, গোটা ঢাকা শহরের জন্য। তোপখানা রোডের এই মোড়টাই যেন ছিল হৃদস্পন্দন। সকালের দিকে, যখন সাদা ধবধবে ইউএসআইএস (USIS) বিল্ডিংয়ের (বর্তমানে আমেরিকান সেন্টার) গায়ে নরম রোদ এসে পড়ত, তখন এখানকার পরিবেশটা ছিল এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা আর উত্তেজনার মিশ্রণ।

ভিডিওতে দেখা গরুর গাড়িটা যেন সেই সময়ের স্থির গতির প্রতীক। শহরের যান্ত্রিকতা তখনও পুরোপুরি গ্রাস করেনি। শ্লথ লয়ে, বোঝা নিয়ে চলা এই গাড়িগুলো ছিল সেই পুরনো দিনের মেঠো গন্ধের শেষ রেশ। গাড়োয়ানের কোমরে পেঁচানো গামছা, আর গরু দুটোর শান্ত চাউনি দেখে মনে হয়, তারা যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।

লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরা মানুষটি যেন দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছেন কোনো এক জরুরি গন্তব্যে। তাঁর হাতে হয়তো খবরের কাগজের সদ্য প্রকাশিত সংখ্যা। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল এক দৃঢ়তা, যা কেবল ১৯৬৯-এর মতো একটি অগ্নিগর্ভ সময়েই দেখা যেত।

তোপখানা রোডের এই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে, ক্লাবের ভেতরের কফির গন্ধ। বাইরে চাপা গুঞ্জন রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্লোগানের প্রস্তুতি, আর আগামীর জন্য স্বপ্ন দেখা। ক্লাবের ভেতরের বৈঠকগুলো ছিল উত্তপ্ত, কিন্তু বাইরে এই রাজপথ তখনো শান্ত, যেন ঝড়ের আগে প্রকৃতির নীরবতা।

ঐ সাদা ইউএসআইএস ভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হতো, বাইরের পৃথিবীর সব খবর যেন এখানেই এসে জড়ো হয়। ভবনটির স্থাপত্যে ছিল এক ঔপনিবেশিক ছাপ, যা আধুনিক ঢাকার সাথে মিশে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

আজকের দ্রুতগতির ঢাকা থেকে এই ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। তখন মানুষের চোখে ছিল স্বপ্ন, মনে ছিল এক নতুন দেশের জন্ম দেওয়ার প্রত্যয়। রাজপথ ছিল চওড়া, কিন্তু জীবন ছিল সরল, আর তার গতি ছিল ধীর। গরুর গাড়ির গতিতে জীবন চললেও, মনের ভেতরে চলছিল সময়ের চেয়ে দ্রুত এক পরিবর্তন মুক্তির আন্দোলন।

ঐ তোপখানা রোড, ঐ প্রেস ক্লাব তারা শুধু ইট-কাঠের কাঠামো ছিল না। তারা ছিল আন্দোলনের কেন্দ্র, সাহসের উৎস, আর আমাদের জাতিসত্তার প্রথম সূর্যোদয়ের প্রতীক। সেই রোদ, সেই ধুলো, সেই গরুর গাড়ির শব্দ সবই যেন আজকের দিনেও এক গভীর নস্টালজিয়া নিয়ে ফিরে আসে।

24/11/2025

তখন আমাদের হাতে স্মার্টফোন ছিল না, ছিল না কোনো মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ। ছিল শুধু কথা দেওয়া আর কথা রাখার বিশ্বাস।

"বিকেল ৪টায় জিরো পয়েন্টে থাকবো" ব্যাস, এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল। জিপিও-র মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা, হাতে হয়তো এক ঠোঙা বাদাম। রাস্তা দিয়ে হুডখোলা জিপ আর পুরোনো আমলের বেবি ট্যাক্সিগুলো ভোঁ ভোঁ করে চলে যেত। জ্যাম ছিল না, ছিল না আজকের এই দমবন্ধ করা ভিড়।

মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষটা দেরি করতো। কোনো উপায় ছিল না ফোন করে জিজ্ঞেস করার, "কোথায় তুমি?" শুধু ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করা। সেই অপেক্ষার মাঝেও একটা অদ্ভুত ভালোলাগা ছিল। এখনকার মতো প্রতি সেকেন্ডের আপডেট না পেয়েও মানুষ তখন একে অপরকে খুঁজে নিতো ঠিকই।

দেখুন, রাস্তাগুলো কী ফাঁকা! যেন সময়টা এখানে থমকে আছে। এই জিরো পয়েন্ট শুধু একটা মোড় নয়, এটা আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া ধীরলয়ের ঢাকার সাক্ষী।

কে কে মিস করেন সেই যান্ত্রিকতাবিহীন ঢাকা শহরকে? ❤️

23/11/2025

সালটা ১৯৭৯। ঢাকার আকাশ আজ বড় নীল, ঠিক যেন বহু যত্নে রাখা একটি পুরোনো ছবির মতো। ছবিটি দেখলেই বুকটা হু-হু করে ওঠে, যেন সময়ের সিন্দুক থেকে এক চিলতে সোনা ঝিলিক দিয়ে উঠল। মোড়টা, যা কিনা তখনো অভিজাত 'হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল' নামে পরিচিত (পরে শেরাটন, রূপসী বাংলা হয়ে আবার ইন্টারকন্টিনেন্টাল), সেখানে তখন কেমন যেন একটা স্নিগ্ধতা ছিল। আজকের মতো হর্ন আর গতির রূঢ় চিৎকার নয়, বরং একটা মন্থরতা, এক ধরনের চাপা আভিজাত্য।

​অফিস ছুটি হয়েছে সবে। রমনার সবুজ ছাড়িয়ে শাহবাগ থেকে আসা মৃদুমন্দ বাতাসটা গঙ্গারামপুর ও মৎস্য ভবনের দিক থেকে আসা রিকশার ঘণ্টার আওয়াজের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যেত। মোড়ের সেই পুরোনো বিল্ডিংটার দিকে তাকান উপরে জ্বলজ্বল করছে বিশাল বিলবোর্ডগুলো। এয়ারলাইন্স 'এরোফ্লট' এর বিজ্ঞাপন, তার পাশেই মাথা উঁচু করে আছে 'গ্রামীণ ব্যাংক লিমিটেড'-এর লোগো। নীচে ছোট ছোট দোকানগুলোর উপর লেখা 'বাসুরা'। এই নামগুলো যেন শুধু নাম নয়, এক একটা সময়খণ্ডকে ধরে রেখেছে।

​বখতিয়ার সাহেব, আমাদের গল্পের নায়ক, তখন সবেমাত্র তাঁর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। হাতে ছাতা, পরনে ফিকে নীল শার্ট, আর চোখে একজোড়া পুরোনো দিনের ফ্রেমের চশমা। প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে তিনি মোড়টা পার হন। রিকশা নিতে তাঁর মন চায় না, হাঁটাটাই তাঁর প্রিয়। হোটেলের বারান্দার নীচে, যেখানে ছোট দোকানগুলোর ছায়া পড়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন।

​এই মোড়টা তাঁর কাছে শুধু একটা রাস্তা নয়, এক ইতিহাসের সাক্ষী। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি! এই হোটেলকে ঘিরে কত আন্তর্জাতিক ঘটনা, কত সাংবাদিকের আনাগোনা সবই যেন চাপা পড়ে আছে এই পথের ধুলোয়।

​আজ মোড়টা যেন একটু বেশি শান্ত। একজন লোক গামছা পরে দ্রুত পায়ে রাস্তা পার হচ্ছেন, হয়তো বা দিনের কাজ সেরে ঘরে ফিরছেন। আরেকজন ধীরেসুস্থে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন। মোড়ের বাঁকে দাঁড়ানো হাতে-টানা রিকশাগুলো তখনো ঢাকার গতির প্রতীক। এই মোড়েই বখতিয়ার সাহেব প্রথম তাঁর স্ত্রী রওশন আরাকে দেখেছিলেন, এক বসন্তের বিকেলে, বইমেলা থেকে ফেরার পথে। রওশন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, খয়েরি রঙের শাড়ি আর চোখে কাজল এক ঝলকেই মন কেড়ে নিয়েছিল তাঁর। আজ তাঁরা দু'জনেই বৃদ্ধ, কিন্তু এই মোড়টা পার হলেই তাঁর কানে রওশনের সেই খিলখিল হাসি আজও যেন শুনতে পান।

​বখতিয়ার সাহেব একবার ভাবলেন, একটা রিকশা নেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই থমকে গেলেন। এই মোড়ের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি বিলবোর্ডের অক্ষর, এমনকি 'গ্রামীণ ব্যাংক'-এর লোগোটাও তাঁকে যেন বলছে, "থামুন, আরও একটু দেখুন। এই সময়টা আর ফিরে আসবে না।"
​তিনি চশমাটা খুলে মুছলেন, চারপাশটা আরেকবার দেখলে এ্যারোফ্লট, গ্রামীণ ব্যাংক, বাসুরা। সবই তখন ছিল নতুন করে পথচলার ইঙ্গিত। সেই বিকেলে দাঁড়িয়ে বখতিয়ার সাহেব যেন শুধু ঢাকার রাস্তা দেখছিলেন না, দেখছিলেন তাঁর জীবনটা কে যা ছিল ঠিক এই মোড়টার মতোই আলো-ছায়াময়, আশা আর স্মৃতির বুনোটে বোনা। তারপর তিনি ধীরে ধীরে পথ চলতে শুরু করলেন, তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে চাপা পড়ে থাকলো এক হারিয়ে যাওয়া শহরের, এক নস্টালজিক সন্ধ্যার গল্প।

22/11/2025

সালটা ১৯৬৫। আমি তখন নিতান্তই বালক, কিন্তু লক্ষ্মীবাজার মোড়ের সেই দিনগুলো এখনও যেন চোখের কোণে ঝিলিক দেয়।

দেখুন, এই যে মোড়টা, এখনকার মতো চারদিকে আকাশছোঁয়া দালান আর গাড়ির কর্কশ হর্ন ছিল না। চারিদিকে ছিল ঘন সবুজ গাছের ছায়া। ছবিটির ডান দিকে দেখুন, সেই হলদেটে পুরোনো দালানটা। হয়তো ওটাই ছিল কোনো গণ্যমান্য উকিল বাবুর বাড়ি, কিংবা কোনো প্রাচীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস। তার গায়ে লেগে থাকা পুরোনো ঐতিহ্যের গন্ধ যেন আজও পাচ্ছি।

রাস্তা জুড়ে তখন রাজা ছিল সাইকেল রিকশাগুলো। তাদের পেডালের তালে তালে আর মিহি ঘণ্টা "টুং টাং" শব্দে মুখরিত থাকত চারিদিক। এই ছবিতেও দেখুন, কত রিকশা! মাঝখানে সেই অদ্ভুতদর্শন ট্র্যাফিক সংকেতের কাঠামো! দুটো গোল চাকার মতো সিগন্যাল নিয়ে সে যেন গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার কাজও বোধহয় ততটা কঠিন ছিল না, কারণ ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করত মানুষ, যন্ত্র নয়।

আর ওই দেখুন! ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে লাল আর সাদার ডোরাকাটা ছাদওয়ালা সেই বাসটি! যেন সেদিনের ঢাকা শহরের প্রাণ! বাসের সিটে বসে থাকা মানুষগুলোর চোখে মুখে ছিল এক ভিন্ন রকম নিশ্চিন্ততা, এক শান্ত সরল জীবনের ছবি।

দিনের শেষে, মোড়ের কোণে জমে উঠত ছোটখাটো আড্ডা। কেউ আসত খবরের কাগজ হাতে, কেউবা মিষ্টি পানের খোঁজে। চারপাশে ধুতি-পাঞ্জাবি আর লম্বা ঝুলের শাড়ি পরা মানুষজনের আনাগোনা। প্রত্যেকের চলনে এক ধীর-স্থির ছন্দ। এখনকার মতো জীবনের এত দ্রুত গতি ছিল না তখন। লক্ষ্মীবাজারের এই মোড়টাই ছিল যেন গোটা পাড়ার কেন্দ্রবিন্দু হাসি, গল্প, কেনাকাটা, সবকিছুর সাক্ষী।

এই মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি রিকশাওয়ালার কপালে লেগে থাকা ঘাম, ফুটপাতের ওপর দিয়ে হেঁটে চলা প্রতিটি পথিকের ব্যস্ততা... সবকিছু মিলে তৈরি হতো এক জীবন্ত আর্ট গ্যালারি।

আজ এত বছর পর এই সাদাকালো ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে, ৬৫ সালের সেই বিকেলগুলো ছিল এক অন্যরকম স্বস্তি আর ভালোবাসার গল্প। পুরোনো ঢাকার সেই দিনগুলো আর ফিরবে না, কিন্তু স্মৃতিতে তারা চিরসবুজ হয়ে থাকবে যেমন সবুজ ছিল এই মোড়ের চারপাশের গাছগুলো।

21/11/2025

ভিডিওটি একটি নামহীন গ্রামের। ১৯৫৮ সালের এই চিত্রটি কেবল একটি ভূখণ্ড নয়, এটি আমাদের শিকড়ের দিকে ফেরা এক জানালা। এই ছবি দেখলেই মনটা এক লহমায় ফিরে যায় সেই সময়ে, যখন জীবন ছিল ধীরগতির, কিন্তু বাঁধন ছিল মজবুত।

ছবিতে যে পথটি দেখা যাচ্ছে, মনে করুন এই পথটিই ছিল গ্রামের হৃৎপিণ্ড। এই সময়ে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে মাত্র। গ্রামের বাতাসটা তখনো ধানের খেত আর ভেজা মাটির (কারণ গতকালই হয়তো হালকা বৃষ্টি হয়েছে) গন্ধে মাখামাখি।

এই পথে এখন যে মৃদু ছায়া পড়েছে, তার নীচে মফিজের মতো হাজারো শৈশব লুকিয়ে আছে। এই পথ ধরে সেদিনের কিশোরেরা খালি পায়ে ছুটত, পায়ের নীচে নরম ধুলো মাড়িয়ে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই নদীর ধারে গিয়ে ডুবসাঁতার খেলা, নয়তো কাঁঠাল পাতা দিয়ে ট্রেন-ট্রেন খেলা। তাদের প্যান্টের পকেটে থাকত কুল, তেঁতুল অথবা একমুঠো মুড়ি।

রাস্তার দু’ধারে যে টিনের চালাওয়ালা ঘরগুলো, তারা নীরব সাক্ষী। বর্ষার দিনে এই টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার যে অবিরাম সংগীত সৃষ্টি হতো, তা ছিল প্রকৃতির নিজস্ব অর্কেস্ট্রা। সন্ধ্যা নামার আগে এই প্রতিটি বাড়ি থেকে ধোঁয়া উড়তো—গরুর গোবর আর শুকনো কাঠ পুড়িয়ে রান্না শুরু হতো। মাটির উনুনে তৈরি হওয়া লাকড়ির ধোঁয়ার মিষ্টি গন্ধ এই সময়ে পুরো গ্রামকে আচ্ছন্ন করে রাখত।

মফিজের দাদি প্রায়ই বলতেন, "যে গ্রামে ধোঁয়া ওঠে না, সে গ্রাম অভিশাপগ্রস্ত।" তাই প্রতিটি ঘরের চিমনির ধোঁয়া ছিল যেন জীবনের স্পন্দন।

যখন সন্ধ্যা গাঢ় হতো, গ্রামের এই পথটি ঢেকে যেত এক গভীর, শান্ত অন্ধকারে। তখন গ্রামের একমাত্র আলোর উৎস ছিল হারিকেন। প্রতিটি বাড়িতে হারিকেনের কাঁচ পরিষ্কার করে তেল ভরে রাখা হতো সযত্নে। সেই ম্লান হলুদ আলোয়, উঠোনে মাদুর পেতে বসতো পুরো পরিবার।

বাবা জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়তেন যা বেশিরভাগই শোনানোর জন্য, বোঝার জন্য নয়। মা পান সেজে দিতেন। আর দাদি শুরু করতেন দাওয়াল আর দৈত্যের গল্প।

তখন কোনো টিভি, রেডিওর উচ্চশব্দ ছিল না। ছিল কেবল মানুষের গলার আওয়াজ, মশা তাড়ানোর ধোঁয়া, আর ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক। জীবন ছিল খুব সাধারণ, কিন্তু সেই সরলতার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল গভীরতম শান্তি আর তৃপ্তি।

ছবিতে দেখা এই রাস্তা, এই টিনের চালার গ্রাম এটাই ছিল আমাদের সেই সময়ের স্বর্গ, যেখানে প্রযুক্তির জটিলতা পৌঁছানোর আগেই শৈশব পূর্ণতা পেয়েছিল।

20/11/2025

১৯৬৫ সাল, ধানমন্ডি ২ নং রোড।
​তখন পথঘাট এমন মসৃণ আর ব্যস্ত ছিল না। পাকা রাস্তার দুধারে ছিল সারি সারি গাছ, আর মাঝে মাঝে চোখে পড়ত সবুজ লন ঘেরা নিচু ছাদের এক-একটা বাড়ি। রাস্তাটা যেন একটা শান্ত দুপুর, যেখানে কোলাহল নয়, শোনা যেত পাতার মর্মর আর দূর থেকে আসা রিকশার টুংটাং শব্দ।
​রিকশাওয়ালারা তখন এত হাঁপাতো না, কারণ গাড়ির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। মাঝে মধ্যে সাইকেল চেপে কেউ অফিস থেকে ফিরছেন, কিংবা দু-এক জন অল্পবয়সী ছেলে প্যান্ট-শার্টে সাইকেলের প্যাডেল মেরে যাচ্ছে বন্ধুদের আড্ডায়।

যেখানে পাশের প্লটে এখনো উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট ওঠেনি, শুধু ধুলো আর কচি ঘাস। স্কুলফেরত জামা পরেই শুরু হয়ে যেত তুমুল ফুটবল বা ক্রিকেট। খেলার শেষে সবাই মিলে এক ছুটে রাস্তার ধারের টিউবওয়েল থেকে জল খাওয়া।
সন্ধ্যা নামলে প্রতিটা বাড়ির জানলা দিয়ে ভেসে আসতো রেডিওতে বাজতে থাকা হেমন্ত বা মান্না দে-র গান। বারান্দায় পাটি বিছিয়ে চলত পাড়া-প্রতিবেশীদের গল্প-আড্ডা। চাঁদনী রাতে রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হতো যেন কোনো বাংলা উপন্যাসের পাতা ধরে হাঁটছি।

উৎসবের দিনে রাস্তাটা যেন সেজে উঠত অন্য রূপে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভেসে আসতো সেমাই আর কোর্মার সুঘ্রাণ। পাঞ্জাবি পরা বাবার হাত ধরে মিষ্টি বিতরণ করতে যাওয়ার সেই সরল আনন্দ!

​আজ যখন এই রাস্তা দিয়ে যাই, তখন উঁচু দালান, ট্র্যাফিকের শব্দ আর হর্ন-এর ভিড়ে সেই সবুজ আর স্নিগ্ধতা যেন চাপা পড়ে গেছে। তবুও, এই ২ নং রোড আমার কাছে আজও শুধু একটা ঠিকানা নয় এটা আমার শৈশবের সেই হারানো ছবির ফ্রেম, যার প্রতিটি কোণে লেগে আছে সহজ, সুন্দর আর প্রাণবন্ত জীবনের ছাপ।
​নস্টালজিয়া এমন এক সুবাস, যা সময় পার করেও হৃদয়ে লেগে থাকে।
​আপনার কাছে কেমন ছিল সেই সময়ের ধানমন্ডি? কমেন্টে জানান! 👇

Address

Kazi Nazrul Islam Avenue
Dhaka
1215

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when বাংলাদেশ posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Our Story

ভৌতিক অনুষ্ঠান "কুয়াশা" ABC Radio তে প্রতি সোমবার রাত ১১ টার খবরের পর অনুষ্ঠিত হয়।